সামনেই দুর্গা পূজা।
দুর্গা পূজা উপলক্ষে আমারা বেশ কিছুদিন ধরে বিশেষ পোস্ট দিয়ে যাচ্ছি।তারই
ধারাবাহিকতায় আজ আপনাদের সামনে বলব নব দুর্গার কথা। অর্থাৎ দেবী দুর্গার নয়টি রূপ।
সে গুলো
হল শৈলপুত্রী , ব্রহ্মচারিণী , চন্দ্রঘণ্টা , কূষ্মাণ্ডা , স্কন্দমাতা , কাত্যায়নী , কালরাত্রি , মহাগৌরী ,সিদ্ধিদাত্রী।
শ্রী শ্রী “চণ্ডী"তে যে ‘দেবীকবচ’ সংযোজিত-তার ঋষি ব্রহ্মা,
ছন্দ অনুষ্টুপ ও দেবতা চামুণ্ডা। শ্রীচণ্ডিকা
দেবীর প্রীতি সাধনের জন্য চণ্ডীপাঠের অঙ্গরূপে দেবীকবচ পাঠের প্রয়োগ করা হয়। ঋষি
মার্কণ্ডেয় প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, এই জগতে যা সকল লোকের পক্ষে মঙ্গলকর, অথচ পরম গোপনীয় এবং অন্য কারো কাছে ব্যাখ্যাত হয়নি,
সেটা কি? উত্তরে ব্রহ্মা বলে, দেবীর পুণ্য কবচই (বর্ম) অতি গোপনীয় এবং সকল জীবের পক্ষে
কল্যাণকর।
তারপরই ব্রহ্মা মহামুনি
মার্কণ্ডেয়কে নবদুর্গার কথা বলেন। এই নবদুর্গা হলেন,
“প্রথমং শৈল্যপুত্রীতি
দ্বিতীয়ং ব্রহ্মচারিণী।
তৃতীয়ং চন্দ্রঘন্টেতি
কুষ্মাণ্ডেতি চতুর্থকম।।
পঞ্চমং স্কন্দমাতেতি
ষষ্ঠং কাত্যায়নী তথা।
সপ্তমং কালরাত্রীতি
মহাগৌরীতি চাষ্টকম।।
নবমং সিদ্ধিদাত্রী চ
নবদুর্গাঃ প্রকীর্তিতাঃ।”
এভাবে পুরাণে নব দুর্গার
কথা বলা হয়েছে।
১>দেবী শৈলপুত্রিঃ
_______________
দক্ষযজ্ঞে দেবী ভগবতী সতী
যখন শিবনিন্দা শুনে দেহত্যাগ করলেন, তখন মহাদেব ক্রোধে উন্মত্ত ও শোকে বিহ্বল হয়ে সেই দক্ষযজ্ঞ ধ্বংস করে সতীর
দেহ কাঁধে নিয়ে উন্মত্তের মতো সারা ত্রিলোক ঘুরতে লাগলেন। ত্রিভুবন তাঁর
তাণ্ডবনৃত্যে সন্ত্রস্ত কম্পিত হয়ে উঠল। বিশ্বের এই বিপদ সামলাবার জন্য নারায়ণ
তাঁর সুদর্শন চক্রে শিবস্কন্ধস্থিত দেবীর শরীর একটু একটু কবে কেটে ফেলতে লাগলেন।
দেবী দেহের সেই টুকরো যেখানে পড়ল সেখানে সৃষ্টি হল একান্নটি শক্তিপীঠ। আর এদিকে
ভাববিভোর শংকর তাঁর কাঁধে দেবীর শরীর না পেয়ে আত্মস্থ হয়ে কৈলাসে গিয়ে ধ্যানে
বসলেন। শক্তি লাভের জন্য শুরু হল মহাদেবের তপস্যা।
অন্যদিকে স্বর্গরাজ্যে
তারকাসুরের অত্যাচারে দেবতারা বিপন্ন হয়ে ব্রহ্মার কাছে গেলে তিনি বিধান দিলেন
-উপযুক্ত সেনাপতির অভাবে তোমাদের এই পরাজয়। এই সেনাপতি হবেন,শিব-শক্তির মিলনের ফলে সৃষ্ট হবেন যিনি,সেই কুমার। দেবতারা তখন দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়াকে কাতর
হয়ে প্রার্থনা করতে লাগলেন - ‘মা, তুমি এসো, আবির্ভূত হও,
