Pages

Thursday, October 4, 2012

রোহিঙ্গা তাড়াও,বাংলাদেশ বাঁচাও




মিয়ানমার সীমান্তের খুব কাছে ছোট্ট জনপদটির নাম পশ্চিম মরিচ্যা। চারপাশে পাহাড়, মাঝখানে নিটোল সমভূমি। তার চোখজুড়ানো সবুজ ধানখেতে আশ্বিনের হিল্লোল। কিন্তু এখানে মুসলমানপাড়াগুলোর ফাঁকে ফাঁকে যে কয়েকটি বৌদ্ধপল্লি আছে, সেখানে অনিশ্চয়তা ও দমবন্ধকরা আতঙ্ক। গত রোববার রাতে এই পল্লির নিরীহ নিরুপদ্রব মানুষগুলোর ওপর নেমে এসেছিল অকল্পনীয় বিভীষিকা। 

গত বুধবার দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখতে পেলাম ছাই, কাঠ ও বাঁশপোড়া অঙ্গার, দগ্ধ গাছপালা, ভস্মীভূত ও ভগ্ন বুদ্ধমূর্তি আর কিছু নারী, পুরুষ ও শিশুর আতঙ্কিত মুখচ্ছবি। পশ্চিম মরিচ্যার দীপাঙ্কুর বৌদ্ধবিহারের ভস্মীস্তূপে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম, পাশের ঘরবাড়িগুলো থেকে বেরিয়ে আসছেন নারীরা। কথা বলার জন্য উদ্গ্রীব সবাই। কিন্তু আমরা কথা শুরু করার পর তাঁদের মুখে আর কোনো কথা নেই। যেন খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল তাঁদের সব কথা। তাঁদের কথা সামান্যই: দেখুন, কী অন্যায়, কী অবিচার করা হয়েছে।
চার মেয়ে, এক ছেলের মা ৩৫ বছর বয়সী মল্লিকা বড়ুয়া শুকনো মুখে বললেন, ‘বিচার চাই। পিতলের ঠাকুর পুড়িয়ে দিয়েছে, সেটি আবার যেন গড়ে দেওয়া হয়।’ কারা এসব করেছে? ‘আশপাশের লোকজন’—মল্লিকার উত্তর। হাত বাড়িয়ে আশপাশের গ্রামগুলোও দেখালেন। 
প্রায় ছয় ফুট লম্বা ঘোর কৃষ্ণবর্ণ যুবক বাবুল বড়ুয়া এগিয়ে এলেন। জানালেন, তিনি এই বৌদ্ধবিহারের সহসভাপতি। বললেন, বিহারের পাশের বৌদ্ধপল্লিটিতে ১২-১৩টি পরিবারের বাস। অন্যান্য পাড়া মিলিয়ে মোট ১১৭টি পরিবারের প্রায় ৮০০ বৌদ্ধকে ঘিরে বাস করেন কয়েক হাজার মুসলমান। আশপাশের গ্রামগুলোতে স্থানীয় মুসলমানদের সঙ্গে বাস করে অনেক রোহিঙ্গা, তারা সেখানে বিয়েশাদি করে স্থায়ী বসত গড়ে নিয়েছে। দূরে পাহাড়ের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ওই পথে রোহিঙ্গারা আসে। আগে রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠীর আনাগোনার অন্যতম পথ ছিল সেটি। 
বাবুল বললেন, রোববার রাত নয়টার দিকে জ্বালাও-পোড়াও স্লোগান দিতে দিতে একদল লোক এসে বৌদ্ধবিহারে কেরোসিন ও পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। তাদের অধিকাংশই উঠতি বয়সের ছেলে। অনেকেই আশপাশের গ্রামগুলোর পরিচিত মুখ। দুটি বাড়ি তারা লুটও করেছে। বাবুল বললেন, রোববার সন্ধ্যার পর থেকে মরিচ্যা বাজারের দিকে বিক্ষোভ-মিছিল শুরু হলে উখিয়া থানার ওসি এসেছিলেন এই বৌদ্ধবিহারে। তিনি চলে যাওয়ার পরেই একটি মিছিল এসে বিহারটিতে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। বাবুলের বিশ্বাস, ওসি যদি বিহারে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে মোতায়েন রেখে যেতেন, তা হলে বিহারটি এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা পেত।
