ভোলা জেলায় ২০০১ সালে হিন্দু ছিল ৭২ হাজার ২৭৫ জন। সর্বশেষ শুমারিতে দেখা যাচ্ছে, জনসংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৬১ হাজার ১৬২ জনে।
ভোলা জেলার দৌলতখান উপজেলার চরপাতা ইউনিয়নের নলগোড়া গ্রামের সাধু সিংয়ের বাড়িতে ছিল ছয়টি পরিবার। পরিবারের প্রধান ছিলেন লক্ষ্মী নারায়ণ সিং। লক্ষ্মী নারায়ণ ১৯৯২ সালের পরে জমিজমা বিক্রি করে চলে যান। ওই গ্রামের লোকজন প্রথম আলোকে বলেছেন, ১৯৯২ সালের পর থেকে হিন্দু পরিবারগুলো চলে যেতে শুরু করে। ওই সময় বাররি মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে ভারতে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল, তাতে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকার হয় এই গ্রামের মানুষ।
২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনের পরও অনেক পরিবার চলে গেছে। গ্রাম ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৯২ সালের পর থেকে সুতারবাড়ির চারটি, ডাক্তারবাড়ির ১০, মাঝের সিংবাড়ির ছয়, রাস কমল হাওলাদার বাড়ির সাত, লক্ষ্মীকান্ত হাওলাদার বাড়ির তিন, তীর্থবাস হাওলাদার বাড়ির সাত, পরেশ হাওলাদার বাড়ির সাত, তেলীবাড়ির তিন, রাধেশ্যাম সুতারবাড়ির তিন, মন্টু হাওলাদার বাড়ির এক এবং রাড়ি বাড়ির সব কটি পরিবারসহ গ্রামের ৭৫টি বাড়ির দুই শতাধিক পরিবার চলে গেছে।
উপজেলার নলগোড়া, লেজপাতা ও চরগুমানী—এই তিনটি গ্রাম ছিল হিন্দু-অধ্যুষিত। স্বাধীনতার সময় এই গ্রামে চার শতাধিক বাড়ি ছিল। এই গ্রামগুলোর ১৭২টি বাড়ির কয়েক শ পরিবার চলে গেছে।
বোরহানউদ্দিন উপজেলার টবগী ইউনিয়নের মুলাইপত্তন গ্রামে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এক হাজারের বেশি হিন্দু পরিবার ছিল। বর্তমানে সেখানে আছে ৪৪টি পরিবার।
লালমোহন উপজেলার লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নে চারটি গ্রাম ছিল হিন্দু-অধ্যুষিত। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এই ইউনিয়নে চার হাজার ৬০০ হিন্দু ভোট ছিল। ইউনিয়নের অন্নদাপ্রসাদ গ্রামের যাত্রামণি লস্কর বলেন, ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদের ঘটনা ও ২০০১ সালে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে গ্রামগুলোর অধিকাংশ হিন্দু পরিবার এলাকা ছেড়ে চলে যায়। স্থানীয় ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রের দেওয়া তথ্যে বলা হচ্ছে, বর্তমানে ইউনয়নে হিন্দু ভোটারের সংখ্যা ৬০০।
৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী সহিংস ঘটনা ঘটলেও সকল মাত্রা ছাড়িয়ে শীর্ষে অবস্থান করে ভোলা জেলার লালমোহন থানার লর্ড হার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের অন্নদা প্রসাদ গ্রামের ভোন্ডারবাড়ীর ঘটনা। নির্বাচনের পর পরই শুরু হয় দেশব্যাপী আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থক বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন। যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ এবং ভেন্ডারবাড়ী থেকে থানা প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে হওয়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনের লোকজন এমনকি সংবাদকর্মীরাও নির্বাচনে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি। বাড়িঘর লুটপাট, চাঁদা দাবি, এমনকি নারী ধর্ষণের অজস্র ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে অধিকাংশ ঘটনাই পুলিশের নথিভুক্ত হয়নি।
তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০০১ সালের ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১ অক্টোবর রাতে হামলা, ধর্ষণ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি ঘটনায় লালমোহনের বিভিন্ন এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। নির্বাচনের পরদিন ২ অক্টোবর অন্নদা প্রসাদ গ্রামের আশপাশের গ্রামের সংখ্যালঘু মহিলারা নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছিল গ্রামের চার পাশের ধানক্ষেত ও জলাভূমি পরিবেষ্টিত ভেন্ডারবাড়ী। অর্ধশতাধিক মহিলা তাদের সম্ভ্রম রৰার জন্য সেখানে আশ্রয় নেয়। কিন্তু সে বাড়িটিও সন্ত্রাসীদের নজর এড়ায়নি। নরপিশাচদের আগুনে আত্মাহুতি দিল শত নারী। শত শত বিএনপি সন্ত্রাসী ৮/১০টি দলে বিভক্ত হয়ে অত্যনত্ম পরিকল্পিতভাবে ওই রাতে হামলা চালায়। একের পর এক দল হামলা চালিয়ে অসহায় সংখ্যালঘু পরিবারের মেয়ের ধর্ষণ করতে থাকে। শত চেষ্টা করেও মহিলা তাদের সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারেনি। অনেক সম্ভ্রম হারানোর ভয়ে, প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে আশপাশের জলাশয়ের ধানক্ষেতে। মহিলারা পানিতে ঝাঁপিয়ে সম্ভ্রম রক্ষার চেষ্টা চালালে রাজনৈতিক মদদপুষ্ট এ সন্ত্রাসীরা তাদের সন্তানদের পানিতে ফেলে দেয়ার হুমকি দিলে সন্তানদের জীবন রক্ষায় তারা উঠে আসতে বাধ্য করে। আর উঠে আসলেই তারা গণধর্ষণের শিকার হয়। এভাবে ধর্ষিত হয় আট বছরের শিশু, লাঞ্ছিত হয়েছে ৬৫ বছরের বৃদ্ধা, মা, মেয়ে, শাশুড়ি, পুত্রবধূকে ধর্ষণ করা হয়েছে এক সঙ্গে। এ সময় ছেলের চেয়েও ছোট বয়সী সন্ত্রাসী ধর্ষণ করেছে মায়ের চেয়েও বেশি বয়সের নারীকে। সন্ত্রাসীরা ছাড়েনি পঙ্গু নারী শেফালী রানী দাসকেও। পঙ্গু হওয়া সত্ত্বেও অন্যদের মতো সন্ত্রাসীদের কবল থেকে সম্ভ্রম বাঁচাতে শেফালী রানীও পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস। পঙ্গু শেফালী পালানোর চেষ্টাকালে পুকুর পাড়ে হলুদ ক্ষেতে পড়ে যায়। তখন দুই সন্ত্রাসী তাকে ধরে ফেলে এবং তার পরনের কাপড় ছিঁড়ে তাকে বিবস্ত্র করে দুই সন্ত্রাসী পালাক্রমে ধর্ষণ করে। সন্ত্রাসীদের পাশবিক অত্যাচারে এক পর্যায়ে শেফলী জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে পলফ্যাশন হাসপাতালে তার চিকিৎসা করানো হয়। সম্ভ্রম হারিয়ে অনেকেই লজ্জায়, ভয়ে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যায়।
তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভেন্ডারবাড়ীতে নারকীয় এ পাশবিক ঘটনার বিএনপি সন্ত্রাসীদের মধ্যে অন্যতম ছিল অন্নপ্রসাদ গ্রামের আবু, সেলিম, দুলাল, জাকির পিং আঃ খালেক। এছাড়া ওই সন্ত্রাসীদের মধ্যে ছিল দুলাল পিতা-কব্বর আলী সাং চাঁদপুর, আলমগীর পিতা- আঃ মুন্নাফ সাং অন্নদাপ্রসাদ, সোহাগ মিয়া সাং অন্নদাপ্রসাদ, নজরম্নল পিতা- মৃত বদিউজ্জামান সাং চাঁদপুর, মোঃ আক্তার পিতা-আঃ হাই সাং ফাতেমাবাদ গং জোর পূর্বক গংগাচরণ দাস পিতা- মৃত বৈকুন্ঠ কুমার দাস সাং অন্নপ্রসাদের বাড়িতে প্রবেশ করে তার বিভিন্ন মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। আসামিরা তার স্ত্রী শেফালী বালা দাস ও কন্যা সুষমা রানী দাসকে ধর্ষণ করে। ওই গ্রামের অনেকে এখন ভারতে অবস্থান করছে। এখানে বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে আশ্রয় নেয়া ৬০/৭০ মহিলা ধর্ষণের শিকার হয়।
তদন্ত কমিশন লালমোহনের ভেন্ডারবাড়ী নারকীয় পৈশাচিক ঘটনায় জড়িত কিছু সন্ত্রাসীদের নাম উল্লেখ করেছে তাদের প্রতিবেদনে। এর মধ্যে ১. দুলাল, পিতা- আলী আকবর, সাং চাঁদপুর। ২. ইব্রাহিম খলিল, পিতা-মৃত মৌলভী মোহাম্মদ, সাং অন্নদাপ্রসাদ। ৩. আকতার (৩৫) পিতা-জাফর উল্যাহ, সাং চাঁদপুর। ৪. সাইফুল (৪০) পিতা-ওসমান গনি, সাং-অন্নদাপ্রসাদ। ৫. শাহাবুদ্দিন পিতা- আঃ হাই সাং-চাঁদপুর। ৬. মোতাহার (৩৫), পিং- সামছুল হক, সাং-ফাতেমাবাদ, ৭. ভুট্টো, পিতা- মোসত্মফা, সাং-অন্নদাপ্রসাদ, ৮.নান্নু (৩৭), পিতা- লুৎফর রহমান, সাং ফাতেমাবাদ। ৯. আলমগীর, পিতা-আবুল হাশেম, সাং-সৈয়দাবাদ, ১০ সেলিম, পিতা-ইয়াসিন মাস্টার, সাং-অন্নদাপ্রসাদ। ১১. জাকির, পিতা- আঃ মালেক। ১২. নজরম্নল, পিতা বদিউজ্জামান, ১৩. আবু, পিতা- জলিল, ১৪. মিজান, পিতা-ইসহাক, ১৫. ইদ্রিস, পিতা-আঃ কাদের ১৬. মোশারফ, পিতা- শাহাবুদ্দিন মিয়া, ১৭. বাবলু, পিতা-নুরম্নজ্জামান, ১৮. কামরুল, পিতা-নুরম্নজ্জামান, সর্ব সাং অন্নাদপ্রদান লালমোহন বোলা। অজ্ঞাতনামা ২০/২৫ জন যাদের নাম ঠিকানা তদনত্মের সময় কেউ বলেনি বা বলতে পারেনি।
অন্তঃসত্ত্বা জয়ন্তী-সংগ্রামের কাহিনী ॥
৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরদিন ২ অক্টোবর অষ্টাদশী গ্রাম্য গৃহবধূ জয়ন্তী যখন প্রথম সনত্মানের জন্মমুহূর্তে প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছে, ঠিক সে সময় দিন দুপুরেই বেলা আনুমানিক ৩টায় ভোলা জেলার লালমোহন উপজেলার সাত নন্বর পশ্চিম চর উমেদ ইউনিয়নের জাহাজমারা গ্রামে হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়, স্থানীয় বিএনপি নেতা ইলিশা কান্দি গ্রামের জাহাঙ্গীর মাতবরের নেতৃত্বে অর্ধশতাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী