গত বছরের মাঝামাঝিতে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার সিমলা দীঘিপাড়া গ্রামে সাঁওতাল নারী মরিয়ম মুর্মুর গাছে বাঁধা লাশের ছবি দেখেছিলাম পত্রিকায়। সেই ছবি দেখে শিউরে উঠেছিলেন কেউ কেউ। আবারও আঁতকে উঠেছেন অনেকেই গত ৯ এপ্রিল পার্বত্য জেলা রাঙামাটির লংগদু উপজেলার আটরকছড়া ইউনিয়নের উল্টোছড়া প্রাইমারি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী ১১ বছরের সুজাতার লাশ দেখে। ধর্ষণের আলামতের সঙ্গে শিশুটির শরীরজুড়েই ছিল কাটা চিহ্ন। এর প্রতিবাদে, এই ঘটনার বিচার এবং অপরাধীর শাস্তির দাবিতে লংগদুসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে আদিবাসীরা প্রতিবাদ র্যালি ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। ঢাকার আদিবাসী শিক্ষার্থীরা করেছে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল। তবে এ দুটো ঘটনাতেই নির্যাতনের ধরন দেখে সাধারণ মানুষ যতটা আক্রান্তবোধ করেছে, কিন্তু অবাক হওয়ার বিষয় যে তারা সেইভাবে প্রতিবাদে ফেটে পড়েনি। পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী আদিবাসী শিশু সুজাতা চাকমাকে ধর্ষণ এবং হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ইব্রাহিম এর আগে সুজাতার মামাতো বোনকে ধর্ষণ করে এবং ১১ মাস সাজা পাওয়ার পর জেল থেকে বের হয়ে প্রতিশোধ নিতেই সুজাতাকে ধর্ষণ করে ও হত্যা করে। আদিবাসী নারী, শিশু হত্যা এবং ধর্ষণ এবারই প্রথম নয়। গত বছরও মে মাসে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার বোয়ালখালী ইউনিয়নের জিয়ানগরের কাছে পুলিশ একই বয়সী সুনিকা চাকমার মৃতদেহ উদ্ধার করেছিল এবং সেখানেও ধর্ষণের চিহ্ন ছিল। এর বিরুদ্ধেও স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিবাদ হয়েছিল।
একটি বিষয় লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, রাজশাহীর আদিবাসী নারী ৫৫ বছর বয়সী মরিয়ম মুর্মু আর পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী শিশু ১১ বছর বয়সী সুজাতা এবং সুনিকা সবার অবস্থান লাশের মিছিলে, সবাই একই ধরনের নির্যাতনের শিকার। এসব নির্যাতনের বিরুদ্ধেই আওয়াজ উঠেছে, তবে তা হয়তো অন্য আট-দশটা নির্যাতনের বিরুদ্ধে সমবেত প্রতিবাদ হিসেবে নয়। কারণ, সব আওয়াজের জোর এক নয়, সব প্রতিবাদের ঢংও এক নয়। যখন ঢাকা কিংবা এর আশপাশের এলাকায় কোনো নারী-নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, তখন আমাদের নড়াচড়া বেশি হয়। নিজ ‘শ্রেণী’, নিজ ‘এলাকা’, নিজ স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ আক্রান্ত হলে আমরা হূদয়ের সব ভালোবাসা, আবেগ, ক্ষোভ নিয়ে খুব অল্প সময়েই প্রতিবাদী হয়ে উঠি। অর্থাৎ আঘাতটি যদি নিজের পরিবারে, আত্মীয় কিংবা পরিচিতজনদের মধ্যে না হয়, তাহলে সেটি নিয়ে আমরা তেমনভাবে প্রতিবাদমুখর হই না। এর বাইরে আমাদের পরিচিত আরও কত ধরনের ধর্মীয়, জাতিগত, বর্ণগত দূরত্বের তকমায় ঠেসা। দূরত্ব অতিক্রম করে নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো আমাদের কাছে খুব বেশি সহজ হয়ে ওঠে না।