শিবসঙ্গে আবার বিরাজিত হও-আমাদের এই বিপদ থেকে
রক্ষার জন্য তোমার ও দেবাদিদেবের মিলনে একটি উপযুক্ত সেনাপতি আমাদের দান কর।’
দেবতাদের এই কাতর প্রার্থনায় মহাদেবী দুর্গা
আবার মর্ত্যশরীর ধারনে স্বীকৃতা হলে। এর আগে নাগাধিরাজ হিমালয় ও পত্নী মেনকা
স্বয়ং জগদম্বাকে কন্যারূপে পাওয়ার জন্য অনেক তপস্যা করেছিলেন। এখন দেবতাদের
ইচ্ছা ও হিমালয়ের প্রার্থনা পূর্ণ করবার জন্য দেবী পার্বতী হৈমবতী কন্যা হয়ে
হিমালয়ের গৃহে জন্ম নিলেন। তখনই তাঁর নাম হল শৈলপুত্রী। এই দেবীর সৃষ্টি এইভাবেই
হয়েছিল। ইনিই পরে শিবের জন্য তপস্যা তাঁর সঙ্গে মিলিত হয়ে কার্ত্তিকের জন্মদান
করেন।
২>দেবী মহাগৌরীঃ
________________
দেবী মহাগৌরী, বৃষভবাহনা চতুর্ভুজা, শ্বেতবর্ণা, শ্বেতবস্ত্রাবৃতা।
অলংকারাদিও শ্বেতবর্ণের-শঙ্খবলয়, কণ্ঠ ও কর্ণের
ভূষণও শঙ্খনির্মিত। শিরে রজত মুকুট। সদা অষ্টবর্ষা দেবী কুন্দপুষ্পের মাল্যধারিণী
বিধুমুখী সদাপ্রসন্না। এঁর ঊর্ধ্ব দক্ষিণ হস্তে ত্রিশূল, নিচের দক্ষিণ হাতে অভয় মুদ্রা। বাম ঊর্ধ্ব হস্তে বরমুদ্রা,
নিচের হাতে ডমরু।
এক পুরাণের মতে দেবী
শিবের তপস্যার সময় অত্যন্ত কৃচ্ছ্রতার ফলে শীর্ণ ও কৃষ্ণকায়া হয়ে গিয়েছিলেন।
তখন তাঁর একটি নাম হয়েছিল অসিতা। পরে শিবের সঙ্গে বিবাহ হয়ে যাওযার পরে কোন এক
সময় শিব দেবীর সেই কালো দেহবর্ণের জন্য উপহাস করে তাকে কালী বা কালোমেয়ে
বলেছিলেন। এই কথা শুনে দেবী অভিমানে কৈলাস ছেড়ে চলে গিয়ে কঠোর তপস্যায় নিযুক্ত
হলেন। সেই তপস্যার ফলে তাঁর দেহের কৃষ্ণ কোষ খুলে গিয়ে ভেতর থেকে এক
দিব্যজ্যোতির্ময়ী রজতশুভ্রবর্ণা দেবীমূর্তি প্রকাশিত হলেন। বিদ্যুত্বর্ণা সেই
দেবীই শিবের বাহন ও সব অস্ত্রাদি নিয়ে তাঁর কাছেই হাজির হলেন।শিবও অভিমানিনী
দেবীর অভিমান ভাঙাতে ও তাঁর জন্য এতোদিন ব্যাকুল অপেক্ষায় থাকার পরে অপরূপা
দেবীকে কাছে পেয়ে তাঁর নাম দিলেন মহাগৌরী-শুধু গৌরী নন।
আরেকটি মত আছে-শিব নিজেই
সেই কৃষ্ণবর্ণা তপস্বিনীর বরতনু গঙ্গাজল দিয়ে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে তাঁকেই
বিদ্যুৎবর্ণা মহাগৌরী করে তোলেন।
৩>দেবী কাত্যায়নীঃ
____________________
‘কাত্যায়নীং দশভুজাং
মহিষাসুরঘাতিনীং নমামি বরদাং দেবীং সর্বদেবনমস্কৃতাম্।’ এই দেবী কাত্যায়নীর উদ্ভব হিমালয়ে কাত্যায়ন ঋষির আশ্রমে।
ঋষি কাত্যায়ন কাত্য গোত্রে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি কঠোর তপস্যা