ধ্বংসযজ্ঞের বিভীষিকাময় ছবি আমরা আগের দিন রামুতে দেখেছি। এখানে নতুন যা চোখে পড়ল, তা আতঙ্ক। এতটা আতঙ্ক রামুতে আক্রান্ত বৌদ্ধদের চোখেমুখে দেখিনি। এখানে আক্রমণকারীদের তাঁরা চেনেন; কিন্তু নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে পারছেন না। তাঁদের এখনো ভয় দেখানো হচ্ছে। 
৬৩ বছর বয়সী নির্মল বড়ুয়া বললেন, ওরা আবার হামলা চালাবে। মরিচ্যা বাজারে শুঁটকি বিক্রি করেন তপন বড়ুয়া। তিনি বললেন, রোববার দিনের বেলা তিনি বাজারে শুঁটকি বিক্রি করছিলেন, তখন কিছু লোক এসে তাঁকে ‘বড়ুয়ার বাচ্চা, তোদের শেষ করে দেব’ বলে উচ্চারণের অনুপযোগী ভাষায় গালাগাল করেছেন। 
আক্রমণকারী মিছিল নিয়ে এসেছিলেন স্লোগান দিতে দিতে। তাঁরা কী স্লোগান দিচ্ছিলেন, জানতে চাইলে কয়েকজন তরুণ বললেন, ‘বড়ুয়া পোড়াও, ঠাকুর পোড়াও, জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও’ ইত্যাদি। এক তরুণ বললেন, রোহিঙ্গারা তাদের হুমকি দিচ্ছে, তাদের কাউকে আসামি করা হলে গোটা বৌদ্ধপল্লি জ্বালিয়ে দেবে। বাবুল বড়ুয়া বললেন, রোহিঙ্গারা নাকি পুলিশকেও একই হুমকি দিয়েছে। সে কারণেই রোহিঙ্গাদের কাউকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর কথাবার্তা শুনে মনে হলো, তাঁরা রোহিঙ্গাদের হিংস্র কোনো প্রাণীর মতো ভয় পান।
নির্মল ও তপন বড়ুয়া বললেন, মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা তাঁদের এ দেশে থাকতে দেবে না। এ দেশ ছেড়ে তাঁদের চলে যেতে হবে। হিন্দু জনগোষ্ঠী ভারতে যায়। কিন্তু এঁরা কোথায় যাবেন, ভেবে পাই না। তপন বলেন, ‘বার্মা চলে যাব।’ রামুর ৭৮ বছর বয়সী বঙ্কিম বড়ুয়া যে বলেছিলেন, এখন তাঁদের রাস্তা দেখতে হবে, তিনিও কি মিয়ানমারকেই বোঝাতে চেয়েছিলেন? নির্মল বড়ুয়া বললেন, ‘রোহিঙ্গারা আমাদের মেরে ফেলবে, আমাদের ঘরবাড়ি, জায়গা-জমি সব দখল করে নেবে। আমাদের বার্মা চলে যাওয়া ছাড়া আর কি উপায় আছে?’
সড়ক থেকে যে আলপথ দিয়ে বৌদ্ধবিহারে যেতে হয়, তার এক পাশে দুটি বাড়ি সেদিন আক্রমণকারীরা লুট করেছে। রামুতে লুটপাটের ঘটনা ঘটেনি, কিন্তু এখানে তা ঘটেছে। সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও বিদ্বেষের সঙ্গে এখানে বৈষয়িক যোগ বেশ লক্ষ করার মতো। এই অঞ্চলের বৌদ্ধরা তবে কি ভিটেমাটি ছেড়ে দেশত্যাগের পথেই পা বাড়াতে বাধ্য হবেন? আন্তর্জাতিক দাতারা কিছুদিন আগে আমাদের সরকারকে বেশ চড়া গলায় বললেন, রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত খোলা রাখতে হবে, তাদের আশ্রয় দিতে হবে। এ অঞ্চলের জন্য কী ধরনের ডেমোগ্রাফিক (জনমিতি) সমীকরণের ছক কষছেন তাঁরা?