দা, ছুরি, লাঠি ও বল্লমসহ তাদের কুঁড়েঘরে হামলা চালায়। হামলায় গ্রামবাসী ভয়ে পালিয়ে যেতে থাকে। গ্রামের বিভিন্ন ঘরে ঢুকে সন্ত্রাসীরা হামলা চালাতে থাকে। জয়ন্তীর শাশুড়ি মুক্তিরানী একজন স্থানীয় ধাত্রীকে দিয়ে তার শিশু প্রসব করাচ্ছিল। শিশু প্রসবের মুহূর্তে সন্ত্রাসীরা দা ও ছুরি দিয়ে জয়ন্তীর কুঁড়ে ঘরের বেড়ায় কোপ মারতে থাকে। ধাত্রী সন্ত্রাসীদের ভয়ে ও আতঙ্কে পালিয়ে যায়। ঘরে শুধু অসহায় জয়ন্তী ও তার শাশুড়ি। সন্ত্রাসীরা তখনও ঘরের বেড়া ভাঙার চেষ্টা চালাচ্ছে। এ মুহূর্তে জন্ম নেয় একটি পুত্র সন্তান। হতবুদ্ধি মুক্তিরানী কোন উপায় না দেখে জয়ন্তীকে ভালভাবে জড়িয়ে ধরে নবজাতককে পরনের শাড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে ঘরে নিয়ে অপর দিকের বেড়া ভেঙে জয়ন্তীকে টেনেহিঁচড়ে বের করে আনে। পরবর্তীতে ওই অবস্থায় দৌড়ে পালায় পাশের ধানক্ষেতে নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়। সদ্যপ্রসূতি মা জয়ন্তীর তখন দৌড়ে পালানোর মতো অবস্থা ছিল না। কিন্তু মৃত্যু ভয়ে ভীত মুক্তি রানী তাকে জোর করে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। তখনও পর্যনত্ম সদ্যজাত শিশুটিকে মায়ের নাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন করার সময় পায়নি মুক্তি রানী। তাদের মতো অনেকেই সেই ধানক্ষেতের মধ্যে অপেক্ষাকৃত উঁচু একটি জায়গায় নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় এসে জড়ো হয়েছিল। সেখানে একজনের কাছ থেকে একটি ব্লেড নিয়ে শিশুটির নাড়ি কাটে মুক্তি রানী। রাত নয়টা পর্যন্ত সেখানে থেকে সন্ত্রাসীদের চলে যাওয়ার খবর নিশ্চিত করে তারা পুনরায় ঘরে ফিরে যায়। এ ঘটনার কারণে সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানের নাম রাখা হয় সংগ্রাম।
গ্যাং রেপ ॥ নির্বাচনের পরদিন বিভিন্ন স্থানে চলে গ্যাংরেপ। ঝালকাঠির নলছিটিতে একই পরিবারের চম্পা রানী, পুতুল রানী, মিনতী রানী, মালতী রানীকে এক সঙ্গে ধর্ষণ করে এ নরপিশাচরা। বিএনপির সন্ত্রাসীরা নৌকা মার্কায় ভোট দেয়ার অপরাধে রাতে বাড়িতে এসে লুটপাট চালায়। পরবর্তীতে দল বেঁধে একই পরিবারের চার মা-মেয়ে ধর্ষণ করে।
১ অক্টোবরের নির্বাচনের পরদিন ভোলার লালমোহন উপজেলার লর্ড হার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের চর অন্নদাপ্রসাদ, পিয়ারীমোহন ও ফাতেমাবাদ গ্রামের সংখ্যালঘুদের ওপর নির্বিচারে হামলা চলে। হামলা থেকে বাঁচতে ভেণ্ডরবাড়ী গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন হিন্দু নারীরা। বিএনপির সমর্থকেরা সেখানেও হানা দিয়ে রাত ১০টা থেকে ভোর পর্যন্ত নিপীড়ন ও লুটপাট চালায়। চর অন্নদাপ্রসাদ গ্রামের আট বছরের যে মেয়েটি ধর্ষিত হয়েছিল সে এখন আর বাড়িতে থাকে না। বাড়িতে ছিলেন ৮০ বছরের বৃদ্ধা ঠাকুরমা অবলা রানী বালা। প্রথম