Pages

Tuesday, September 25, 2012

১০ বছরে ৯ লাখ হিন্দু কমেছে




২০০১ ও ২০১১ সালের শুমারির জেলাভিত্তিক তথ্য পাশাপাশি রাখলে দেখা যায়, ১৫টি জেলায় হিন্দু জনসংখ্যা কমে গেছে। বিবিএসের কর্মকর্তারা বলেছেন, এসব জেলার হিন্দুরা দেশের অন্য কোনো জেলায় চলে গেছে, পরিসংখ্যান তা বলছে না। অর্থাৎ, অন্য জেলায়ও হিন্দু জনসংখ্যা বাড়েনি। কর্মকর্তারা এদের বলছেন, ‘মিসিং পপুলেশন’ বা ‘হারিয়ে যাওয়া মানুষ’। 

বরিশাল বিভাগের কোনো জেলাতেই হিন্দুদের সংখ্যা বাড়েনি। বরিশাল, ভোলা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা—এই ছয়টি জেলায় ২০০১ সালের আদমশুমারিতে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল আট লাখ ১৬ হাজার ৫১ জন। ২০১১ সালের শুমারিতে সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে সাত লাখ ৬২ হাজার ৪৭৯ জনে।
খুলনা বিভাগের বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা—পাশাপাশি এই তিন জেলায় হিন্দুদের সংখ্যা আগের চেয়ে কমেছে। বিভাগের নড়াইল ও কুষ্টিয়া জেলার প্রবণতা একই। ঢাকা বিভাগের মধ্যে এ তালিকায় আছে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও কিশোরগঞ্জ জেলা। অন্যদিকে রাজশাহী বিভাগের পাবনা জেলায়ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে হিন্দু বাড়েনি।
স্বাধীনতার আগের দুটি ও পরের পাঁচটি শুমারির তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মোট জনসংখ্যার তুলনায় হিন্দুদের সংখ্যা ও হার কমেছে। মুসলমানদের সংখ্যা ও হার সব সময়ই বেড়েছে। বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর হার মোটামুটি একই ছিল বা আছে। 
প্রবীণ রাজনীতিক ও গণঐক কমিটির আহ্বায়ক পঙ্কজ ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, সাম্প্রদায়িক আবহ তৈরি করে সম্প্রীতি নষ্ট করায় এমনটা ঘটছে। জামায়াতের মতো শক্তিগুলো পরিকল্পিত ও নিয়মিতভাবে নানা ঘটনা ঘটাচ্ছে। সাম্প্রতিককালে চট্টগ্রামের হাটহাজারী, সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ, কুড়িগ্রামের চিরিরবন্দরে ধর্মীয় জিগির তুলে মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরির চেষ্টা লক্ষ করা গেছে। তিনি বলেন, সংখ্যালঘুদের পাশে কেউ দাঁড়াচ্ছে না, তাদের আশ্বস্ত করছে না। নীরবে তাই দেশত্যাগ হচ্ছেই। 
কেন কমছে: একাধিক শুমারির প্রতিবেদনে হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে মোট প্রজনন হার (টোটাল ফার্টিলিটি রেট—টিএফআর) তুলনামূলকভাবে কম বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু এর পক্ষে কোনো তথ্য পরিসংখ্যান ব্যুরোর কাছে চেয়ে পাওয়া যায়নি। 
তবে গোপালগঞ্জ, বরিশাল, ভোলার বিভিন্ন গ্রামে কথা বলে জানা গেছে, হিন্দুদের সংখ্যা কমে যাওয়ার বড় কারণ দেশত্যাগ। কয়েকটি জেলার লোকজন বলেছেন, ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগের সময় থেকে এই ভূখণ্ড ছেড়ে যাওয়া হিন্দু সম্প্রদায়ের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা। কেউ বলেছেন, মূল কারণ শত্রু সম্পত্তি আইন। বলেছেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের চাপ ও নির্যাতনে পড়তে হয় হিন্দুদের। অন্যদিকে ভারতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা দিলে তার আঁচও লাগে এ দেশের হিন্দুদের গায়ে। 
‘বুক বেঁধে দাঁড়াবার সংস্কৃতি কমে গেছে’—এমন মন্তব্য করেছেন ড. আনিসুজ্জামান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ইমেরিটাস অধ্যাপক বলেন, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার অভাববোধ বাস্তব ও অনুমিত। সম্পত্তি দখলের উদ্দেশ্যে কিছু লোক নানা ঘটনা ঘটাচ্ছে। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয়ভাবে কিছু নেতা বা রাজনৈতিক দল সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে স্থানীয় পর্যায়ে সেই প্রতিশ্রুতি পালিত হয় না, কর্মী পাওয়া যায় না। 
