Pages

Saturday, May 18, 2013

আর্য আক্রমণ তত্ত্ব: নির্লজ্জ এক মিথ্যাচারের গল্প:







ছোটবেলা থেকেই আমরা কল্পকাহিনী শুনতে অভ্যস্ত। এগুলো আমাদের পাঠ্য পুস্তকেও
 পড়ানো হয়। যেমন আর্যরা ছিল বহিরাগত। তারা ইউরোপ থেকে এসে ভারত দখল করে। 
বিজয়ী আর্যরা পরাভূত প্রাগার্য গোষ্ঠী ও কৌমের মানুষদের দাস, দস্যু, রাক্ষস বা অসুর
 বলে উল্লেখ করেছে আর নিজেদের মনে করেছে উন্নততর মানবপ্রজাতির অংশ। এই 
আর্যদের ধর্মই বৈদিক ধর্ম যা কালক্রমে হিন্দু ধর্ম নামে পরিচিতি পায়। হিন্দু সমাজের প্রচলিত
 বর্ণপ্রথায় শুদ্ররাই হচ্ছে এই অনার্যদের বংশধর।

গত দেড়শ বছর ধরে এই ‘আর্য আক্রমণ তত্ত্ব’ বা Aryan Invasion Theory হিন্দু ধর্মের
 বিরুদ্ধে হিন্দুবিরোধীরা ব্যবহার করছে।

চরম হিন্দুবিদ্বেষী দৈনিক আমার দেশে কয়েক বছর আগে লেখা হয় হিন্দু ধর্ম বর্বর আর্যদের
 আমদানি করা ধর্ম। দক্ষিণ ভারত আর উত্তর শ্রীলংকার তামিলরা নিজেদের দ্রাবিড় বলে
 আখ্যা দিয়ে তারা উত্তর ভারতের তথাকথিত আর্য হিন্দুদের ঘৃণা করতে শিখে। হিন্দু 
পণ্ডিতরা যেমন স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী,স্বামী বিবেকানন্দ শুরু থেকেই এই তত্ত্বের বিরোধিতা
 করেছেন। আমরা এই আর্টিক্যালের মাধ্যমে আর্য আক্রমণ তত্ত্বের মিথ্যাচার উন্মোচন করব।

বৈদিক ধর্ম কি?:
অগ্নিবীর দ্ব্যার্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করছে যে আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে বৈদিক ধর্মকে
 সমগ্র মানব জাতির ধর্মে পরিণত করা। হ্যাঁ, আমাদের ধর্মান্তরিত করার মদোন্মত্তত্তা রয়েছে। 
আমরা চাই এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ বৈদিক ধর্মের প্রতি বশ্যতা ও আনুগত্য প্রদর্শন করবে।
 আমরা বিশ্বাস করি যে একমাত্র বৈদিক ধর্ম আলিঙ্গনের মাধ্যমে পৃথিবীর মুক্তি আসবে.
 আমরা এও ঘোষণা করছি যে বৈদিক ধর্ম ব্যতীত অন্য কোন ধর্ম ঈশ্বরের কাছে গ্রহণযোগ্য
 নয়। .....বিস্তারিত
১. খ্রিস্টান মিশনারিদের চক্রান্তঃ

এই তত্ত্ব সম্প্রসারণের পিছনে লর্ড মেকলে আর জার্মান দার্শনিক মাক্সমুলারের অবদান 
সবথেকে বেশি। এরা প্রত্যেকে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য এই কাজটি করেন।

এই মাক্স মুলার প্রথম জীবনে ছিলেন একজন উদ্বাস্তু। তার আত্মজীবনীতেই রয়েছে

…Had not a penny left, and that in spite of every effort to make a little money,
 I should have had to return to Germany.(ref –the life and letters of Maxmuller, 
vol.1, p.61, London edn)

তাই ব্রিটিশদের ধর্মপ্রচারের কাজে তাকে যোগদান করতে হয়। তিনি তার মেধাকে ব্রিটিশদের
 হাতে বেঁচে দিলেন।

I am to hand over to the company, ready for the press, fifty sheets each year
-the same I had promised to samter in Germany; for this I have asked 200 
pounds a year, 4 pounds a sheet.(ref. the life and letters of Maxmuller, vol.1,
 p.60-61, London edn.)