করেছিলেন দেবী অম্বিকাকে তাঁর কন্যা হিসাবে পাওয়ার জন্য। দেবী তাঁর তপস্যায়
প্রসন্না হয়ে সেই প্রার্থনা স্বীকার করে বলেছিলেন, দেবতাদের প্রয়োজনে আমি তোমার তপোবনে আবির্ভূত হয়ে তোমার
সেবা গ্রহণ করব।
এরপরে দৈত্যরাজ
মহিষাসুরের অত্যাচারে দেবতারা কাতর হয়ে একত্রে মহাশক্তির আরাধনা করবার সময়
তাঁদের ক্রোধসঞ্জাত তাপ ও তেজ একত্রিত হয়ে এক অপরূপা দেবীমূর্তির সৃষ্টি হয়েছিল।
দেবীকে দেবতারা নিজেদের অস্ত্র থেকে অস্ত্রাদি দিয়ে ও নানা বসনভূষণে সাজিয়ে
দিয়ে তাঁর কাছে মহিষাসুর বধের জন্য প্রার্থনা জানান। সেই দেবীর সৃষ্টি হয়েছিল
হিমালয়ের কাত্যায়ন ঋষির আশ্রমে দেবী কাত্যায়নকে দেওয়া তাঁর কথা রাখলেন ভাদ্র
কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীর দিন কাত্যায়নাশ্রমে এই দেবী প্রকট হন। তারপর সপ্তমী,অষ্টমী ও নবমীর তিনদিন এই আশ্রমে থেকে কাত্যায়নের পূজা
গ্রহণ করেন। অষ্টমী-নবমীর সন্ধিতে তিনি চণ্ডমুণ্ডকে চামুণ্ডামূর্তিতে বধ করেন। আর
দশমীর দিন তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে মহিষাসুরকে বধ করেন। এই কারণেই দেবীর একটি নাম
হয় কাত্যায়নী। কাত্যায়নপূজিতা দেবী এই নামে তিনি খ্যাত হন।
কাত্যায়নী দেবীর
মাহাত্ম্য দ্বাপরের কিছু ঘটনাতেও জানা যায়। দক্ষযজ্ঞে সতীর দেহত্যাগের পর তাঁর
দেহ শিবের কাঁধ থেকে বিষ্ণুচক্রে খণ্ডিত হয়ে যখন ভারতের একান্নটি স্থানে পড়ে
একান্নপীঠ হলো-তখন সেই পীঠগুলিও বিভিন্ন নামে দেবী ভগবতীর মূর্তি জ্ঞানে মর্তের
ভক্তদের উপাসনাস্থল হিসাবে পূজিত হতে লাগল। এই রকম একটি পীঠ হলো ব্রজধামে
বৃন্দাবনে,যেখানে দেবীর কেশগুচ্ছ
পড়েছিল। তাঁর সেই কুঞ্চিত দিব্য কেশপাশ প্রস্তরীভূত হয়ে আজও বিরাজিত। সেখানে
তাঁর নাম কাত্যায়নী।‘ব্রজে কাত্যায়নী পরা।’
বৃন্দাবনের গোপী-গোপেরা ছিলেন শাক্ত। তাঁদের
আরাধ্য দেবী ছিলেন এই কাত্যায়নী। প্রতিটি উত্সবপর্ব ঘিরে ছিল এই কাত্যায়নী
দেবীকে নিয়ে। ব্রজের কুমারী গোপিনীরা এই কাত্যায়নী দেবীর কাছেই তাঁদের প্রাণধন
নন্দ নন্দনকে পতি হিসাবে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল প্রার্থনা জানিয়ে ব্রত উপবাস পূজা
করতেন। তাঁদের পূজার মন্ত্র ছিল,“কাত্যায়নী
মহামায়ে মহাযোগিন্যধীশ্বরী/নন্দগোপসুতং দেবি পতিং মে কুরুতে নমঃ।” এই মন্ত্র ও কাহিনী শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্দে আছে। এই
