Pages

Thursday, June 11, 2015

ভুলে যাওয়া ইতিহাসঃ নোয়াখালী হিন্দু গনহত্যা ১৯৪৬, শেষ পর্ব




ভারত বিভাজনের পূর্বমুহূর্তে নোয়াখালী দাঙ্গা

অক্টোবর মাসে এসে নোয়াখালীতে হিন্দু গনহত্যা এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তকরনের মত ঘৃণ্য বর্বরতা মুসলিমরা বন্ধ করলেও অন্য আরও উপায়ে আর্ত হিন্দু জন গোষ্ঠীর উপর নির্যাতনের ষ্টীম রোলার চালানো তারা বন্ধ করেনি। এমনকি গান্ধীজীর নোয়াখালীতে অবস্থানকালেও তারা সমান বেগে নির্যাতন করে গিয়েছে।গান্ধীজীর নোয়াখালী ত্যাগের এক সপ্তাহ পরে ৯ মার্চে এ.ভি. থ্যাকার মুম্বাইতে ফিরে গিয়েছিলেন। তিনি তখনকার নোয়াখালী ও ত্রিপুরার(বর্তমানের কুমিল্লা) চরম অরাজকতা সম্পর্কে চাঁদপুর থেকে লিখেছিলেন।এমনকি দাঙ্গা সংগঠনের পরে পাঁচ মাস অতিক্রন্ত হয়ে গেলেও সেখানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার নুন্যতম কোন লক্ষণ ছিল না। বরং দাঙ্গা পীড়িত এলাকা থেকে কিছু অস্থায়ী পুলিশ স্টেশন তুলে নিয়ে পরোক্ষ ভাবে দাঙ্গাকারীদের পুনরায় অরাজকতা সৃষ্টির উৎসাহই দেয়া হয়েছিল। ১৯ মার্চে মুসলিমরা বিভিন্ন জায়গাতে গোপন মিটিং করে এবং কোনভাবে টিকে থাকা হিন্দুদেরকে হত্যা ও ধর্ষণের হুমকি দিতে শুরু করে।এরই মাঝে ২৩ সেপ্টেম্বর,১৯৪৭ সালে দাঙ্গার খল নায়ক গোলাম সরোয়ার রামগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন সোনাপুরে বিশাল জনসভার জন্য মুসলিমদেরকে আহ্বান করে। তারা সেদিনকে ‘পাকিস্তান দিবস’ হিসেবে উদযাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেদিন এলাকা জুড়ে সর্বাত্মক ধর্মঘট ডাকা হয়। হাজার হাজার মুসলিম বিভিন্ন গ্রাম থেকে সমাবেশস্থলে এসে জমা হতে পারে এজন্য গ্রামের বিভিন্ন হাটবাজারে ২০ মার্চে ঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দেয়া হয়।মুসলিম সমাবেশের সংবাদ পেয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হিন্দুরা পুনরায় দাঙ্গার আশঙ্কায় তাদের ঘর-বাড়ি, আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে পালাতে শুরু করেন। চৌমুহনী রেল স্টেশন হাজার হাজার হিন্দু নর-নারীতে পূর্ণ হয়ে ওঠে নিমেষের মধ্যে। গান্ধীজীর শান্তি মিশনের কর্মীরা পুলিশে জেলা সুপারিনটেণ্ডেট,অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং একজন মন্ত্রী আব্দুল গোফরানকে এই জনসভার অনুমতি না দেবার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু জেলা পুলিশ সুপারিনটেণ্ডেট এই অনুরোধ গ্রাহ্য না করে বিবৃতি দেন এই জনসভা হবে এবং পুলিশ নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সাহায্য কর্মীরা এ বিষয়টি গান্ধীজী এবং হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী কে জানানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং জেলা পুলিশ সুপারিনটেণ্ডেট নিকটে একটি আদেশ প্রেরনের ব্যবস্থা করেন যেখানে ২২ মার্চে পাবলিক প্লেসে সকল প্রকার জনসভা,মিছিল, স্লোগান নিষিদ্ধ করা হয়।কিন্তু ব্যক্তিগত স্থান যেমন মাদ্রাসা,মসজিদে জনসভার অনুমতি দেয়া হয়। রামগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রেহান আলী মতামত দেন,জনসভা হবে মসজিদ সংলগ্ন আমতলি মাঠে। ফলে সরকারী নির্দেশের লঙ্ঘন হবে না। মুসলিম লীগের নেতারা যে কোন মুল্যে এই জনসভা করার সিদ্ধান্ত নেয়। মুসলিম লীগ নেতা মুহাম্মদ এরশাদ এবং মুজিবর রহমান জনসভায় মন্ত্রী আব্দুল গোফরানকে একজন বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ করে। ২৩ মার্চ প্রায় ৪০০০-৫০০০ মুসলিম রামগঞ্জ থেকে কাজীরখিল পর্যন্ত মিছিল করতে করতে আসে এবং পুনরায় রামগঞ্জে ফিরে যায়। এসময় তারা বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে এবং এভাবেই সমাবেশ স্থলে প্রবেশ করে। ওই সমাবেশে বক্তব্য দেবার সময়ে ইউনুস মিয়াঁ পণ্ডিত নামে একজন বক্তা হিন্দু সমাজের তীব্র সমালোচনা করে। সমালোচনায় সে হিন্দুদের ছুতমার্গ,পর্দা প্রথা না করা সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিশদ্গার করে এবং হিন্দুদের সাথে সকল প্রকার সামাজিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক বর্জনের আহ্বান করে।
১৯৪৭ সালের ১৩ মে তারিখে চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার উইলিয়াম ব্যারেট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব পি.ডি. মারটিনকে একটি গোপন নথি প্রেরণ করেন।সেখানে বলা ছিল, বাংলার প্রাদেশিক সরকার সুক্ষ ভাবে হিন্দু নির্যাতনে সহায়তা করছে। রিপোর্টে তিনি আরও উল্লেখ করেনঃ মুসলিমরা দল বেধে হিন্দুদের উপর আক্রমণ করে এবং হিন্দুদের মুল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। প্রায়ই পথিমধ্যে হিন্দুদের বাজার করে আনা মালামাল লুট করে নিয়ে যায় মুসলিমরা। হিন্দুদের নারকেল, সুপারি বাগান থেকে তারা জোর করে নারকেল সুপারি নিয়ে যায়। হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘর থেকে গবাদি পশু-পাখি লুট হয়ে যায়। হিন্দু দের বাড়ি ঘর থেকে লোহার টিন ও দামি কাঠের খিলান খুলে নিয়ে আসে। হিন্দুদের মালিকানায় থাকা সিনেমা হল গুলো তারা বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করে।মুসলিমরা শতকরা ৫০ ভাগ তাঁত দাবী করে যেখানে প্রায় সকল তাঁতের মালিক যোগী সম্প্রদায়ের হিন্দু। হাট-বাজার থেকে সকল হিন্দু ব্যবসায়ী এবং দোকান মালিকদেরকে বের করে দেয়ার চেষ্টা করে মুসলিমরা। যে সকল হিন্দু পুনরায় তাদের লুটপাটকৃত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ি-ঘর পুনঃনির্মাণের চেষ্টা করছিল তাদেরকে এলাকা ছাড়ার হুমকি দেয়া হয়।হিন্দুদেরকে পুলিশ স্টেশনে যে কোন অভিযোগ প্রদানে বাধা দেয়া হত এবং যে সকল হিন্দু কোন অভিযোগ দায়ের করেছিল তাদেরকে সে গুলো উঠিয়ে নেয়ার জন্য মুসলিমরা হুমকি দিত। হিন্দু দম্প্রদায়ের নারী-পুরুষদেরকে মুসলিমরা প্রকাশ্যে মালাউন, কাফের প্রভৃতি অপমানসূচক নামে সম্বোধন করত মুসলিমরা।১৩ মে তারিখে রিপোর্ট করা হয় যে, ধর্মপুর গ্রামে মুসলিমরা এক হিন্দু গৃহবধুকে ধর্ষণকালে উদ্ধার করা হয়। ১৬ মে তারিখে এরকম আরও দু’জন হিন্দু নারীকে উদ্ধার করা হয়।

বিহার ও অন্যান্য স্থানের দাঙ্গা এবং ভারত বিভাজন
১৯৪৬ নোয়াখালীর দাঙ্গার প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিহারে দাঙ্গার সুত্রপাত হয়। ৩০ অক্টোবর থেকে ৭ নভেম্বরের মধ্যকার সংগঠিত বিহার দাঙ্গার ফলে ভারত বিভাজন তরান্বিত হয়। ২৫ থেকে ২৮ অক্টোবরের মধ্যে বিহারের ছাপরা এবং শরণ জেলায় দাঙ্গা ছড়িয়ে পরে।শীঘ্রইপাটনা, মুঙ্গের, ভাগলপুরে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে।ফলে সরকারের পক্ষে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিত স্বাভাবিক রাখা ক্রমেই কঠিন হয়ে ওঠে এবং ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভাজন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।পরিকল্পিতভাবে সৃষ্ট দাঙ্গার নারকীয়তা-বীভৎসতা দেখে গান্ধী-নেহেরু তথা কংগ্রেস নেতৃত্ব জিন্নাহের নেতৃত্বে থাকা মুসলিম লীগের ভারত ভাগের দাবী মেনে নেন।

শেষ 

No comments:

Post a Comment