কর্নেল জোসেফ বোডেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীতে বোম্বেতে চাকরি করতেন।
 তিনি ছিলেন একজন খ্রিস্টান উগ্রবাদী। হিন্দুদের খ্রিস্টান বানাতে তিনি মিশনারিদের
 সহায়তা করতেন। ১৮০৭ সালে অবসর গ্রহণের পর তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে
 ২৫০০০ পাউন্ড অনুদান করেন সেখানে সংস্কৃত ভাষার উপর চেয়ার প্রতিষ্ঠা করতে।
 বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে এর নাম করে বোডেন চেয়ার। বোডেনের লক্ষ্য
 ছিল বাইবেলকে সংস্কৃত ভাষায় অনুবাদ করে এর মাধ্যমে হিন্দুদের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত
 করার।

এছাড়া মিশনারিরা হিন্দুধর্মকে একটি বহুশ্বরবাদী ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল।
 কিন্তু হিন্দুদের একেশ্বরবাদী চেতনার উৎসই হল বেদ। তাই তাদের লক্ষ্য ছিল বেদকে 
আক্রমণ করা। এর জন্য মাক্সমুলারের মত ধূর্ত লোকদের দরকার ছিল আরও অনেক
 বেশী যার ইংরেজি এবং সংস্কৃত ভাষার উপর দখল ছিল অতি জঘন্য। তার কাজ ছিল হিন্দু 
শাস্ত্রগুলোর অপব্যাখা করা।

লর্ড মেকলে যাকে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা প্রবর্তনের জন্য আমাদের বুদ্ধিজীবীরা পূজা করেন
 তিনি জন্ম নেন এক ডানপন্থী খ্রিস্টান পরিবারে। ইংরেজি শিক্ষা এবং ইউরোপীয় ভাষা 
প্রচারের প্রধান লক্ষ্যই ছিল খ্রিস্টধর্ম প্রচার।

১৮৩৫ এর ফেব্রুয়ারিতে ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেন তিনি।

১৮৩৬ সালের ১২ অক্টোবর তিনি তার পিতাকে চিঠিতে লিখেন, “ our English schools
 are flourishing wonderfully. We find it difficult – indeed, in some places 
impossible – to provide instructions for all who want it. At the single town 
of hoogle fourteen hundred boys are learning English. The effect of this 
education on the hindoos is prodigious. No hindoo, who has received an 
English education, ever remains sincerely attached to his religion. Some 
continue to profess it as a matter of policy; but many profess themselves 
pure deists, and some embrace Christianity. It is my firm belief that if, our
 plans of education are followed up, there will not be a single idolater 
among the respectable classes in Bengal thirty years hence. And this will 
be affected without any efforts to proselytize; without the smallest 
interference with religious liberty; merely by the natural operation of
 knowledge and reflection. I heartily rejoice in the prospects.” Ref. the
 life and letters of Lord Macaulay, pp. 329-330

লর্ড মেকলে আর মাক্সমুলারের প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৮৫১ সালে লন্ডনে। পরবর্তী সাক্ষাৎ হয়
 ১৮৫৫ সালের ডিসেম্বরে। তাদের সেই সাক্ষাৎকারে মাক্সমুলার ভাষাকে ব্যবহারের কথা 
জানান। তিনি লিখেন।

“…I made acquaintance this time in London 
with Macaulay, and had along conversation 
with him on the teaching necessary for the
 young men who are sent out to India. 
He is very clear headed, and extraordinarily eloquent…I 
went back to oxford a sadder, 
and, I hope, a wiser man.” Ref. –the life and
 letters of Maxmuller, 
vol.1, p.162, London edn

মাক্সমুলার ক্রমাগত সংস্কৃত শাস্ত্রের অপব্যাখা করতে থাকেন। এই বিষয়ে স্বামী দয়ানন্দ 
সরস্বতী তার সত্য প্রকাশ বইয়ের ২৭৮ পৃষ্ঠাতে লেখেন

“the impression that the Germans are the best Sanskrit scholars, and 
that no one has read so much of Sanskrit as Prof Maxmuller, is altogether 
unfounded exposed Maxmuller. Yes, in a land where lofty trees never grow, 
even recinus communis or the castor oil plant may be called as oak…. I 
came to learn from a letter of a principal of some German university, that even
 men learned enough to interpret a Sanskrit letter are rare in Germany. I have
 also learnt from the study of Maxmuller’s history of Sanskrit literature and 
his comments on some mantras of the Veda, that prof. Maxmuller has been 
able to scribble out something by the help of the so-called tikas or paraphrases
 of the Vedas current in India” 