আলোর প্রতিবেদককে বললেন তিনি, ওই ‘কালিমার কতা’ ভুলতে পারবেন না তারা কোনো দিন। লর্ড হার্ডিঞ্জের সব নির্যাতিত সংখ্যালঘু পরিবারের মনোভাবই এ রকম। তাঁরা একটি নিরাপদ, আশঙ্কামুক্ত জীবন দাবি করেছেন সরকারের কাছে। অনেকেই এলাকাছাড়া। এলাকাবাসীর বক্তব্য অনুযায়ী কেউ দেশ ছেড়েছেন, কেউ পাড়ি জমিয়েছেন অন্য জেলায়। অন্নদাপ্রসাদ গ্রামের মেন্টর বাড়ির বিনোদ চন্দ্র দাস (৬০) প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সব সময় আতঙ্কে থাকি আবার যদি ২০০১ আসে। আবার যদি...।’ কান্নায় গলা বুজে আসায় কথা শেষ করতে পারেননি বৃদ্ধ। একটু সামলে নিয়ে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় এই এলাকার অনেক হিন্দুকে জীবন দিতে হয়েছে। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ দাঙ্গার সময়েও হামলা হয়েছে। ২০০১ সালে গেছে নারীর সম্ভ্রম।’ বিনোদ চন্দ্র দাস আক্ষেপ করে বলেন, লর্ড হার্ডিঞ্জ ইউনিয়নে ৪০ বছর হিন্দু চেয়ারম্যান ছিলেন। এখন সেই ইউনিয়নে একজন হিন্দু ইউপি সদস্য হিসেবেও নির্বাচনে দাঁড়াতে ভরসা পান না, কারণ সংখ্যালঘু ভোটারই নেই। অনেকেই পৈতৃক ভিটা পরিচিত মুসলমানের হেফাজতে রেখে চলে গেছেন। গতকাল সোমবার ইউনিয়নের অন্নদাপ্রসাদ, ফাতেমাবাদ ও পেরীমোহন গ্রামে ঘুরে জানা যায়, ২০০১ সালের ২ অক্টোবর রাতে একটি হিন্দু পরিবারও নির্যাতনের হাত থেকে বাদ যায়নি।
অন্নদাপ্রসাদ গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধা বকুল রানী দাস বলেন, ‘আমরা নেতা-নেত্রীগো কইয়্যা দিছি, বাবা! আইজ বাদে কাইল মইর্যা জামু । নিজের দ্যাশোত্ মরতাম চাই। আমরা কাউরে ভোট দিমু না। আমনারা য্যারে খুশি আমাগো ভোট দিয়া লইয়েন। তবুও আমরা নৌকায় ভোট দেই কইয়্যা আমাগোরে মাইরেন না।’ লর্ড হার্ডিঞ্জের পরে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছেন দৌলতখান উপজেলার চরপাতা ইউনিয়নের হিন্দুরা। এখানকার সরকারবাড়ি ও তার আশপাশে ২ অক্টোবর রাত নয়টায় দুর্বৃত্তরা আক্রমণ করে। এ ছাড়া ভোলা সদরের উত্তর দিঘলদীর জয়গোপী, আলীনগরের ঠাকুরবাড়িসহ একাধিক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট হয়।
এক সাংবাদিকের মুখেই শুনি ঘটনার বিবরণঃ
“ সময়টা ২০০১। সদ্য সমাপ্ত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে বিএনপি-জামায়াত জোট। তখনও অবশ্য তাদের সরকার গঠন হয়নি। দেশ চালাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা। সেই সঙ্গে চলছে সংখ্যালঘু আর ৪ দলীয় জোটবিরোধী নেতা-কর্মীদের উপর নির্যাতন। সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখতে কয়েকজন সাংবাদিক বন্ধুর সাথে যাই ভোলার লালমোহন। বাড়ি বাড়ি ঘুরে স্ব-চোখে দেখা আর চোখের জল সম্বরনের ব্যর্থ চেষ্টা নিয়ে যখন ফিরছি তখন দুপুর। ক্যাডারদের চোখ এড়িয়ে কি করে ভোলায় এসে নিউজ আর ছবি পাঠাবো সেই চিন্তা