Pages

Wednesday, August 1, 2012

ব্রাহ্মণ


ব্রাহ্মণ 

অরুন চন্দ্র মজুমদার


রবিঠাকুরের কবিতার অংশ থেকে থেকেঃ-

মহর্ষি গৌতম
কহিলেন, "বৎসগণ, ব্রহ্মবিদ্যা কহি,
করো অবধান'

হেনকালে অর্ঘ্য বহি
করপুট ভরি' পশিলা প্রাঙ্গণতলে
তরুণ বালক; বন্দী ফলফুলদলে
ঋষির চরণপদ্ম, নমি ভক্তিভরে
কহিলা কোকিলকণ্ঠে সুধাস্নিগ্ধস্বরে,
"
ভগবন্‌, ব্রহ্মবিদ্যাশিক্ষা-অভিলাষী
আসিয়াছে দীক্ষাতরে কুশক্ষেত্রবাসী,
সত্যকাম নাম মোর'

শুনি স্মিতহাসে
ব্রহ্মর্ষি কহিলা তারে স্নেহশান্ত ভাষে,
"
কুশল হউক সৌম্যগোত্র কী তোমার?
বৎস, শুধু ব্রাহ্মণের কাছে অধিকার
ব্রহ্মবিদ্যালাভে'

বালক কহিলা ধীরে,
"
ভগবন্‌, গোত্র নাহি জানিজননীরে
শুধায়ে আসিব কল্য, করো অনুমতি'

এত কহি ঋষিপদে করিয়া প্রণতি
গেল চলি সত্যকাম ঘন-অন্ধকার
বনবীথি দিয়া, পদব্রজে হয়ে পার
ক্ষীন স্বচ্ছ শান্ত সরস্বতী; বালুতীরে
সুপ্তিমৌন গ্রামপ্রান্তে জননীকুটিরে
করিলা প্রবেশ

ঘরে সন্ধ্যাদীপ জ্বালা;
দাঁড়ায়ে দুয়ার ধরি জননী জবালা
পুত্রপথ চাহি; হেরি তারে বক্ষে টানি
আঘ্রাণ করিয়া শির কহিলেন বাণী
কল্যাণকুশলশুধাইলা সত্যকাম,
"
কহো গো জননী, মোর পিতার কী নাম,
কী বংশে জনমগিয়াছিনু দীক্ষাতরে
গৌতমের কাছে, গুরু কহিলেন মোরে--
বৎস, শুধু ব্রাহ্মণের কাছে অধিকার
ব্রহ্মবিদ্যালাভেমাতঃ, কী গোত্র আমার?'
শুনি কথা, মৃদুকণ্ঠে অবনতমুখে
কহিলা জননী, "যৌবনে দারিদ্রদুখে
বহুপরিচর্যা করি পেয়েছিনু তোরে,
জন্মেছিস ভর্তৃহীনা জবালার ক্রোড়ে,
গোত্র তব নাহি জানি তাত'

পরদিন
তপোবনতরুশিরে প্রসন্ন নবীন
জাগিল প্রভাতযত তাপসবালক
শিশিরসুস্নিগ্ধ যেন তরুণ আলোক,
ভক্ত-অশ্রু-ধৌত যেন নব পুণ্যচ্ছটা,
প্রাতঃস্নাত স্নিগ্ধচ্ছবি আর্দ্রসিক্তজটা,
শুচিশোভা সৌম্যমূর্তি সমুজ্জ্বলকায়ে
বসেছে বেষ্টন করি বৃদ্ধ বটচ্ছায়ে
গুরু গৌতমেরেবিহঙ্গকাকলিগান,
মধুপগুঞ্জনগীতি, জলকলতান,
তারি সাথে উঠিতেছে গম্ভীর মধুর
বিচিত্র তরুণ কণ্ঠে সম্মিলিত সুর
শান্ত সামগীতি