এই মাক্সমুলারই বেদের বিভিন্ন মন্ত্রের অপব্যাখা দিয়ে আর্য আক্রমণ তত্ত্বের প্রবর্তন করেন।

২. আর্য দ্রাবিড় বিভক্তিঃ 

ঋগবেদে কোথাও এই কথা নেই যে আর্যরা আক্রমণ করেছে বা বেদের দ্রষ্টা ঋষিরা
 ভারতের বাইরে থেকে এসেছেন। তারপরও হিন্দুবিরোধীরা অপপ্রচার চালায় ঋগবেদের
 বিরুদ্ধে। তারা বলে অঙ্গিরা বংশের ঋষিরা ইন্দ্রের আহ্বান করেছেন দস্যু এবং পানিদের
 দমন করতে এবং এটাই বুঝায় যে আর্য সেনাবাহিনী স্থানীয় ভূমিপুত্র দ্রাবিড়দের হত্যা করেছে।

দ্রাবিড় শব্দের মানে কি?

এর সংস্কৃত মূল দ্রব। এর অর্থ তরল জাতীয় বা জলীয়। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল 
তামিলদের সঙ্গম সাহিত্যে দ্রাবিড় বলতে কোন শব্দ নাই। তামিলদের সঙ্গম সাহিত্য ঐ 
অঞ্চলের জীবন, সময়, ঘটনাপ্রবাহ এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সুনির্দিষ্ট ঘটনাপ্রবাহ 
ইঙ্গিত করে। এটা তামিলদের ব্যাকরণেরও বিবর্তন নির্দেশ করে। এর সময়সীমা খ্রিস্টের 
জন্মের ২০০ বছর আগে থেকে খ্রিস্টের জন্মের ৬০০ বছর পরে পর্যন্ত।

তাহলে আর্য বলে যদি কোন জাতি বাইরে থেকে এসে দ্রাবিড়দের হত্যা করে তাদের 
দক্ষিণ ভারতের দিকে অভিবাসী হতে বাধ্য করে তাহলে তামিলদের এই প্রাচীন সাহিত্যে কেন

 এই ঘটনার উল্লেখ নেই?

নবম শতাব্দীর দিকের তামিল সাহিত্যে দ্রাবিড় শব্দটি প্রথম পাওয়া যায়। সেন্থান দিবাকরম
 নামে একটি শব্দভাণ্ডারে দ্রাবিড় নামটি পাওয়া যায়। এটি ব্যবহৃত হয়েছিল তামিল বুঝাতে।

এটি পরিষ্কার যে দ্রাবিড়দের নিয়ে গল্পটি একটি নির্লজ্জ মিথ্যাচার। উনবিংশ শতাব্দীতে রবার্ট 
ক্যাডঅয়েল নামক এক খ্রিস্টান ইভানজেলিস্ট প্রথম এই দ্রাবিড় শব্দটি ব্যবহার করেন আর্য
 আক্রমণ তত্ত্বে। এরপরই এটা রাজনৈতিক রূপ পায়।

৩. ঋগবেদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারঃ

দেখা যাক মহাজ্ঞানীরা ঋগবেদের কোন মন্ত্রগুলো ব্যবহার করছে আর্য আক্রমণ তত্ত্ব প্রমাণ 
করতে। তারা ঋগবেদের ১০/৪৮ সুক্তকে দেখায় যেখানে আছে ইন্দ্র দস্যু, বৃত্র এবং 
পানিদের দমন করেছেন, তাদের সম্পদ নিয়ে নিয়েছেন এবং বলেছেন যারা তাঁর অনুসারী
 তাঁরা ব্যর্থ হবে না। বৃত্র এবং পানি দস্যুর প্রকারভেদ।

কিন্তু ঋগবেদের ১/৩৩/১-১০ মন্ত্রগুলো পড়লে বুঝতে পারা যায় দস্যুদের কাছ থেকে কেড়ে
 নেওয়া ইন্দ্রের সম্পদ আসলে জ্ঞান। ঋগবেদের ১/৩৩/১ মন্ত্রটি শেষ হয় “gavam ketam
 param avarjate nah” এই কথাগুলো দিয়ে। এর অর্থ দীপ্তিময় গাভীর সর্বোচ্চ জ্ঞান।
 এই মন্ত্রটির অর্থ হচ্ছে

come let us go seeking the cows to Indra, it is he that increases the thought in
 us, for us, he releases supreme knowledge of the luminous cows.