মাথায়। লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়ন থেকে বেরুতেই চোখে পড়ে মেঠো পথে ধূলোর ঝড় উড়িয়ে ধাবমান গাড়ি আর মোটর সাইকেলের বহর। কাছে এসে বহর থামিয়ে গাড়ি থেকে নামলেন তৎকালীন সদ্য নির্বাচিত বিএনপি দলীয় এমপি মেজর (অবঃ) হাফিজউদ্দিন আহমেদ। সামনে পেছনে ২৫/৩০টি মোটরসাইকেলে তার ক্যাডার বাহিনী। কাছে এসে পরিচয় জানার পরপরই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন হাফিজ। আমাদের কারনেই সারাদেশে অরাজকতা এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে অভিযোগ তার। সংখ্যালঘু নির্যাতনের নামে আওয়ামী লীগের ইস্যু বাস্তবায়ন আর উল্টো-পাল্টা লিখলে ফলাফল ভাল হবে না বলে হুশিয়ারী দেন তিনি। এর এক/দু’দিন পরের ঘটনা। বেপরোয়া নির্যাতনে জীবন বাচাঁতে গোপালগঞ্জের রামশীলে আশ্রয় নিয়েছে কয়েক হাজার সংখ্যালঘু। এর ঠিক পাশের উপজেলা বরিশালের আগৈলঝাড়া। এই দুই উপজেলার সীমান্তবর্তি খালে পাওয়া গেল এক সংখ্যালঘুর লাশ। সংবাদটি তাৎক্ষনিক প্রচার করে বেসরকারি একটি টেলিভিশন। সংবাদ প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষেপে যান সেখানকার তৎকালীন নব নির্বাচিত বিএনপি দলীয় এমপি সাবেক বামপন্থি নেতা জহির উদ্দিন স্বপন। ওই টেলিভিশনের অফিসে ফোন করে মিথ্যা সংবাদ প্রচারের অভিযোগ আর বরিশাল প্রতিনিধিকে দেখিয়ে দেয়ার হুমকি দেন তিনি ”
সাংবাদিক লিতন বাশারের ভাষায়, “ ২০০১ সাল । তারিখটি ছিল ১ অক্টোবর। সন্ধ্যার কালো অন্ধকার ঘনিয়ে আসার সাথে সাথেই এক যোগে সারাদেশে সংখ্যালঘুদের জন্য রাতের অন্ধকার যেন আরো কালো হয়ে রাজত্ব গেরে বসে। বিশেষ করে যুবতী, কিশোরী, তরুনী থেকে শুরু করে পঙ্গু গৃহবধু কিংবা বউ শাশুড়ী এক যোগে ধর্ষনের শিকার হলো। দেশের গাঙ্গেয় অববাহিকার দ্বীপজেলা ভোলার সংখ্যালঘুদের একটি বিশাল জনগোষ্টির আবাস স্থল হচ্ছে লালমোহনে। এ উপজেলার লর্ড হার্ডিঞ্জ, চর অন্নদা প্রসাদ, ফতেমাবাদ, রায় চাদ, পেয়ারী মোহন সহ বেশ কয়েকটি গ্রামের সিংহ ভাগ মানুষই হিন্দু সম্প্রদায়ের। তাই তাদের সংখ্যালঘু বলা চলে না। তাতে কি? বিজয়ের আনন্দ যখন বিএনপি’র ঘরে ঘরে তখন এ সব গ্রামের মানুষদের বিশেষ করে নারী সম্প্রদায়ের সম্ভ্রম রক্ষায় পালাতে হলো। কিন্ত পালিয়ে রক্ষা পাওয়া গেল না। যে গ্রাম গুলোর কথা বললাম তা উপজেলা সদর থেকে এতটাই দূরত্ব যে ঐ সব গ্রামের মানুষ খুব সহজে উপজেলা সদরে আসেন না।
মা-মেয়ে শাশুড়ি-পুত্র বধু পর্যন্ত
উপজেলা সদর থেকে বহুদুরের ছায়াঘেরা সবুজ বেষ্টনীতে ঘিরে রাখা ইউনিয়নটির নাম লর্ড হাডিঞ্জ। বৃটিশ উচ্চ পদস্থ এক কর্মকর্তার নামেই এ ইউনিয়নের নাম রাখা হয়। ইউনিয়নের কাচা মাটির রাস্তা ধরে এগুলোই গ্রামের মাঝে ছোট্ট একটি বাজারে নাম জিএম বাজার। পাশেই জিএম স্কুল। এই স্কুলের প্রতিষ্টাতা গুনমনি হালদার ছিলেন একজন সত্যিকারের গুনী শিক্ষক। ১৭ বছর ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন প্রিয় লাল নামের একজন বিশিষ্ট ধর্ণাঢ্য ব্যক্তি। তারপর চেয়াম্যান হয়েছিলেন দাশরত বাবু। এ সব গুনীজনকে নিয়ে রয়েছে বিশাল ইতিহাস। সেই ঐহিত্যের সোনার খাটি মানুষ গুলোর গ্রামেই কলংকের তিলক একে দিল হায়নার দল। ভয়াল রাতে আশ্রয় নিয়ে ছিল গ্রামের মধ্যবর্তী ভেন্ডার বাড়িতে। দ্বীপ জেলা ভোলা বা মনপুরা উপজেলার মতই এ বাড়িটির চারদিকে পানি থাকায় নিজেদের নিরাপদ মনে করেছিল নারীরা। কিন্ত হাটু সমান পানি আটকে রাখতে পারেনি ধর্ষকদের। তারা দল বেধে উল্লাস করে ছুটলো ভেন্ডার বাড়িতে। সভ্যতার সকল সীমা লংঘন করে বর্বরতার মুখোশ উম্মোচিত হলো। মা, মেয়ে, শাশুড়ি ও পুত্র থেকে শুরু করে নাতনীর বয়সী কিশোরী পর্যন্ত
রেহায় পেল না। এই বাড়ির ধর্ষনকারীদের নেতৃত্বে ছিলেন স্থানীয় ইয়াছিন মাষ্টারের দুই ছেলে সেলিম ও বেল্লাল। এ যেন আইয়ামে জাহিলিয়াতের যুগ। সহোদর মিলে ধর্ষন করলো এ বাড়ীতে আশ্রয় নেওয়া ছোট্ট শিশু রিতাকে। বয়স্করা ধর্ষনের বিষয়টি অনেকেই চেপে গেলেও রিতা অসুস্থ হয়ে পরায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। জাতীয়তাবাদী আতংকের মাঝেই ধর্ষনের গুঞ্জন ভোলা সদর পর্যন্ত আমাদের কানে চলে আসে।
উপজেলা সদর থেকে বহুদুরের ছায়াঘেরা সবুজ বেষ্টনীতে ঘিরে রাখা ইউনিয়নটির নাম লর্ড হাডিঞ্জ। বৃটিশ উচ্চ পদস্থ এক কর্মকর্তার নামেই এ ইউনিয়নের নাম রাখা হয়। ইউনিয়নের কাচা মাটির রাস্তা ধরে এগুলোই গ্রামের মাঝে ছোট্ট একটি বাজারে নাম জিএম বাজার। পাশেই জিএম স্কুল। এই স্কুলের প্রতিষ্টাতা গুনমনি হালদার ছিলেন একজন সত্যিকারের গুনী শিক্ষক। ১৭ বছর ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন প্রিয় লাল নামের একজন বিশিষ্ট ধর্ণাঢ্য ব্যক্তি। তারপর চেয়াম্যান হয়েছিলেন দাশরত বাবু। এ সব গুনীজনকে নিয়ে রয়েছে বিশাল ইতিহাস। সেই ঐহিত্যের সোনার খাটি মানুষ গুলোর গ্রামেই কলংকের তিলক একে দিল হায়নার দল। ভয়াল রাতে আশ্রয় নিয়ে ছিল গ্রামের মধ্যবর্তী ভেন্ডার বাড়িতে। দ্বীপ জেলা ভোলা বা মনপুরা উপজেলার মতই এ বাড়িটির চারদিকে পানি থাকায় নিজেদের নিরাপদ মনে করেছিল নারীরা। কিন্ত হাটু সমান পানি আটকে রাখতে পারেনি ধর্ষকদের। তারা দল বেধে উল্লাস করে ছুটলো ভেন্ডার বাড়িতে। সভ্যতার সকল সীমা লংঘন করে বর্বরতার মুখোশ উম্মোচিত হলো। মা, মেয়ে, শাশুড়ি ও পুত্র থেকে শুরু করে নাতনীর বয়সী কিশোরী পর্যন্ত
রেহায় পেল না। এই বাড়ির ধর্ষনকারীদের নেতৃত্বে ছিলেন স্থানীয় ইয়াছিন মাষ্টারের দুই ছেলে সেলিম ও বেল্লাল। এ যেন আইয়ামে জাহিলিয়াতের যুগ। সহোদর মিলে ধর্ষন করলো এ বাড়ীতে আশ্রয় নেওয়া ছোট্ট শিশু রিতাকে। বয়স্করা ধর্ষনের বিষয়টি অনেকেই চেপে গেলেও রিতা অসুস্থ হয়ে পরায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। জাতীয়তাবাদী আতংকের মাঝেই ধর্ষনের গুঞ্জন ভোলা সদর পর্যন্ত আমাদের কানে চলে আসে।