জয় রায়
ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের এই সূর্য মন্দিরকে অপূর্ব স্থাপত্যশৈলী ও সমৃদ্ধ ইতিহাসের জন্য ইউনেসকো বিশ্ব সভ্যতার একটি উত্তরাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে । উড়িষ্যায় পুরী ও ভুবনেশ্বরের কাছে বঙ্গোপসাগরের বেলাভূমিতে ১৩ শ শতকে পূর্ব-গঙ্গা রাজ্যের অধিপতি মহারাজ নরসিংহ দেব সূর্য দেবতার আরাধনার জন্য এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন ।এই মন্দির তার অভিনব আকার,বিশালত্ব আর কারুকার্যের জন্য ভারতের সপ্তমাশ্চর্যের অন্যতম । তামিল শব্দ কোণ আর সংস্কৃত শব্দ অর্ক মিলে কোনার্ক শব্দটির সৃষ্টি । উড়িষ্যা ও দ্রাবিড় স্থাপত্যরীতির সংমিশ্রণে নির্মিত মন্দিরটি ধূসর বেলে পাথরে বিশাল একটি রথের আকারে গড়া হয়েছে । সমুদ্র থেকে উঠে আসা সূর্যদেবের বিশাল রথ,তার সামনে রয়েছে সাত জোড়া ঘোড়া । বারো জোড়া বিশাল চাকার ওপর পুরো মন্দিরটি নির্মিত ।চাকার কারুকার্য দর্শকদের জন্য একটি প্রধান আকর্ষণ । প্রতিটি চাকা একেকটি সূর্যঘড়ি ।চাকার ভেতরের দাঁড়গুলো সূর্যঘড়ির সময়ের কাঁটা। এখনো নিখুঁতভাবে সময় জানা যায় এই সূর্যঘড়ির সাহায্যে ।মন্দিরের প্রবেশ পথেই রয়েছে বিশাল দুটি সিংহের মূর্তি যারা লড়াই করছে দুটি রণহস্তীর সঙ্গে ।
মন্দিরের বেদী থেকে শুরু করে চূড়া পর্যন্ত প্রতি ইঞ্চি জায়গায় পাথরের ভাস্কর্য ও কারুকার্য রয়েছে । দেবতা,অপ্সরা,কিন্নর,যক্ষ,গন্ধর্ব,নাগ,মানুষ,বিভিন্ন প্রাণী,পৌরাণিক বিভিন্ন ঘটনার প্রতিরূপ,নৃত্যরত নরনারী,প্রেমিক যুগল,রাজদরবারের বিভিন্ন দৃশ্য,শিকারের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পাথরের বুকে ।মূর্তিগুলোর মানবিক আবেদন,নিখুঁত গড়ন,লীলায়িত ভঙ্গী শিল্পকলার চরম উত্কর্ষের নিদর্শন । মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ৮৫৭ ফুট ।তবে মন্দিরের অনেক অংশ এখন বালিতে দেবে গেছে । মন্দিরের দেউল এখনো ২০০ ফুট উঁচু। মন্দিরে সূর্যদেবতার যে বিশাল বিগ্রহ ছিল তা এখন নেই ।
কালের করাল গ্রাসে স্থাপনার অনেকটাই আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত ।কথিত আছে যে বাংলার সুলতান সুলেমান খান কারানির সেনাপতি কালাপাহাড়ের আক্রমণে কোনার্ক মন্দির প্রথম ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ।উড়িষ্যার ইতিহাস অনুযায়ী কালাপাহাড় ১৫০৮ সালে কোনার্ক আক্রমণ করে ।
১৬২৬ সালে খুরদার তত্কালীন রাজা পুরুষোত্তম দেবের পুত্র নরশিমা দেব সূর্যদেবের বিগ্রহটি পুরীর জগন্নাথের মন্দিরে নিয়ে যান । সেখানে একটি পৃথক মন্দিরে সূর্য ও চন্দ্র দেবতার বিগ্রহ স্থাপন করা হয় । শুধু বিগ্রহই নয় তিনি কোনার্ক মন্দির থেকে কারুকার্য করা অনেক পাথর পুরীর মন্দিরে নিয়ে যান। এমনকি নবগ্রহ পথ নামে একটি বিশাল প্রস্তর খন্ডও তিনি পুরীতে নিয়ে যান । মারাঠা শাসনামলে কোনার্ক মন্দির থেকে অনেক ভাস্কর্য ও প্রস্তরখন্ড পুরীতে নিয়ে যাওয়া হয় । ১৭৭৯ সালে কোনার্ক থেকে অরুণ কুম্ভ নামে বিশাল একটি স্তম্ভ নিয়ে পুরীর সিংহদ্বারের সামনে স্থাপন করা হয় । এই সময় মারাঠা প্রশাসন কোনার্কের নাট মন্ডপটি অপ্রয়োজনীয় মনে করে ভেঙ্গে ফেলে ।
সূর্যদেবের বিগ্রহ অপসারণের পর কোনার্কে পূজা ও আরতি বন্ধ হয়ে যায় । পর্তুগীজ জলদস্যুদের ক্রমাগত আক্রমণের ফলে কোনার্ক বন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয় । আঠারশ' শতক নাগাদ কোনার্ক মন্দির তার সকল গৌরব হারিয়ে পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে ।মন্দিরের অনেক অংশ বালির নিচে চাপা পড়ে যায় ।মন্দির চত্বর ও এর আশেপাশের এলাকা ধীরে ধীরে ঘন অরণ্যে ছেয়ে যায় ।বুনো জন্তুরা বাসা বাঁধে মন্দিরের ভিতর । জলদস্যু ও ডাকাতের আস্তানায় পরিণত হয় কোনার্ক মন্দির । সেসময় দিনের আলোতেও সাধারণ মানুষ ভয়ে এর ত্রিসীমানায় যেত না । পরবর্তীতে বিংশ শতাব্দীতে প্রত্নতত্ববিদরা কোনার্ক মন্দির পুনরাবিষ্কার করেন ।খননের ফলে লোকচক্ষুর সামনে উন্মোচিত হয়। কোনার্ক মন্দিরের অপূর্ব স্থাপত্য শৈলী,বিষ্ময়কর ভাস্কর্যকীর্তি ও অনন্য শিল্প সম্ভার । কোনার্ক মন্দিরের অনেক শিল্প কীর্তি এখন সূর্য মন্দির জাদুঘর ও উড়িষ্যার জাতীয় জাদুঘরে রয়েছে । বর্তমানে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী কোনার্কের সূর্য মন্দির দেখতে আসেন।
No comments:
Post a Comment