আমরা জেনেছিলাম, রাজশাহীতে নির্যাতকেরা ঘমুন্ত মরিয়ম মুর্মুকে অসম্মানিত করেছিল। সেই অপরাধ করেও তাদের রাগ কমেনি তাঁর ওপর। এরপর তারা তাঁকে ধর্ষণ করেছে। তাতেও হয়নি। এরপর তাঁকে হত্যা করেছে। সেটাও শেষ ছিল না। মৃত্যু নিশ্চিত করার পর তাঁর মৃতদেহ গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল। তখনো তাঁর শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল। এই বীভৎস ঘটনার পর কয়েকটি আদিবাসী সংগঠন ছাড়া কেউ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কিংবা নিন্দা জানায়নি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোনো নারী সংগঠনের বিবৃতিও চোখে পড়েনি। রাঙামাটির শিশু সুজাতার বেলায়ও সেটি ঘটেছে। তাকে প্রথম ধর্ষণ করা হয়েছে। তাতে ক্ষোভ কমেনি ধর্ষকের। এরপর শিশু সুজাতাকে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম দেখা যায়নি। কিন্তু কেন? সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ফেসবুকে একজন সৌভাগ্য চাকমা প্রশ্ন ছুড়েছেন, বাংলাদেশের নারী এবং শিশু অধিকার রক্ষা আন্দোলনকারীরা আদিবাসী নারী, শিশু সুজাতার বিষয়টিতে কেন চুপ করে আছেন? এই প্রশ্নের উত্তরে এ কথা বললে খুব অত্যুক্তি হবে না যে বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের ঘরানা এখনো অনেক বেশি জাতীয়তাবাদী। মরিয়ম মুর্মু, সুনিকা চাকমা কিংবা সুজাতা চাকমার ক্ষত-বিক্ষত লাশের ছবি দেখে আমরা শুধুই চোখ বন্ধ করি কিন্তু আমাদের মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের হয় না। কেন হয় না? কারণ, আমরা বাঙালি নারীর বিষয়ে যতটা তৎপরতা দেখাই, ঠিক ততটাই উদাসীন থাকি কিংবা আমলে নিতে চাই না আদিবাসী নারী নিপীড়নকে। আমরা আরও ভাবি, এটি আদিবাসীদের বিষয়, তারাই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে, ঠিক যেমন অনেক পুরুষই নারী-নির্যাতনকে ‘নারীর বিষয়’ হিসেবে পাঠ করেন এবং এর প্রতিবাদ নারীরই করা উচিত বলে মনে করেন। নির্যাতনকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে দেখতে পান না। আমরা কি সেই পুরুষদের থেকে ভিন্ন? হয়তো নয়। ঠিক একই ধরনের চিত্র দেখা গিয়েছিল ১২ বছর আগেও, যখন গারো নারী গিদিতা রেমাকে হত্যা করা হয়, তখনো বুদ্ধিজীবী মহল, নারী আন্দোলনের কর্মীরা চুপ ছিলেন। শহীদ মিনারে আদিবাসীরাই প্রথম প্রতিবাদ সমাবেশ করেছিল। আর এই অবিরত ‘আমরা’-‘অপর’ কিংবা ‘আমরা’-‘তারা’ নির্মাণের মধ্য দিয়ে নিপীড়ন চিহ্নিতকরণ এবং এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়তই একধরনের ‘আমতা-আমতা’ এবং ‘গাঁইগুঁই’ ভাবের মধ্যে নিজেদের গুটিয়ে ফেলি। সীমাবদ্ধ পরিসরে নিজেকে স্থাপন করার বিনিময়ে নিজেদের ক্রমশ ছিটকে ফেলি মানবতার লড়াইয়ের ময়দান থেকে। আর এভাবেই পাহাড়ি ছড়ার (ঝরনা) পানি শিশু সুজাতা চাকমার রক্তে ভাসে আর মরিয়ম মুর্মুরা লাশ হয়ে গাছে ঝোলে। আর কত দিন এগুলো শুধুই ‘আদিবাসী’ বিষয় মনে করা হবে? দূরত্ব বজায় রেখে এগুলো এড়িয়ে যাওয়া হবে? আর কত