Pages

Wednesday, September 12, 2012

মনমোহনকে এক পাকিস্তানির খোলা চিঠি




ফাইজা মির্জা, পাকিস্তানের বিখ্যাত ইংরেজি পত্রিকা ‘দ্য ডন’-এর একজন সাংবাদিক। দেশটির বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থায় বিব্রত ও বিরক্ত ফাইজা সম্প্রতি ডনের ব্লগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের উদ্দেশে একটা খোলা চিঠি লেখেন। ফাইজার এই খোলা চিঠিতে ফুটে উঠেছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সরকারগুলোর সীমাহীন ব্যর্থতার আখ্যান। প্রথম আলোর পাঠকদের ফাইজা মির্জার চিঠিটি হুবহু প্রকাশ করা হলো। 


প্রিয় মনমোহন সিং,
আমি আমার জীবনে কোনো দিন আপনার মাপের কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলিনি। সুতরাং চিঠিতে আমার বক্তব্যের সহজ বিষয়টিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন বলে আশা করি। প্রথমেই, পাকিস্তানের নয় শরও বেশি সংখ্যালঘু হিন্দুকে ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যাপারটি বিবেচনা করার জন্য আপনাকে অভিনন্দন জানাতে চাই। এটা সত্যিই ওই হিন্দুদের জন্য আপনার চমত্কার এক বদান্যতা, যারা একসময় পাকিস্তানে বসবাস করত। কিন্তু আপনাকে বিবেচনায় রাখতে হবে যে পাকিস্তানে হিন্দু ছাড়াও খ্রিষ্টান এমনকি মুসলমানেরাও সত্যিকার অর্থে শান্তিতে জীবনযাপন করতে পারছে না।
আমি জানি, হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা আপনার সরকারের অগ্রাধিকার। কারণ, আপনার সরকারের অনেকেই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। আমি তার পরও আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই ওই হাজারাদের দিকে, যাদের প্রায় প্রতিদিনই প্রকাশ্য দিবালোকে পাকিস্তানের রাজপথে কোনো না কোনো শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই ওই খ্রিষ্টানদের জন্য, যারা পাকিস্তানে নিদারুণ আতঙ্কের মধ্যে জীবনযাপন করছে; ব্লাসফেমি আইনে, যেকোনো সময়ই সেই খ্রিষ্টানদের গ্রেপ্তার করা হতে পারে অথবা হত্যা করা হতে পারে। আমি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সাধারণ মানুষের প্রতি, যারা প্রায় প্রতিদিনই জঙ্গি অথবা মার্কিন ড্রোন হামলার শিকার হয়ে মারা যাচ্ছে। আমি হিন্দুদের পাশাপাশি এসব মানুষের সমস্যাগুলোর দিকেও আপনার সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, যদিও আমি জানি না এদের নিয়ে আপনার বা আপনার সরকারের কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কি না।
আপনার ও আপনার সরকারের মানুষজনের নিশ্চয়ই পাকিস্তানের আহমেদিয়াদের সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছে। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, পাকিস্তানের আহমেদিয়ারা ধর্মীয় কারণে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কী ধরনের যন্ত্রণা ভোগ করছে! আমি আপনাকে অনুরোধ জানাব, পাকিস্তানের ওই মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে, যারা পাকিস্তানি সমাজে পরিবর্তন আনতে চায়। তাদের সঙ্গে কথা বললেই আপনি বুঝতে পারবেন, যারা পাকিস্তানের সমাজ-ব্যবস্থায় পরিবর্তন নিয়ে আসতে চায়, তারা কীভাবে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। কিন্তু কেন তারা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে, কেন তাদের জীবন হুমকির মুখে পড়ছে, ব্যাপারগুলো ওইসব মানুষের কাছে একেবারেই দুর্বোধ্য। 
আমি নিশ্চিত যে রাজনৈতিক আশ্রয়বিষয়ক সব ধরনের খুঁটিনাটিই আপনার নখদর্পণে। এটা সত্যি, সব শ্রেণীর পাকিস্তানিদের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা কিংবা অস্ট্রেলিয়াতে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে ভারত তাদের জন্য একমাত্র আশার আলো। পাকিস্তান থেকে আটারি সীমান্ত দিয়ে খুব অল্প খরচে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য শুধু ভারতে যাওয়া সম্ভব।
পাকিস্তানে অনেক মানুষের মধ্যে হতাশার মাত্রাটা এতটাই বেশি যে তারা যেকোনো মূল্যে আফগানিস্তানের মতো দেশে গিয়েও পালিয়ে বাঁচতে চায়। অথচ এই আফগানিস্তানের মানুষই একটা সময় পাকিস্তানে শরণার্থী হিসেবে আসতো।
আমরা সবাই আপনার সরকারের মানবিক নীতিগুলোর প্রশংসা করি। আমরা চাই পাকিস্তানের নির্যাতিত হিন্দু, যারা প্রাণের ভয়ে ভারতে চলে গেছে, আপনার সরকার তাদের নাগরিকত্ব প্রদানের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করবে। তবে এ ক্ষেত্রে আপনাকে জানানো জরুরি যে পাকিস্তানে ভিন্নধর্মাবলম্বীরা সবাই নানাভাবে নির্যাতনের শিকার এবং তাদের সবাইকে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের সুযোগ দেওয়া উচিত। এই সুযোগটি কেবল হিন্দুদের জন্য থাকবে, তা বোধ করি ঠিক নয়। যেখানে ভারত সরকার ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সীমান্তে পাকিস্তানে নির্যাতনের শিকার হয়ে আসা যেকোনো মানুষকেই খাদ্য সরবরাহের নীতিগত পরিকল্পনা নিয়েছে, সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয়ের সুযোগটিও হিন্দুদের পাশাপাশি অন্যান্য সংখ্যালঘু ও নির্যাতিতদের জন্য অবারিত করে দেওয়া উচিত।