বেদে যারা আধ্যাত্মিক কর্ম করেন তাদের যাজ্যু বলা হয়েছে। এই উৎসর্গ যেই সত্ত্বাদের
 উদ্দেশে করা হত তাদের যাজত বলা হত। যাজ্যুকে তার শুভবুদ্ধির জন্য সুক্রাতু বলা হত।
 সুক্রাতু যখন ঐশ্বরিক বানী লাভ করতেন তাদের বলা হত বিশ্বের গায়ক। দস্যু শব্দটি
 সুক্রাতু এবং যাজ্যুর ঠিক বিপরীত। একে বলা হত অযাজ্যু। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে দস্যু 
বিশ্বের গায়কদের ঘৃণা করে। এই জন্য একজন দস্যুকে বলা হত ব্রহ্মদ্ভিসা এবং অনাসা 
( যার কথা বলার কোন মুখ নেই ) ও অমানযামানা ( যার কোন মানসিক বিবেকবোধ নাই )। 
বেদে বলা আছে দস্যুদের যে জ্ঞান তা ইন্দ্র কেড়ে নেন মানুষের সাহায্যে। ঋগবেদের আরেক জায়গাতে
 আছে পানি এমন এক ধরণের দস্যু যারা 
পবিত্র গাভি চুরি করে তাদের গুহাতে আটকে রাখে। ইন্দ্র মানুষের সহায়তায় তা উদ্ধার 
করেন। ঋগবেদের ৬/৫১/১৪ তে ইন্দ্রের প্রতি প্রার্থনা করা হয়েছে পানিদের ধ্বংস করতে এবং
 পানিদের নেকড়ের সাথে তুলনা করা হয়েছে।

ঋগবেদের ৩/৩৪/৭-১০:

৭- ইন্দ্র,সাহসীদের প্রভু,যিনি সকলের শাসনকর্তা,যিনি সকল শক্তির মুল,যার শৌর্যে 
শক্তিশালী শৌর্যময়, এই পৃথিবীতে তার এই দান এর জন্য জ্ঞানীগন তার প্রশংসা করেন।

৮- অনন্যসাধারন,সর্বজয়ী,সকল জয়ের দাতা,আলোক এবং পানির উত্স ,স্বর্গ ও মর্তের 
মালিক,সেই ইন্দ্রকেই সকলে ভক্তিসহকারে বন্দনা করে।

৯.-তিনি শক্তিশালী সূর্য ও অশ্ব এর মালিক(সংস্কৃত তে শক্তি এর প্রতীক হিসেবে সূর্য,অশ্ব 
এবং বৃষ এই তিনটি শব্দ প্রায়শই ব্যবহৃত হয়ে থাকে)।তিনি আমাদের গোসমূহ যোগান
 দিয়ছেন যা আমাদের দুগ্ধের যোগান দেয়।তিনিই স্বর্নময় সকল গুপ্তধনের 
উত্স(,তিনি দস্যুদের ধ্বংস করেন এবং আর্যদের রক্ষা করেন।

১০- তার শক্তিতেই গাছপালা বেড়ে উঠে,দিনের পর দিন আবর্তিত হয়;তিনি এই ভুখন্ড
 এবং বায়ুমন্ডল এর অধিকারী,তিনি অসতদের বিনাশ করেন,দাম্ভিকদের নিবৃত্ত করেন।
তিনিই গাছপালা, বনজঙ্গল, আকাশ, দিনরাত্রির শৃঙ্খল রক্ষা করেন।

এখন দস্যুরা যদি মনুষ্য সন্তান হয় এবং তারা অনার্য আদিবাসী হয় তবে তাদের থেকে ইন্দ্র
 কি করে আকাশ এবং দিনকে মুক্ত করেন? বেদে আরও আছে ইন্দ্র দস্যুদের তাড়া করেন
 এবং তাদের বিতাড়িত করেন স্বর্গ এবং মর্ত্য থেকে তার বজ্রের সাহায্যে। ইন্দ্রের মহত্ত্ব 
বাড়তে থাকে এবং ইন্দ্রের দীপ্তি দস্যুদের পলায়নের রাস্তা বন্ধ করে দেয়। এরপর ইন্দ্র হারিয়ে 
যাওয়া সূর্যকে উদ্ধার করেন এবং সেই সূর্য যখন উদিত হয় তখন তার আলোয় গুহাগুলো
 আলোকিত হয় যেখানে ভালা (এক ধরণের দস্যু) পবিত্র গাভীগুলি লুকিয়ে রেখেছে।