সিদ্ধমন্ত্র দেবী কাত্যায়নীর পূজায় উচ্চারিত হওয়ার ফলও ব্রজবিলাসিনীরা
পেয়েছিলেন। দেবীর কৃপায় তাঁদের কৃষ্ণপ্রাপ্তি পরাভক্তি লাভ হয়েছিল। দেবী
কাত্যায়নী সুখদা-মোক্ষদা। কৃষ্ণপ্রাপ্তিরূপ পরমানন্দ, মোক্ষ তাঁদের লাভ হয়েছিল। সত্যযুগে দেবতাদের অসুরদের হাত
থেকে রক্ষা করে তাঁদের ভোগ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আর দ্বাপরে ঐকান্তিক ভক্তদের
পূজায় প্রসন্না হয়ে তাঁদের নিঃশ্রেয়স্ বা পরমপ্রেমের আস্বাদন করিয়ে কৃতার্থ
করেছিলেন।
৪>দেবী স্কন্দমাতাঃ
________________
এই সনত্কুমার বা স্কন্দ
হচ্ছেন কার্ত্তিক। পার্বতীর পুত্ররূপেই স্কন্দের পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
৫>দেবী চন্দ্রঘন্টাঃ
___________________
রম্ভাসুরের ছেলে মহিষাসুর
যখর প্রচণ্ড বিক্রমে দেবতাদের হারিয়ে দিয়ে স্বর্গরাজ্য দখল করেছিল, তখন দেবতারা একত্রিত হয়ে তাঁদের নেতা
ব্রহ্ম-বিষ্ণু-মহেশ্বরের শরণাপন্ন হলে সেই তিন দেবতা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। তখন
তাঁদের শরীর থেকে তেজ বাইরে এসে এক জায়গায় পুঞ্জীভূত হতে লাগলো। ক্রমে অনান্য
দেবতারাও উত্সাহিত হয়ে নিজের নিজের শরীর থেকে তেজরাশি বাইরে এনে ঐ তেজকে সমৃদ্ধ
করলেন। ফলে দেবতাদের দেহসঞ্জাত তেজ থেকে সৃষ্টি হলো এক অতুলনীয়া দেবীমূর্তির।
ইনিই আদিশক্তি।সকল দেবতাদের অন্তরের শক্তিরূপেই তিনি তাদের ভেতরে ছিলেন।তাঁরই
শক্তিতে এইসব দেবতারা শক্তিমান ছিলেন। আজ বিপদাপন্ন হয়ে সেই শক্তিকে বাইরে এনে
তাকে দেওয়া হল ঐশী শক্তির দেবীমূর্তি। নানা দেবতার শক্তিতে শক্তিমতী সেই দেবীকে
দেখে আহ্লদিত দেবতারা তাঁদের নিজের নিজের অস্ত্রাদি থেকে নূতন অস্ত্র সৃষ্টি করে
দেবীর করকমলে সেগুলি ধরিয়ে দিলেন। তাঁকে নানা অলংকার বস্ত্রাদিও তাঁরা দিলেন-মনের
মত করে নানা দ্রব্যসম্ভারে তাঁকে সাজিয়ে তাঁর বন্দনা করে প্রার্থনা জানালেন-মা
আমাদের সমূহ বিপদ। অসুর মহিষরাজের হাত থেকে তুমি আমাদের রক্ষা কর, স্বর্গরাজ্য আমাদের ফিরিয়ে দাও।
তাঁকে নানা
অস্ত্র-শস্ত্রাদি যখন সব দেবতারা দিচ্ছিলেন, তখন দেবরাজ ইন্দ্র, “দদৌ তস্যৈ সহস্রাক্ষোঘণ্টাম ঐরাবতং গজাৎ” তাঁর বাহন ঐরাবৎ হাতির গলায় ঘণ্টা থেকে একটি ঘণ্টা নিয়ে
দেবীর একটি হাতে দিলেন। ঘণ্টা সর্ববাদ্যময়ী।যুদ্ধ উত্সবে প্রাচীনকালে ,এমনকি এখনও নানা বাদ্যাদি বাজানো হয়। যাকে মিলিটারী