দিন আমরা এই ভয়ংকর নির্যাতনের ছবি দেখে চোখমুখ ঢাকব? আর কত দিন আমরা সুজাতা চাকমা, মরিয়ম মুর্মুর কিংবা সুনিকা চাকমার ওপর নিপীড়নকে আমাদের নিপীড়নের অংশ নয় বলে হজম করে যাব? জোবাইদা নাসরীন: সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পিএইচডি গবেষক, ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য। সুজাতা উপজেলার আটরকছড়া ইউনিয়নের উল্টোছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির ছাত্রী এবং উল্টোছড়ি গ্রামের মৃত জ্যোতিষ চন্দ্র চাকমার মেয়ে।
লংগদু থানার ওসি রেজাউল হক বাংলানিউজকে জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ৭টায় মাইনী এলাকার গাটাছড়া গ্রাম থেকে ইব্রাহিমকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বাড়ি যশোর সদর উপজেলার বলেন্দি গ্রামে।
তিনি জানান, ইব্রাহিমের প্রকৃত নাম কাঞ্চন চন্দ্র বিশ্বাস। কয়েক বছর আগে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে নিজের নাম রাখেন ইব্রাহিম এলাহি। তার বর্তমান বাড়ি লংগদুর ইয়ারেংছড়িতে।
তিনি আরও জানান, বৃহস্পতিবার ভোরে গাটাছড়া এলাকা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় লোকজন অপরিচিত ও উসকোখুসকো চেহারার লোক দেখে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এ সময় তার কথায় অসঙ্গতি পেলে তারা পুলিশকে খবর দেয়। পরে পুলিশ এসে ইব্রাহিমকে আটক করে।
ওসি রেজাউল হক জানান, ২০১১ সালের ১৫ জুন একই এলাকায় সুজাতার মামাতো বোন বিশাখা চাকমাকে ধর্ষণের অভিযোগে প্রায় ৮ মাস জেলে থাকার পর সম্প্রতি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান ইব্রাহিম।
জেল থেকে বের হয়েই তিনি আবার সুজাতাকে ধর্ষণের পর হত্যা করেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি এ কথা স্বীকার করেছেন।
জানা গেছে, বুধবার দুপুরে শিশু সুজাতা চাকমা ৬ বছর বয়েসী এক শিশুসহ উল্টোছড়ি গ্রাম থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে গরু আনতে যায়। বেলা আড়াইটা থেকে ৩টার মধ্যে ইব্রাহিম সুজাতাকে জোর করে সাদাছড়া নামে একটি পাহাড়ি ছড়ার ওপরের দিকে নিয়ে যান।
এসময় ওই শিশুটি দৌড়ে গ্রামে এসে লোকজনকে খবর দিলে লোকজন ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে সুজাতার লাশ উদ্ধার করে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী শিশুটির উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, একজন দাড়িওয়ালা বাঙালি সুজাতাকে জোর করে ছড়ার ওপরের দিকে নিয়ে যায়।
এ ঘটনায় আটারকছড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মঙ্গল কুমার চাকমা বুধবার বাংলানিউজকে জানিয়েছিলেন, গ্রামের লোকজন ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই ধর্ষক শিশুটিকে হত্যা করে পালিয়ে যায়। শিশুটির গলায় ও বাহুতে কাটা চিহ্ন রয়েছে।
এদিকে, এ ঘটনার পর নিহত সুজাতার ভাই বিকন চাকমা বুধবার রাতেই লংগদু থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
No comments:
Post a Comment