তাহলে আমরা এমন এক চিত্র পাই যেটা সম্পূর্ণভাবে আর্য আক্রমণ তত্ত্বের বিরুদ্ধে যায়।
৪. সঙ্গম সাহিত্য থেকে প্রমাণঃ 

আমরা এখন তামিলদের সাহিত্যের দিকে নজর দেই। আমরা দেখি আসলেই কি তামিলরা
 তথাকথিত দ্রাবিড় যারা আর্যদের হাতে নির্যাতিত হয়েছিল।

সঙ্গম সাহিত্যে পৃথিবীকে ভাগ করা হয়েছে মুল্লাই (বন), কুরিঞ্ছি (পাহাড়), মারুদাম
 (কৃষি ভূমি), নেইদাল (সমুদ্র সৈকত) এবং পালাই (খোলা ভূমি) এই পাঁচ ভাগে।

তল্কাপ্পাইয়াম সাহিত্যে আছে এই জায়গাগুলোর দেবতা হচ্ছে মুল্লাইঃ তিরুমাল/ বিষ্ণু। 
কুরিঞ্ছিঃ সেয়ন ( কুমার/মুরুগুয়া/ কার্ত্তিকেয়)। মারুদামঃ ভেন্দান/ইন্দ্র। নেইদালঃ বারুনান/ বরুণ।
 পালাইঃ কররাভাই/ শক্তি।

সঙ্গম সাহিত্যের আরেকটি অংশ হচ্ছে পুরানানুরু। সেখানে আছে শিব তিনটি শহরকে ধ্বংস
 করেছেন (ত্রিপুরা সামহারা)। সেখানে আছে শিব এক হাতে মেরু পর্বত তুলে নেন তীরধনুক
 হিসেবে। একটা ভয়ংকর সরীসৃপকে তীর ধনুকের ছিলা হিসেবে ব্যবহার করেন। একটা
 তীরের আঘাতে শহর তিনটিতে আগুন লেগে যায় এবং তা ধ্বংস হয়ে যায়। পুরানানুরু 
সাহিত্যে কার্তিককে বারবার দেখা যায় শিবের ছেলে হিসেবে। এটা আমাদের অগ্নিকুমার যিনি
 পুরাণের কার্তিকেয়র প্রতিচ্ছবি তার সাথে শিবের সম্পর্ক স্থাপনে সহায়তা করে। আর্য 
আক্রমণ তত্ত্বের সমর্থকদের দেখা যায় শিবকে শুধু দ্রাবিড়দের দেবতা বলতে দেখা যায়। সত্য
 এই যে বেদের রুদ্র থেকে পৌরাণিক শিবের উৎপত্তি।

তৈত্তিরীয় সংহিতা বা কৃষ্ণ যজুর্বেদ এর রুদ্রম ভাগের বিভিন্ন ভাগে রুদ্র সম্পর্কে নির্দিষ্ট 
ধরনের বেশকিছু বৈশিষ্ঠ্য উল্লেখিত হয়েছে।আর শিব হল সেই বেশ কিছু গুলের একটি নির্দিষ্ট
 অংশের প্রতীক।পরবর্তীতে রুদ্রের বদলে অধিকাংশ স্থানেই শিব শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়।
তামিল গ্রন্থসমুহ যেমন পেরিয়া বা পুরানাম সমুহে শিবের যে বৈশিষ্ঠ্য দেখানো হয়েছে তা
 বেদের রুদ্রের সমরুপ।চিদাম্বরাম,থেবারাম এলাকাগুলোতে এখনও রুদ্রাম/চমকম পাঠ করা
 হয়।যদি তামিলদের শিব আর বৈদিক শিব আলাদা হত তবে তা নিশ্চয় করা হতনা।
আসলে তৈত্তিরীয় সংহিতার রুদ্রাম সংস্কৃতিটাই এখনো তামিলনাড়ু, কর্ণাটকে বিদ্যমান।