হেনকালে সত্যকাম
কাছে আসি ঋষিপদে করিলা প্রণাম--
মেলিয়া উদার আঁখি রহিলা নীরবে
আচার্য আশিষ করি শুধাইলা তবে,
"
কী গোত্র তোমার সৌম্য, প্রিয়দরশন?'
তুলি শির কহিলা বালক, "ভগবন্‌,
নাহি জানি কী গোত্র আমারপুছিলাম
জননীরে, কহিলেন তিনি, সত্যকাম,
বহুপরিচর্যা করি পেয়েছিনু তোরে,
জন্মেছিস ভর্তৃহীনা জবালার ক্রোড়ে--
গোত্র তব নাহি জানি'

শুনি সে বারতা
ছাত্রগণ মৃদুস্বরে আরম্ভিলা কথা
মধুচক্রে লোষ্ট্রপাতে বিক্ষিপ্ত চঞ্চল
পতঙ্গের মতো--সবে বিস্ময়বিকল,
কেহ বা হাসিল কেহ করিল ধিক্কার
লজ্জাহীন অনার্যের হেরি অহংকার
উঠিলা গৌতম ঋষি ছাড়িয়া আসন,
বাহু মেলি বালকেরে করিয়া আলিঙ্গন
কহিলেন, "অব্রাহ্মণ নহ তুমি তাত
তুমি দ্বিজোত্তম, তুমি সত্যকুলজাত'

******
আমি ব্রাহ্মণের কথাই বলছিবাহ্মণ হল হিন্দু বর্ণচতুষ্টয়ের প্রথম এবং উচ্চতম বর্ণহিন্দুধর্মানুসারে এই বর্ণজাত ব্যক্তিগণই সমাজে শিক্ষক, আধ্যাত্মিক গুরু, শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত এবং বিধানকর্তার ভূমিকা পালন করার অধিকারপ্রাপ্ত।. শাস্ত্রানুসারে ব্রাহ্মণকুলজাত ব্যক্তিগণ বিপ্র (অর্থাৎ জ্ঞানী) এবং দ্বিজ (অর্থাৎ দু'বার জাত) হিসেবেও অভিহিত হয়ে থাকেনদু'বার জাত মানে হল, একবার মাতৃগর্ভ থেকে জাতক জন্ম গ্রহন, দ্বিতীয়বার উপনয়নের মাধ্যমে শাস্ত্র অধ্যয়ন ও বেদোক্ত নিয়মানুসারে পূজার্চ্ছনা ও যজ্ঞের অধিকার লাভ করাআজ জন্ম সূত্রে বংশ পরম্পরা ব্রাহ্মণ আছে।। কিন্তু আছে কি " দ্বিজোত্তম, সত্যকুলজাত ব্রাহ্মণ?'
কোথায় পাব সেই বাহ্মণ? আমরা কম বেশী সকলেই জানি হিন্দু বর্ণচতুষ্টয়ের প্রথম এবং উচ্চতম বর্ণ হল ব্রাহ্মণ হিন্দুধর্মানুসারে এই বর্ণজাত ব্যক্তিগণই সমাজে শিক্ষক, আধ্যাত্মিক গুরু, শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত এবং বিধানকর্তার ভূমিকা পালন করার অধিকারপ্রাপ্ত।. শাস্ত্রানুসারে ব্রাহ্মণকুলজাত ব্যক্তিগণ বিপ্র (অর্থাৎ জ্ঞানী) এবং দ্বিজ (অর্থাৎ দু'বার জাত) হিসেবেও অভিহিত হয়ে থাকেনদু'বার জাত মানে হল, একবার মাতৃগর্ভ থেকে জাতক জন্ম গ্রহন, দ্বিতীয়বার উপনয়নের মাধ্যমে শাস্ত্র অধ্যয়ন ও বেদোক্ত নিয়মানুসারে পূজার্চ্ছনা ও যজ্ঞের অধিকার লাভ করাআমরা বৈদিক যুগের দিকে তাকলে দেখতে পাই ক্ষত্রিয়রা রাজ্য শাসন করেছে (কিছু ব্যতীক্রম ব্যতীত)কিন্তু সেই ক্ষত্রিয় রাজাদের শাসন করেছেন দ্বিজোত্তম, সত্যকুলজাত ব্রাহ্মণরা এবং সেটা সম্ভব হয়েছে 
রাজ পুরোহিত কিংবা কূল গুরু নামক সর্বোচ্ছ পদটিতে আসীন থেকে