ব্যান্ড বলে। দেবীর সেই যুদ্ধে এই ঘণ্টা সেই রকম একটি বাদ্য ও বাজনা। তবে এটি
দৈবশক্তিসম্পন্ন। এই ঘণ্টানাদ বিকট শব্দ সৃষ্টি করেছিল “হিরস্তি দৈত্য তেজাংসি স্বনেনাপূর্য্য যা জগৎ”। সেই ঘণ্টার শব্দেই দৈত্যদের প্রাণ ভয়ে খাঁচাছাড়া অবস্থা হয়েছিল। তাদের তেজ
হরণ করবার জন্য দেবী সেই প্রচণ্ড শব্দের ঘণ্টাবাজিয়েছিলেন। তাই যুদ্ধের পরে
দেবতারা মায়ের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন,মা তোমার ঐ যে ঘণ্টা অসুরদের তেজ হরণ করেছিল সেই ঘণ্টার আমরাও শরণ নিচ্ছি,
আমাদের পাপকে সেই ঘণ্টা যেন হরণ করে নেয়। “সা ঘণ্টা পাতু নো দেবি পাপেভ্যো নঃ সুতাম্ইব ”। এই জন্য দেবীর একটি নাম চণ্ডঘণ্টা-যিনি প্রচণ্ড শক্তিসম্পন্ন আওয়াজ
সৃষ্টিকারী ঘন্টা ধারণ করে আছেন,তিনি চণ্ডঘণ্টা।
৬>দেবী ব্রহ্মচারিণীঃ
___________________
দেবী শিবকে পতি হিসাবে
পাওয়ার জন্য হিমালয়ে যখন কঠোর তপস্যা করেছিলেন,তখনকার তপস্বিনী মূর্তি এটি। ব্রহ্ম শব্দের একটি অর্থ
তপস্যা। তপের বা তপস্যার আচরণকারিণী তাই ব্রহ্মচারিণী। বলা হয় “বেদস্তত্বং তপব্রহ্ম"বেদ, তত্ত্ব আর তপ ব্রহ্মের অর্থ। ব্রহ্মতত্ত্ব চিন্তাময়ী,
তপস্বরূপিনী দেবী অম্বিকা পার্বতীর এই তপোময়ী
মূর্তিই ব্রহ্মচারিণীর স্বরূপ। ঐ কল্পে শিবকে পতি হিসাবে পাওয়ার জন্য তিনি
আহার-নিদ্রা সংযম করে কঠোর তপস্যা করেছিলেন। এমনকি গলিত পত্রও তিনি গ্রহণ করেননি
আহার্য হিসাবে। তাই তখন তাঁর নাম হয়েছিল অপর্ণা। তাঁর এত কঠোর তপস্যা দেখে মাতা
মেনকা মিনতি করে বলেছিলেন-‘উ-মা’,আর নয় মা,এতো কষ্ট কোরো
না। তখন তার প্রসন্ন হয়ে চন্দ্রমৌলিশ্বর মহাদেব প্রথমে মদন ভস্ম করেন, তারপর তার চিরসঙ্গিনী দেবী পার্বতীকে পত্নীত্বে বরণ করেন।
দেবী পার্বতীর সেই হিমালয়ের ব্রহ্মচর্যব্রতধারিণী বিগ্রহের স্মরণে এই নবদুর্গার
দ্বিতীয়ায় নাম হয়েছে ব্রহ্মচারিণী।
৭>দেবী কালরাত্রীঃ
________________________
এরপরে কালরাত্রি।
মহারাত্রিতে জগতের বিলয়। তখন স্রষ্টা মাত্র জাগ্রত আর সব নিদ্রা-ভিভূত। আর
কালরাত্রিতে স্রষ্টাও নিদ্রামগ্ন-যোগনিদ্রামগ্ন। শুধুমাত্র জেগে থাকেন আদ্যাশক্তি
সৃষ্টির বীজ পুঁটুলি বেঁধে, এই যোগনিদ্রাই
কালরাত্রি। সমগ্র পৃথিবীকে, পৃথিবীর সমস্ত
জীবজন্তুকে ও বিশ্বনাথকেও যিনি নিদ্রায় আচ্ছন্ন করেন তিনিই কালরাত্রি। তিনি
কালেরও কলনকর্ত্রী। প্রণীমাত্রকে গ্রাস, কলন করেন বলে শিব মহাকাল, আর মহাপ্রলয়ে এই