৫. কেন এই আর্য আক্রমণ তত্ত্বঃ

ইন্দোইউরোপিয়ান ভাষাগুলোর পারস্পরিক মিল দেখে ধারণা করা হয় যে এই ভাষাভাষীরা 
সকলে একই পূর্বআবাসস্থল থেকে এসেছে। সংস্কৃতের সাথে ইউরোপিয়ান বেশ কয়েকটি
 ভাষার মিল দেখে কেবল ভাষাগত মিল দেখেই জার্মান ইন্ডোলোজিস্ট ম্যাক্স মুলারই প্রথম 
আর্য আক্রমণ তত্ত্বের সূচণা করে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী আর্যরা রাশিয়ার দক্ষিণ অংশ থেকে 
মাইগ্রেট করে ভারতীয় উপমহাদেশের আদিম অধিবাসীদের আবাস তথা সিন্ধু উপত্যকায়
 পৌছে। ম্যাক্স মুলারের এই তত্ত্বে কেবল ভাষাগত মিলকে বিবেচনায় নিয়েই এরকম
 একটি তত্ত্বকে দাঁড় করানো হয়। সিন্ধু সভ্যতার কোন আর্কিওলজিকাল এভিডেন্স তখনও
 আবিস্কৃত হয়নি। পরবর্তীতে ১৯২০ সালের দিকে যখন হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো ও লোথাল নগর
 সভ্যতা আবিস্কৃত হয় তখন তত্ত্বটির খানিকটা পরিবর্তন হয়। যাযাবর বর্বর আর্যরা ইউরোপ
 থেকে এসে উন্নত নগর সভ্যতায় আক্রমণ করে এবং তাদেরকে পরাজিত করে 
সভ্যতাগুলোকে ধ্বংস করে। মহেঞ্জোদারো খনন করতে গিয়ে মন্টিমার হুইলার একেবারে 
উপরের অংশে কিছু মানুষের খুলি-হাড়গোড় পেলে এ তত্ত্বটি আরো দৃঢ় হয় এবং মোটামুটি
 সর্বজনবিদিত তত্ত্বে রূপান্তরিত হয়। তত্ত্বটি অনুযায়ী খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০ সালের দিকে আর্যরা
 ভারতের প্রাচীন কিন্তু সভ্য অধিবাসী দ্রাবিড়দের আক্রমণ করে। এই 
অসভ্য-বর্বর-যাযাবর-পশুপালক জাতিই আর্য জাতি। এদের হাতেই ঋগ্বেদ রচিত হয়। 
কী সহজ ইতিহাস!

এবারে দেখি তাদের এ ধরণের ইতিহাস লেখার কারণগুলো কী কী।

ম্যাক্স মুলার বা অন্য যারা এই তত্ত্বের প্রবক্তা ও প্রচারক তারা সবাইই মনে করতেন 
বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্ব নির্ভুল। সুতরাং পৃথীবীর বয়স কোনক্রমেই খ্রীষ্টপূর্ব ৪০০০ অব্দের বেশী
 যেতে পারে না। সুতরাং খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০ এর বেশি তারা মোটেই ভাবতে পারেনি কারণ 
বাইবেল অনুযায়ী নুহের প্লাবন হয়েছে খ্রীষ্টপূর্ব ২৫০০ সালের দিকে। কেউ কেউ অবশ্য 
আরো নিচে নেমে এসেছেন। কারো কারো মতে খ্রীষ্টপূর্ব ১১০০-৯০০ সালও হতে পারে। এর
 সাথে যুক্ত হয়েছে জার্মান আর্যশ্রেষ্ঠ তত্ত্ব। যেহেতু ঋগ্বেদের রচয়িতারা নিজেদেরকে আর্য 
বলেছেন সুতরাং ইতিহাস তৈরি হয়ে গেল।