ত্রেতা ঋষি বৈশিষ্ঠ ছিলেন সূর্য বংশের কূল গুরুযে বংশে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে শ্রী রামের জন্ম হয়েছিলদ্বাপরযুগে হস্তিনাপুরের রাজপুরোহিত ছিল কৃপাচার্য (অন্যায় যেনেও যিনি শুধু রাজ্য ও রাজ ভক্তির কারনে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে রাজার পক্ষে পান্ডবদের বিপক্ষে অস্র ধরেছিলেন), স্বয়ম্ ভগবান যদুবংশে জন্ম গ্রহন করেছিলেন, আর ঐ বংশের ঋষি সান্ডোল্যযুগে যুগে আমরা এমন কোন রাজা পাব না যাদের পুরোহিত ছিল নাপৌরানিক কাহিনী সমৃদ্ধ গ্রন্হ গুলোর বদৌলতে আমরা সকলে এ সকল ঋষিদের আধ্যাত্বিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার বিষয়ে কম-বেশী জানিযুগে যুগে রাজা মহারাজারা তাঁদের রাজকায্য ও কীর্তির জন্য তার ছেয়েও অধিক গৌরবে টিকে আছে এবং থাকবে ঋষি বৈশিষ্ঠ, ঋষি সান্ডিল্যদের নামকেননা এরা সার্বক্ষনিক রাজা, রাজ্য আর প্রজা কল্যাণে চিন্তা করতোরাজপুরোহিতগনের অনেক বড় সম্মান ছিল এই যে তাঁরা রাজকার্যে প্রত্যেক্ষ অংশ গ্রহন করতে পারতেনমানে যে কোন বিচারিক কার্যে রাজা পুরোহিতের স্মরণাপন্ন হতেন, আর তিনি যে বিধান দিতেন, রাজা মহারাজারা সে বিধান কার্যকর করার আদেশ দিতেনএতে বুঝা যায়, রাজা রাজ্য শাসন করলেও রাজা স্বাধীন ছিলেন নাবরং তিনি রাজপুরোহিতের অধীন ছিলেনপুরানগুলো পর্যালোচনা করলে আরো দেখা যায়, কুলগুরু ছাড়াও অন্যান্য শাস্ত্রানুসারে ব্রাহ্মণকুলজাত ব্যক্তিগণ বিপ্র এবং দ্বিজগন রাজা মহারাজাদের কাছে অত্যন্ত মর্যাদা পেতেন, মাসিক মাসোহারও উপটৌকন পেতেন

লক্ষ্য করলে দেখবেন পরস্পর দুদুটি শব্দ একত্র হয়ে পুরোহিত শব্দটি হয়েছে‌পুর শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো নগর বা নগরীআর হিত শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো অন্যের মঙ্গল কামনা করাঅর্থাৎ যিনি পুর/নগরীর হিত/মঙ্গল কামনা করতেন, তাঁকেই পুরোহিত বলা হতকিন্তু প্রশ্ন ছিল বাহ্মণ ছাড়া অন্যান্য বর্ণের মানুষও তো ছিল, যারা নগর কিংবা রাজ্যের মঙ্গল/হিত কামনা করতোসুতরাং রাজ পুরোহিত নামক উচ্চাশনের এ পদটিতে শুধু বাহ্মণ নিয়োগ দেয়া হতো কেন? এ সঙ্গতঃ কারনেই চলে আসে

ক্রমশ চলবে.................................

No comments:

Post a Comment