মহাকালও মহাপ্রকৃতিতে লীন হয়ে যান। মহানিদ্রাচ্ছন্ন হন। ‘কালসংগ্রসনাৎ কালী’। তন্ত্রমন্ত্রে শিব আদি
পুরুষ আদি প্রকৃতি দেবী ভগবতী আদ্যাশক্তি, তিনি শিবেরও নিয়স্ত্রী। “সৈব মায়া
প্রকৃতির্যা সংমোহয়তি শংকরম।” তিনি সবকিছু
সংহরণ করেন, সম্মোহিত করেন, নিদ্র্রাভিভূত করেন। তাঁর মায়া প্রভাবে ত্রিভূবন আচ্ছন্ন
হয়ে যায়। তিনি গ্রাস করেন। সব সৃষ্টির বীজ তিনি নিজের শরীরে ধারণ করে পরবর্তী
কল্পের পূর্ব পর্যন্ত নিরাকার তামসী জ্ঞানেচ্ছা-ক্রিয়াময়ী অখণ্ড এক সত্তারূপে
বিরাজ করেন, ইনিই কালরাত্রি। “ত্বং কর্ত্রী কারয়িত্রী করণ-গুণময়ী কর্মহেতু স্বরূপা”
এই অব্যাকৃতা-মহামায়াই জগতের আদিকারণ
ব্রহ্মময়ী ‘পরব্রহ্মের পট্টমহিষী’।
এখানে যে কালরাত্রি তিনি
দেবী মহাকালী বলেই পূজিতা কালী কৃষ্ণবর্ণা ঘোরা। সাদা-লাল-হলুদ সব রংই কালো রং-এ
মিশে যায়। মিশে এক কালো হয়ে যায়। সেই রকম বহু বিচিত্র বর্ণবিভূষিত এই জগৎ এক
কারণরূপিণীকালো মায়ের শরীরে লীন হয়ে যায় তাই সর্ববর্ণময়ী মা আমার কালো।
নির্গুণা, গুণাতীত, নিরাকার মা, সবকিছু তাঁর
মধ্যে টেনে নিয়ে এক করে দেন তাই তিনি কালো। তাঁর ললাটে চন্দ্রকলা। তিনি নিত্যা।
চির অমৃতের আধার, অমৃতের প্রতীক চন্দ্র তাই
তাঁর শিরে শোভমান। ত্রিনেত্রা তিনি ত্রিলোক দর্শন করেছেন, সদা জাগ্রতা, রক্ষা করেছেন, চন্দ্র-সূর্য-অগ্নি তাঁর
নেত্র, জীবকে সর্বদা সর্বোতভাবে
পালন করছেন তাঁর ত্রিনেত্রে।
রুধিরাক্ত ওষ্ঠদ্বয় সদা
দন্তপংক্তিতে চেপে রেখেছেন। লাল রক্ত রজোগুণের, আর সাদা দাঁত সত্ত্বগুণের প্রতীক। সত্ত্বগুণ দিয়ে রজোগুণকে
অুভিভূত করে রেখেছেন।
তাঁর খড়্গ জ্ঞান অসি।
মুণ্ডমালা ও করধৃত মুণ্ড কৃপায় সন্তানের শরীরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকা ও সৃষ্টির বীজ
বহন করা। বরাভয় করদ্বয় সন্তানের জন্য সদামঙ্গলময়ী মায়ের কৃপা করুণার, প্রসন্নতার প্রতীক। ভীষণা হলেও, রুদ্রাণী হলেও কাতর সন্তান পাছে মায়ের ঐ মূর্তি দেখে ভয়
পেয়ে দূরে সরে যায়-তাই অভয়া বরদা বলেছেন, ‘ভয় নেই, কাছে আয়,
তোর যা চাই তাই তুই পাবি। শুধু নির্ভয় হয়ে
একান্তে সবকিছু ছেড়ে একবার আমার কছে আয়।’ শরণাগত সন্তানের প্রতি অসীম করুণায় মায়ের এ চিরন্তন
আশ্বাসবাণী। সমগ্র বিশ্বের কর্ত্রী, পালয়িত্রী, সংহন্ত্রী তিনি, তাই বিশ্বনাথও তাঁর চরণতলে।
৮>দেবী সিদ্ধিদাত্রীঃ
__________________
মার্কণ্ডেয় পুরাণ,
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ ইত্যাদিতে অণিমা-লঘিমা