এবার আসি এই ইতিহাসের পূনর্মূল্যায়নে।

ঋগ্বেদে আর্য শব্দটি কি একটি জাতিকে বুঝিয়েছে? ঋগ্বেদে আর্য শব্দটি গৌরব বা মর্যাদার 
অর্থ বহন করেছে, মোটেই কোন জাতিকে বুঝায়নি। ইরানী আবেস্তায়ও আর্য শব্দটি গৌরব ও 
শ্রেষ্ঠত্ববোধের পরিচায়ক। আর্য ও দ্রাবিড় যদি দুটো ভিন্ন জাতি হত তাহলে উত্তর ও দক্ষিণ 
ভারতের অধিবাসীদের একই দেবতা, একই ঈশ্বর, প্রায় একই ভাষা
 (সংস্কৃত থেকে উদ্ভুত), একই পৌরাণিক বিশ্বাস ও গল্প হতে পারত না। দ্রাবিড়িয়ান কি
 কোন আলাদা জাতিগোষ্ঠী? তা তো নয়। তাহলে দাড়ায়- ককেশিয়ানরা দুই ভাগে ভাগ
 হয়ে একদল আর্য আরেকদল দ্রাবিড়িয়ান হয়েছে। দুই মহাদেশের বিশাল অঞ্চলে 
বসবাসকারী মানুষদের ভাষা একই পরিবারভুক্ত হওয়ায় এবং একইসাথে আবেস্তা
 ও ঋগ্বেদের মিল দেখে পণ্ডিতগণ অনুমান করেছিলেন যে এরা একই আদি জনগোষ্ঠী
 থেকে ছড়িয়ে পড়ে সভ্যতা গড়ে। তাদের অনুমান ঠিকই ছিল কিন্তু যখন তারাই এই 
আর্যদের যাযাবর পশুপালক বর্বর বলেন আবার ঋগ্বেদও তাদের দ্বারা রচিত বলেন তখন 
তাদের ইতিহাস প্রশ্নবিদ্ধ না হয়ে উতড়ে যেতে পারে না।

ঋগ্বেদ যদি তথাকথিত আর্যদের দ্বারা রচিত হয় তাহলে কেন
 ঋগ্বেদে কোথাও ইউরোপীয় স্থান, নদী ইত্যাদির নামও নেই?
 তারা যখন বলেন আর্যরা খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০ সালে সিন্ধু সভ্যতা
 আক্রমণ করে আর এদিকে আমরা ঋগ্বেদে খরস্রোতা স্বরস্বতী 
নদী দেখতে পাই, যে নদী খ্রীষ্টপূর্ব ৪০০০ অব্দে মরে যায় 
(সম্ভবত প্লেট টেকটোনিক মুভমেন্টের জন্য) তখন এ ইতিহাস
 যে মিথ্যা তা আর দ্বিতীয়বার ভাবতে হয় না। তাছাড়া 
পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের মেহরগড় প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি খননের পর দেখা যায় প্রায় ৯৫০০
 বছর আগে নবপ্রস্তর যুগে এখানকার অধিবাসীরা যাযাবর জীবন ছেড়ে স্থিতিশীল গ্রামীণ কৃষি
 জীবনে চলে গিয়েছিল। খ্রীষ্টপূর্ব ৮০০ সাল পর্যন্ত সেখানে কোন বাইরের জনগোষ্ঠীর আগমণ
 ঘটেনি। ঋগ্বেদ যে কোন যাযাবর জনগোষ্ঠীর রচিত হতে পারে না তা ফুটে ওঠে এর 
সমাজচিত্র রূপায়নে, গৃহনির্মাণের উপমা প্রয়োগে, অট্টালিকা, তন্তুবায়, ভেষজ চিকিৎসা 
ইত্যাদি শব্দপ্রয়োগে। চান্দ্রমাসে হিসাব করলে যে প্রতি তিন বছর একটি ১৩ মাসে বছর হতে
 হয় (যা কৃষিকাজ ইত্যাদির জন্য খুবই প্রয়োজনীয়), যাকে বৈদিক সমাজ মলমাস বলত 
(এখনো হিন্দুরা বলে) তাও বেদে উল্লেখ পা্ওয়া যায়। এরকম কয়েকশ উদাহরণ দেয়া যাবে 
যাতে প্রমাণিত হয় যে বেদের রচয়িতা মোটেই তথাকথিত আর্যরা হতে পারে না।

প্রত্মতাত্ত্বিকভাবে এখন জানা যাচ্ছে যে মেহেরগড়ে মৃৎশিল্প-পূর্ব যুগে এখানকার মানুষ 
স্থিতিশীল বসতি গড়ে এবং পশুপালন ও কৃষিকাজ শুরু করে। পরবর্তীতে কালক্রমে তারা
 বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়ে। তাম্রযুগ ও আদি হরপ্পান পর্যায় পেরিয়ে 
তারা প্রায় ২৬০০ খ্রীস্টপূবাব্দ থেকে ১৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত এক স্থায়ী নগর সভ্যতা 
গড়ে তোলে যাকে হরপ্পান সভ্যতাও বলা হয়। শেয়ার করে সকলকে জানিয় দিন‌। নমস্কার‌।


ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি 
কৃতজ্ঞতাঃ অগ্নিবীর ব্লগ 



No comments:

Post a Comment