পাকিস্তান থেকে যেসব হিন্দু ভারতে চলে গেছে এবং সেখানে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের প্রত্যাশা করছে, তাদের ব্যাপারে ভারত সরকারের অনেকেই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। এমনই একজন হলেন লক্ষ্মীকান্ত চাওলা। তিনি বলেছেন, ‘যেখানে পাকিস্তান সরকার সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে ভারত সরকারের উচিত এই নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের দেখভালের দায়িত্ব নেওয়া।’
এ ক্ষেত্রে আমি আশা করব, মি. চাওলার মন্তব্যের সূত্র ধরে আপনি পাকিস্তান সরকারের প্রতি রুষ্ট না হয়ে পুরো ব্যাপারটি একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখবেন। পাকিস্তান সরকার এই মুহূর্তে অনেক সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত। সর্বোচ্চ আদালতের সঙ্গে সরকারের এই মুহূর্তে ঠান্ডা লড়াই চলছে। যেখানে পাকিস্তান সরকার সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে স্বার্থের সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে, সেখানে তাদের সাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখার সময় কোথায়? আপনাকে বুঝতে হবে, পাকিস্তান সরকার শুধু সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষা কিংবা তাদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতেই ব্যর্থ হয়নি, তারা ব্যর্থ দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতেও। 
অনেক পাকিস্তানিই হয়তো ব্যাপারটি সরাসরি স্বীকার করবে না, কিন্তু বেশির ভাগ শিক্ষিত ও প্রগতিশীল পাকিস্তানিই এই মুহূর্তে ভারতীয় নাগরিকত্বের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তাভাবনা করছে। এর নেপথ্য কারণ, ১৯৪৭ সালের পর দারিদ্র্য ও অন্যান্য সমস্যা সত্ত্বেও ভারত একটি জাতি, একটি অর্থনীতি, একটি রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। আমরা মনে করি, ভারতের রয়েছে একটি প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থা। রাষ্ট্র হিসেবে ভারত শাসিত হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকদের দ্বারা। ভারতের সংসদ ও রাজনীতিতে ফ্যাসিস্ট রাজনীতির জায়গা খুব সীমিত। ভারতের জনগণের কাছেও ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাপারটি ভালো কিছু হিসেবেই পরিগণিত। 
আপনারা একজন কাসাবকে আটকে রেখেছেন। কিন্তু আপনারা কী জানেন, এই পাকিস্তানে আরও কত হাজার হাজার কাসাব ঘুরে বেড়াচ্ছে, যারা প্রতিনিয়ত পাকিস্তানের সাধারণ মানুষকে ‘নাস্তিক’, ‘ইসলামবিরোধী’, ‘ভারতের দালাল’, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পুতুল’, ‘কমিউনিস্ট’ ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত করছে!
আমরা যারা সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখি, তারা রীতিমতো অসহায় বোধ করি, যখন দেখি এই দেশে (পাকিস্তান) কট্টরপন্থীরা নির্ভয়ে ও দম্ভ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আমাদের সান্ত্বনার জায়গাটা কোথায়? 
গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমি পাকিস্তানে বাস করছি ঠিকই, কিন্তু সব সময় খুঁজে বেড়াচ্ছি বসবাসের উপযোগী একটি নিরাপদ দেশ। আমি সেই দেশে বাস করতে চাই, যে দেশে আমি নিজেকে প্রকাশ করতে পারব দ্বিধা ও ভয়হীন চিত্তে। 
কিছুদিন আগে করাচির রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে একটি পোস্টারে আমার চোখ আটকে যায়। সেই পোস্টারে ছিল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি, আর নিচে লেখা ছিল, ‘পাকিস্তান তোমায় চায়’। 
পোস্টারটি দেখার পর আমার মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়। প্রথমবারের মতো আমি অনুভব করি, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আমাদের যে পাকিস্তান দিতে চেয়েছিলেন, সেটা বিনির্মাণে আমরা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছি। 
আমার আগের ও পরের অনেকের মতোই আমি এই মুহূর্তে একটি নিরাপদ মাটির সন্ধানে রয়েছি, যেখানে আমার জীবনের মূল্য থাকবে, থাকবে নিরাপত্তা। আমি সেই নিরাপদ মাটির সন্ধানেই দেশের মানুষদের ছেড়ে চলে যেতে চাই। লড়াই চালাতে চাই ওই সব ক্ষতিকর বিষয়ের বিরুদ্ধে যা এই মুহূর্তে আমার মাতৃভূমি পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
আমি জানি না আমাকে ভারতে চলে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে কি না। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে তখনই, যখন দেখব ভারত সরকার রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রশ্নে হিন্দুদের সঙ্গে আমাকেও একই পাল্লায় বিচার করছে।
ইতি,
আপনার অনুগত 
প্রগতিশীল পরিবর্তনের জন্য সচেষ্ট পাকিস্তানিদের একজন

No comments:

Post a Comment