আতঙ্ক আছে চাঁদশী-ইল্লা-ধানডোবায়: বরিশাল জেলার গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া উপজেলা থেকে বেশ কিছু হিন্দু পরিবার ২০০১ সালের পর এলাকা থেকে চলে গেছে। 
ধানডোবা গ্রামে গিয়ে জানা যায়, মনোজ বৈদ্য তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে ২০০১ সালের নির্বাচনের দুই দিন পর বাড়ি ছেড়ে চলে যান। আর ফিরে আসেননি। মনোজের প্রতিবেশী সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ওই নির্বাচনের পরদিনই বিএনপির কর্মীরা গ্রামের হিন্দু ও খ্রিষ্টানবাড়িতে আক্রমণ ও লুটপাট করেন। তাঁরা মনোজের বাড়ি থেকে গরু, ধান নিয়ে যান। পানের বরজ নষ্ট করেন।
ইল্লা গ্রামের কালীপদ দফাদার, সুবল দফাদার, মন্টু দফাদার, জয়দেব নন্দীর পরিবারও দেশ ছেড়ে চলে যায় ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সন্ত্রাসের কারণে। একই কারণে সুতারবাড়ি গ্রামের আদিত্য নাগ ও সুবল দে পরিবার নিয়ে দেশ ছেড়েছেন।
৩ নম্বর চাঁদশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কৃষ্ণকান্ত দে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর নিজের পরিবার, আত্মীয়, প্রতিবেশীসহ অনেক পরিবারে আক্রমণ, লুটপাট ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল। ওই ইউনিয়ন থেকে কোনো পরিবার এলাকা ছেড়ে যায়নি। তবে অনেক পরিবারের অংশবিশেষ দেশে থাকে না। তিনি বলেন, ‘ধরেন, কোনো পরিবারে পাঁচ ভাই আছে, তাদের দুই ভাই দেশে থাকে না।’ 
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজল দেবনাথ বলেন, সম্মান রক্ষায় অনেক বাবা-মা অল্প বয়সে মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছেন, অথবা ভারতে রেখে স্কুলে বা কলেজে পড়াচ্ছেন। তবে তিনি দাবি করেন, দেশত্যাগের প্রবণতা কমেছে। শত্রু সম্পত্তি (অর্পিত সম্পত্তি) নিয়ে সরকারের উদ্যোগ পুরোপুরি সফল না হলেও সংখ্যালঘুরা আশা করছে, সম্পত্তি আর হাতছাড়া হবে না বা হাতছাড়া সম্পত্তি ফেরত পাবে। এখন বড় বড় শহরে হিন্দুরা বাড়ি করছে, ফ্ল্যাট কিনছে।
ভোলার পরিস্থিতি: বিবিএস পরিসংখ্যান বলছে, ভোলা জেলায় ২০০১ সালে হিন্দু ছিল ৭২ হাজার ২৭৫ জন। সর্বশেষ শুমারিতে দেখা যাচ্ছে, জনসংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৬১ হাজার ১৬২ জনে। 
ভোলা জেলার দৌলতখান উপজেলার চরপাতা ইউনিয়নের নলগোড়া গ্রামের সাধু সিংয়ের বাড়িতে ছিল ছয়টি পরিবার। পরিবারের প্রধান ছিলেন লক্ষ্মী নারায়ণ সিং। লক্ষ্মী নারায়ণ ১৯৯২ সালের পরে জমিজমা বিক্রি করে চলে যান। ওই গ্রামের লোকজন প্রথম আলোকে বলেছেন, ১৯৯২ সালের পর থেকে হিন্দু পরিবারগুলো চলে যেতে শুরু করে। ওই সময় বাররি মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে ভারতে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল, তাতে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকার হয় এই গ্রামের মানুষ। 
২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনের পরও অনেক পরিবার চলে গেছে। গ্রাম ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৯২ সালের পর থেকে সুতারবাড়ির চারটি, ডাক্তারবাড়ির ১০, মাঝের সিংবাড়ির ছয়, রাস কমল হাওলাদার বাড়ির সাত, লক্ষ্মীকান্ত হাওলাদার বাড়ির তিন, তীর্থবাস হাওলাদার বাড়ির সাত, পরেশ হাওলাদার বাড়ির সাত, তেলীবাড়ির তিন, রাধেশ্যাম সুতারবাড়ির তিন, মন্টু হাওলাদার বাড়ির এক এবং রাড়ি বাড়ির সব কটি পরিবারসহ গ্রামের ৭৫টি বাড়ির দুই শতাধিক পরিবার চলে গেছে।
