সুইজারল্যান্ডের ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চের (সার্ন) গবেষকেরা ৪ জুলাই ঈশ্বর কণা বা হিগস-বোসন কণার অনুরূপ একটি কণার আবিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছেন। এ কণার আবিষ্কারের উত্ফুল্ল বিজ্ঞানীরা স্মরণ করতেই ভুলে গেছেন বোসন কণা যাঁর নাম অনুসারে রাখা হয়েছিল, সেই বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে।
এক খবরে টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে কেবল ১৯৬০ সালে হিগস-বোসন কণার ধারণার প্রবর্তক পিটার হিগসকে নিয়েই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হচ্ছে। কিন্তু সেখানে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বা উপেক্ষা করা হয়েছে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অবদানকে।
বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর (১ জানুয়ারি ১৮৯৪—৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪) গবেষণার ক্ষেত্র ছিল গাণিতিক পদার্থবিদ্যা। তিনি আলবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে যৌথভাবে ১৯২০ সালে বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান প্রদান করেন, যা পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বলে বিবেচিত।
সত্যেন্দ্রনাথ বসু বা সত্যেন বোসের এ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবেই কণার নামকরণ হয়েছিল ‘বোসন’ কণার। তিনি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার দাবিদারও ছিলেন। টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, বিজ্ঞানের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘোষণা সত্ত্বেও সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাম আলোচনায় নেই। এমনকি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোও এ বিষয়ে নীরব।
এ প্রসঙ্গে ভারতের সেন্টার ফল সেলুলার অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক পি এম বারগাভা জানিয়েছেন, ‘আমি মনে করি এটা চরম উপেক্ষা। শুধু প্রথমবার এ ঘটনা ঘটল বিষয়টি এমন নয়।’
ভারতের সায়েন্টিফিক অ্যাডভাইজরি কাউন্সিলের প্রধান সি এন আর রাও জানিয়েছেন, ‘ঐতিহাসিকভাবেই সত্যেন্দ্রনাথ বসু ভারত ও বিশ্বে উপেক্ষিত হয়ে আসছেন। তার কারণ, তিনি আপস করতেন না। আমার মনে আছে, তিনি জহরলাল নেহরুর সঙ্গেও কোনো একটি বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করেছিলেন। তিনি যদি যুক্তরাষ্ট্র বা বাইরের কোনো দেশের হতেন, তবে তিনি অবশ্যই আরও বেশি জনপ্রিয় হতে পারতেন।’
১৮৯৪ সালের ১ জানুয়ারি উত্তর কলকাতার জন্মগ্রহণ করেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। ১৯১৩ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্নাতক হন এবং ১৯১৫ গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপরই তিনি কলকাতায় শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত হন। বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার সঙ্গে পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতে গবেষণাও শুরু করেন তিনি। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে রিডার হিসেবে যোগ দেন। ১৯২৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা কালে তিনি ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে কাজ শুরু করেন। বিজ্ঞানী বসু 'Max Planck's Law এবং Light Quantum Hypothesis' এর উপর একটি নিবন্ধন লিখেন এবং পরে তিনি তা জার্মান বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের কাছে পাঠান । বিজ্ঞানী আইনস্টাইন এটা পরে এতই উচ্ছসিত হনযে তিনি পরবর্তিতে এটিকে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন এবং জার্মানির বিখ্যাত গবেষণাধর্মী জার্নাল 'Zeitschrift fur Physik' তে প্রকাশ করেন । প্রকাশিত 'হাইপোথিসিস' টি বিজ্ঞানীদের দ্বারা উচ্ছসিত প্রশংসা লাভ করে যা পরবর্তিতে পরিণত হয় বিখ্যাত 'বোস-আইনস্টাইন তত্ত্ব' হিসেবে । ১৯২৭ সালে তিনি আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ছিলেন তিনি। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেছেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন।
সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার একটি ছাত্র হল-এর নামকরণের জন্য সত্যেন বোসের নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল। বলাবাহুল্য, তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলো স্থাপনার নাম অবৈজ্ঞানিক ব্যক্তিদের নাম; বিশেষত, সুফী সাধকদের নামে । মোটামুটি এই একটি প্রবণতা থেকে বোঝা যায়, আমাদের কাছে কারা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশিদের দোষ দেওয়ার আগে একটু নিজেদের ছুরোতখানার দিকে তাকানো দরকার!
No comments:
Post a Comment