ইত্যাদি এবং সর্বজ্ঞত্ত্ব-দূরদর্শন-দূরশ্রবণ-পরকায়প্রবেশ এই সব যোগবিভূতি বা
সিদ্ধির কথা আছে। এমন অনেক সাধক আছেন যাঁরা ভগবত্শক্তির আরাধনা করেন এই সব
যোগসিদ্ধির জন্যই। যথাশাস্ত্র সাধন করলে সাধক এই সব দুর্লভ সিদ্ধির অধিকারীও হতে
পারেন। তবে এই ছোট্ট ‘তবে’ আছে। এই সিদ্ধিই মায়ের দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই
সিদ্ধির প্রলোভন বা মোহ সহজ নয়। এতেই আটকে গেলে মায়ের দরজা আর সে ভক্ত খোলা পায়
না। এগুলোকে যোগশাস্ত্রে সাধন বিঘ্ন বলা হয়েছে। লোককে আকৃষ্ট করবার জন্য নানা
জনমনোহারিণীশক্তি সাধকের থাকতে পারে, সেও এ মা সিদ্ধিদাত্রীর কৃপায়। অবশ্য ঠিক ঠিক বলতে গেলে এটা তাঁর ‘মায়ায়’ বলাই ভাল। দেবী
সিদ্ধিদাত্রী অবোধ সন্তানকে ভুলিয়ে রেখেছেন তাকে ছেলেখেলা দিয়ে, তার মুখে রঙিন চুষিকাঠি দিয়ে নিজে দূরে সরে রয়েছেন। সাধ্য
বস্তু ভুলিয়ে দেয় এই পার্থিব সিদ্ধির মোহ। দেবী সিদ্ধিদাত্রীর এও এক লীলা! যে
তাঁকে চায় সে তাঁকে পায়, যে তাঁকে না চায়
তাকে পঞ্চভূতে নাচায়”। আর এই পঞ্চভূতের ফাঁদে পড়ে কত ‘ব্রহ্মা বিষ্ণু খাচ্ছে খাবি’। সাধারণ মানুষ এই
সিদ্ধিকে দেখেই সিদ্ধকে বিচার করে সে কত উঁচু সাধক। মা সিদ্ধিদাত্রীর দেওয়া ঐ
জাগতিক বাসনা-কামনা ও উচ্চাভিলাষ প্রার্থনা না করে তাঁর কাছে চাইতে হয় সেই চরম ও
পরম বস্তু। আত্মজ্ঞান-পরাভক্তি। সর্বকামাবসায়িতা।
অসুর-যক্ষ-গন্ধর্ব-দেবতা-ঋষি-নর
সকলেই এই পদ্মাসীনা স্বর্ণবর্ণা রক্তবস্ত্রধারিণী চতুর্ভুজা দেবীর করুণাঘন দৃষ্টির
সামনে নতজানু হয়ে জানায় যার যার মনের কামনা। সিদ্ধিদাত্রী দেবীর কাছে যার যেমন
যোগ্যতা যেমন আধার সে তাই চায়। গীতাতে যেমন ভগবান বলেছেন-‘যে যথা মাংপ্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্’ যে আমাকে যেমন ভাবে চায় আমি তাকে সেইভাবে পরিতৃপ্ত করি।
জননী সিদ্ধিদাত্রীও তাই। সন্তানের খিদে না মিটলে তাকে জোর করে অন্য কিছু দেওয়া
যাবে না। তাই তিনি জীবকে ভোগও দান করেন মোক্ষও দান করেন। মহাভারতের যুদ্ধের আগে
শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে দেবী ভগবতীর কাছে জয়ের জন্য,সিদ্ধির জন্য প্রার্থনা করতে বলেছিলেন। রামায়ণে ব্রক্ষা
রামচন্দ্রকে অকাল বোধনে দেবী ভগবতীর পূজা করিয়ে রাবণবধের সিদ্ধি প্রার্থনা
করিয়েছিলেন। সমস্ত মার্কণ্ডের পুরাণে বিপর্যস্ত পরাজিত দেবতারা যুদ্ধজয়রূপ