উপজেলার নলগোড়া, লেজপাতা ও চরগুমানী—এই তিনটি গ্রাম ছিল হিন্দু-অধ্যুষিত। স্বাধীনতার সময় এই গ্রামে চার শতাধিক বাড়ি ছিল। এই গ্রামগুলোর ১৭২টি বাড়ির কয়েক শ পরিবার চলে গেছে। 
বোরহানউদ্দিন উপজেলার টবগী ইউনিয়নের মুলাইপত্তন গ্রামে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এক হাজারের বেশি হিন্দু পরিবার ছিল। বর্তমানে সেখানে আছে ৪৪টি পরিবার। 
লালমোহন উপজেলার লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নে চারটি গ্রাম ছিল হিন্দু-অধ্যুষিত। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এই ইউনিয়নে চার হাজার ৬০০ হিন্দু ভোট ছিল। ইউনিয়নের অন্নদাপ্রসাদ গ্রামের যাত্রামণি লস্কর বলেন, ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদের ঘটনা ও ২০০১ সালে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে গ্রামগুলোর অধিকাংশ হিন্দু পরিবার এলাকা ছেড়ে চলে যায়। স্থানীয় ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রের দেওয়া তথ্যে বলা হচ্ছে, বর্তমানে ইউনয়নে হিন্দু ভোটারের সংখ্যা ৬০০। 
গোপালগঞ্জ: গোপালগঞ্জ জেলায় আওয়ামী লীগের একক প্রাধান্য। সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, দলটির সঙ্গে সংখ্যালঘুদের সুসম্পর্ক আছে। স্বাধীনতার পর জেলায় সাম্প্রদায়িক সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনাও উল্লেখ করার মতো নয়। তার পরও এই জেলা থেকে নিয়মিতভাবে হিন্দুরা চলে যাচ্ছে। ২০০১ সালে এই জেলায় হিন্দু ছিল তিন লাখ ৭১ হাজার ৬২৯ জন। ১০ বছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৫৩ হাজার ৭৯৪ জনে।
জেলার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রবীণ সাংবাদিক প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘শত্রু সম্পত্তির’ নির্যাতন চেপে আছে প্রায় ৫০ বছর ধরে। এরপর বড় আঘাত আসে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার মধ্য দিয়ে। এসব ব্যাপারে আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। 
একটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বলেছেন, উপযুক্ত হওয়ার পরও জেলা আওয়ামী লীগে সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকের পদ ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা পায় না। সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজের সংসদে হিন্দু শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ পদ সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস)। ছোট গোপালগঞ্জ শহরে বড় দলের নেতারা সংখ্যালঘুদের বাড়ি-সম্পত্তি দখল করে দিব্যি বসবাস করছেন। এসব দৃশ্য দেখে নিরাপদ বোধ করে না হিন্দুরা।
গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি সম্পর্কে কাজল দেবনাথের মন্তব্য, ‘প্রদীপের নিচে অন্ধকার।’
উদ্যোগ নেই: দেশত্যাগ বন্ধের উদ্যোগ এসব এলাকা ঘুরে দেখা যায়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গোপালগঞ্জ জেলার একজন চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘নিরাপদে জমি-বাড়ি যেন বিক্রি করতে পারে, সে ব্যাপারে কিছুটা সাহায্য করার চেষ্টা করি। থেকে যেতে বলতে পারি না।’
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ, পূজা উদ্যাপন পরিষদ মাঝেমধ্যে জেলা, উপজেলা পর্যায়ে সভা ও সেমিনার করে। এসব সভা-সেমিনারে দেশ না ছাড়ার, নির্যাতনের প্রতিবাদ করার কথা বলা হয়। কাজল দেবনাথের দাবি, এতে কাজ হচ্ছে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নেয়ামতউল্লাহ (ভোলা প্রতিনিধি), সুব্রত সাহা (গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি) ও জহুরুল ইসলাম (গৌরনদী, বরিশাল প্রতিনিধি)]

No comments:

Post a Comment