Pages

Tuesday, May 14, 2013

রত্নগর্ভা- বিশ্বজয়ী সন্তানদের মায়েরা

আসুন বিশ্ব মা দিবসে চিনে নি কিছু জগজ্জননীকে।এই রত্নগর্ভারা যাদের জন্ম দিয়েছেন তাঁদের সন্তানেরা বিশ্বকে দিয়েছে যুগান্তর। 
 
প্রথম ছবিতে আছেন ভুবনেশ্বরী দেবী (১৮৪১-১৯১১)। স্বামী বিবেকানন্দের জননী। ভুবনেশ্বরী দেবী ছিলেন সিমলার নন্দলাল বসু মেয়ে। তিনি বিশেষ ভক্তিমতী নারী ছিলেন। তাঁর প্রথম কয়েকটি সন্তানের মৃত্যু ও কন্যাসন্তানের জন্মের পর পুত্রসন্তান কামনায় তিনি তাঁর এক কাশীবাসিনী আত্মীয়াকে দিয়ে কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরে নিত্য পূজা দেওয়ার ব্যবস্থা করান। এরপরই স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম হওয়ায় তাঁর বিশ্বাস হয় যে, তিনি শিবের কৃপায় পুত্রলাভ করেছেন।স্বামীজী একবার বলেছিলেন - "I am indebted to my mother for the efflorescence of my knowledge" (আমার জ্ঞানের বিকাশের জন্য আমি আমার মায়ের কাছে ঋণী)। ভাবুন একবার কেমন হবেন সেই মা, যাঁর আচলের ছায়াতলে একজন বিবেকানন্দের উন্মেষ, যাঁর চেতনার আলোয় একজন বিবেকানন্দের প্রকাশ। 

দ্বিতীয় ছবিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মা সারদা দেবী ছিলেন যশোর জেলার দক্ষিণডিহির রামনারায়ণ চৌধুরীর মেয়ে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তার বিয়ে হয়েছিল ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৮ বছর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন চতুর্দশ সন্তান। কিন্তু, ছোটবেলা থেকেই তিনি মায়ের স্নেহ পান নি। কারণ, ঠাকুর বাড়ির এক অদ্ভুত নিয়ম ছিল জন্মের পর তাদের লালল পালন করবেন দাইরা। তাই, মাতৃস্নেহ তিনি ছোটবেলায় তেমন পান নি। এমনকি অন্দরমহলে মার কাছে যাওয়ারও অনুমতি মিলত না।

কিন্তু, পিতার সাথে হিমালয় ঘুরে আসার পরই তার কদর বেড়ে যায়। পিতার সাথে কেমন ঘুরলেন, কি কি দেখলেন, কি কি নতুন অভিজ্ঞতা হলো এসব বলতে এবার তিনি অন্দরমহলে ঢুকতে পারলেন বিনা বাঁধায়। তার মার সাথে তিনি তার হিমালয় অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারতেন আবার, সময়ও কাটাতে পারতেন। তিনি বলেছিলেন, "এটা তার জীবনের অন্যতম সুখকর অভিজ্ঞতা।"

মায়ের মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ১৩ বছর ১০ মাস। যেহেতু অন্দরমহলে যাওয়ার অনুমতি ছিল না তাই, মায়ের মৃত্যুসংবাদ আসল হঠাৎ করেই। কিশোর রবি ঠাকুরের মনে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা ওর ভাষাতে, "অনেকদিন হইতে তিনি রোগে ভুগিতেছিলেন, কখন যে তার জীবনসংকট আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল তাহা জানিতেও পারি নাই। প্রভাতে উঠিয়া মার মৃত্যুসংবাদ যখন শুনিলাম তখন সে কথাটার অর্থ সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করিতে পারিলাম না, মনের ভিতর একটা হাহাকার তুলিয়া দিল। বাহিরের বারান্দায় দেখিলাম, তাঁহার সুসজ্জিত দেহ খাটের উপর শয়ান। কিন্তু, মৃত্যু যে ভয়ংকর সে দেহে তাঁহার কোন প্রমাণ ছিল না;--- সেদিনের প্রভাতের আলোকে মৃত্যুর যে রূপ দেখিলাম, তাহা সুখসুপ্তির মতোই প্রশান্ত ও মনোহর।"

তৃতীয় ছবিতে , নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর মা প্রভাবতী দেবী ও বাবা জানকিনাথ বসু। প্রবেশিকা পরীক্ষার পর নেতাজী তাঁর মাকে একটি চিঠি লিখেন। সেই চিঠির শেষের অংশটিতে তিনি লিখেন-"আমি যদি না পড়িয়া এ স্থান পাই তবে যাহারা লেখাপড়াকে উপাস্য দেবতা মনে করিয়া তজ্জন্য প্রাণপাত করে তাহাদের কি অবস্থা হয়? তবে প্রথম হই আর লাষ্ট হই আমি স্থিররূপে বুঝিয়াছি লেখাপড়া ছাত্রের উদ্দেশ্য নহে- বিশ্ববিদ্যালয়ের 'চাপ্রাস' (ডিগ্রী) পাইলে ছাত্ররা আপনাকে কৃতার্থ মনে করে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের 'চাপ্রাস' (ডিগ্রী) পাইলে যদি কেহ প্রকৃত জ্ঞান না লাভ করিতে পারে- তবে সে শিক্ষাকে আমি ঘৃণা করি। তাহা অপেক্ষা মূর্খ থাকা কি ভাল নয়? চরিত্র গঠনই ছাত্রের প্রধান কর্ত্তব্য- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা চরিত্র গঠনকে সাহায্য করে-আর কার কিরূপ উন্নত চরিত্র তাহা কার্য্যেই বুঝিতে পারা যায়। কার্য্যই জ্ঞানের পরিচায়ক। বই পড়া বিদ্যাকে আমি সর্বান্তকরণে ঘৃণা করি। আমি চাই চরিত্র-জ্ঞান-কার্য। এই চরিত্রের ভিতরে সবই যায়- ভগবদ্ভক্তি,- স্বদেশপ্রেম,- ভগবানের জন্য তীব্র ব্যাকুলতা সবই যায়। বই পড়া বিদ্যা তো তুচ্ছ সামান্য জিনিষ- কিন্তু হায় কত লোকে তাহা লইয়া কত অহঙ্কার করে।" (সুধীরকুমার মিত্র বিরচিত 'বাংলার পাঁচ স্মরণীয় বিপ্লবী': সম্পাদনা-দেবপ্রসাদ জানা, পৃষ্ঠা-২৬১)।

মায়ের কাছে লেখা চিঠির কথাগুলোকে তিনি তাঁর নিজের জীবনের ক্ষেত্রে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। আর তাইতো পড়াশুনার মাধ্যমে তিনি প্রকৃত জ্ঞান লাভ করেছেন। শুধু নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা না করে দেশ ও মানুষের কথা চিন্তা করেছেন সবসময়। মানুষের দুঃখ, কষ্টগুলোকে তিনি অনেক বড় করে দেখেছেন। আর সেকারণেই ব্রিটিশদের শোষণ ও নির্যাতন থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে মুক্ত করার জন্য আজীবন লড়াই-সংগ্রাম করেছেন

No comments:

Post a Comment