সিদ্ধির জন্য মায়ের বন্দনা করেছেন। দেবী জগদ্ধাত্রী করুণাময়ী জননীও আর্ত
সন্তানের আর্তিতে ব্যাকুলতায় প্রকট হয়ে সেই সংগ্রামে তাঁদের সিদ্ধ করেছেন,
আবার অনেক সাধক ব্যক্তি-জীবনের নানারিপুর
সংগ্রামে আর্ত ব্যথিত হয়ে দেবীর শরণ নিয়ে ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা জানায় দেবী
যেন সেই সাধকের সামনে থেকে তাঁর মায়াজাল সরিয়ে নিয়ে তাকে তাঁর স্বরূপ দর্শন করিয়ে
সিদ্ধ করেন। সুতরাং এ জগতে সকল প্রকার জীবই জীবনের অভ্যুদয় ও নিঃশ্রেয়সের জন্য
এই জগদম্বা জগজ্জননী সিদ্ধিদাত্রীর কৃপাপ্রার্থী। সে জেনে হোক বা না জেনে হোক।
অর্থাৎ জীবের সকল কর্মের সর্বপ্রকার সিদ্ধি বা জয় যিনি দান করেন-তিনিই
সিদ্ধিদাত্রী। বুদ্ধিমান জ্ঞানী সাধকের তাই তাঁর চরণে আকুল প্রার্থনা: মা, কৃপা করে সিদ্ধিদার উন্মোচন করো, যাতে তোমার কৃপায় তোমার মায়ের আবরণ সরিয়ে তোমার-আমার
স্বরূপ আমি উপলব্ধি করতে পারি। মানুষ জীবন যেন সার্থক হয়। মা কিছুই জানি না,
একমাত্র তোমার কৃপাই সম্বল আমার”
৯>দেবী কুষ্মাণ্ডা:
___________________
তন্ত্রে দেবী প্রসঙ্গে
একটি শ্লোকও আছে- “সুরাসর্ম্প্ণ কলসং
রুধিরাপ্লুতমেব চ। দধানাহস্তপদ্মাভ্যাং কুষ্মাণ্ডা শুভদা¯ত্ত মে।।” যদিও তার সঙ্গে
এই দেবীর শরীরের সবটা মেলে না। তবে দেবীর নামের অর্থটি খুব সুন্দর ব্যাখ্যা করলেন।
‘উষ্মা’ শব্দের মানে তাপ। ‘কু’ মানে কুৎসিত-কষ্টদায়ক তাপ হচ্ছে ‘ত্রিতাপ’। আধিভৌতিক - আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক এই ত্রিতাপই জীবের দুঃখের
কারণ। সর্বপ্রকার বন্ধনের কারণ ত্রিতাপ। জীব সদা জর্জরিত এই ত্রিতাপে। এর হাত থেকে
নিষ্কৃতি লাভই জীবের চরমকাম্য। এই ত্রিতাপ ‘কুষ্মা’ যিনি উদরে ধারণ
করেন গ্রাস করেন, তিনিই কুষ্মাণ্ডা।
সন্তানকে রক্ষা করতে জননী তার সমস্ত দুঃখ নিজে হরণ করেন। যেমন মহাদেব সমুদ্র
মন্থনের সময় সমস্ত হলাহল পান করে নীলকণ্ঠ হয়েছেন, তেমনি জগজ্জননী দুর্গা আদ্যাশক্তি জগতের সর্বপ্রকার
জ্বালা-যন্ত্রণার হাত থেকে সন্তানদের সর্বদা রক্ষা করতে করুণায় দ্রবীভূত হয়ে
স্বেচ্ছায় সব তাপ নিজের শরীরে গ্রহণ করেন। দূরিতবারিণী-‘ত্রিতাপহারিণী’ মায়ের নাম তাই কুষ্মাণ্ডা।
কিন্তু এখানে দেবী দুর্গা
বলেই তাঁর বিশেষ খ্যাতি। কুষ্মাণ্ডা বলে তাঁর পরিচিত শুধুমাত্র বছরের দু দিন। শরৎ
ও বসন্তের শুক্লা চতুর্থীর দিন। এই দেবী দুর্গা কাশীর দক্ষিণ দিকের রক্ষয়িত্রী।