বর্ণপ্রথা বর্তমান হিন্দু সমাজের একটি অংশ হয়ে গেছে। বর্ণপ্রথা আজ সমাজে বর্ণ ভেদ বলে পরিচিত।এ লেখায় আমরা আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বিশেষ করে আদি ও প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদের আলোকে বর্ণপ্রথার সঠিক বিশ্লেষণ ও বর্তমান যুগের প্রেক্ষিতে এর উপযোগিতা বর্ণনা করার চেষ্টা করব।
শুরুতেই জেনে রাখা ভাল বর্ণ প্রথা বলে ধর্মগ্রন্থ সমূহে কোন শব্দ বা টার্ম নেই। আছে ‘বর্ণাশ্রম’। শাব্দিক অর্থ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ‘বর্ণ’ শব্দটি এসেছে ‘Vrn’ থেকে; যার অর্থ ‘to choose’ বা পছন্দ করা অর্থাৎ পছন্দ অনুযায়ী আশ্রম বা পেশা নির্ধারণ করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমাদের সমাজে এখন তা জন্মসূত্রে বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ বাঙালী হিন্দুদের নামের পাশে চট্টপাধ্যয় ,ভট্টাচার্য দেখলেই আমরা মনে করি সে ব্যাক্তি ব্রাহ্মণ সন্তান এবং জন্ম সুত্রে তিনি নিজেও ব্রাহ্মণ।
তবে আজ সমাজে যে বর্ণ ভেদ আমরা দেখতে পাই এর একটি ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে,আছে এক বিবর্তনের ইতিহাস। যে বিবর্তনের ধারায় বর্ণাশ্রম এক সময় বর্ণ প্রথা তারপর বর্ণভেদে পরিণত হল। এ ইতিহাসটুকু না জানলে আজ আমরা অনেকেই হয়ত বৈদিক সমাজের চিন্তা বিদগণকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাড় করাব।
বৈদিক ইতিহাস থেকে জানা যায় আদিতে সমাজের দুটি প্রধান অংশ ছিল। একটি অংশকে বলা হত দ্বিজ বা ব্রাহ্মণ। তাদের স্বতন্ত্র চিন্তাশক্তি ও কর্মদক্ষতা ছিল। অর্থাৎ তাঁরা শিক্ষা দীক্ষায় অধিক অগ্রসর ছিলেন। ঠিক যেমন বর্তমান সমাজের একটা অংশ শিক্ষায় উন্নত; যারা সমাজে সুশীল সমাজ হিসেবে পরিচিত।আর অন্য অংশটির নাম ছিল দ্বিজতোর বা শূদ্র যারা ছিল সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশ। কিন্তু এ বিভাজন জন্মসূত্রে ছিল না,ছিল কর্ম, গুন, পেশা, দক্ষতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে। [সে যুগে অনেক জন্মসূত্রে দ্বিজতর বা শূদ্র ব্যক্তি দ্বিজত্ব লাভ করেন- যা আমরা পরে দেখাব।]
সব সমাজ সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হতে থাকে । ফলে সমাজস্থ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের রুচি ও চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে ধীরে ধীরে।এতে সমাজে কর্ম বণ্টনের প্রয়োজন সৃষ্টি হয়। তৈরি হয় নব নব কর্ম ক্ষেত্র, পেশা ও বৃত্তির। সমাজের এই শাশ্বত ধারা এখনকার আধুনিক সমাজেও দৃষ্টি গোচর হয়।
এ ভাবেই আদি সমাজ তার পরিবর্ধনের সাথে নানা পেশা ও বৃত্তির উদ্ভব হতে থাকে। আর সমাজের একটি নির্দিষ্ট অংশ ঐ পেশায় দক্ষ হয়ে অথে।উদাহরনস্বরূপ আমরা আলোচনা করতে পারি যারা মাটির কাজ করেন অর্থাৎ পাল সম্প্রদায়ের কথা। যেহেতু পূর্বে বর্তমানের মত কর্ম ক্ষেত্রের এত সংখ্যাধিক্য ছিল কারণ সমাজের নির্দিষ্ট কিছু চাহিদার প্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট কিছু পেশা ছিল তাই একজন পাল সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের সন্তান তাঁর পারিপার্শ্বিক ও স্বভাবসিদ্ধ বা বংশগত কারনেই মাটির কাজে দক্ষ হয়ে ওঠেন এবং পিতার পরেই পুত্র উত্তরাধিকার সূত্রে এ পেশাকে আঁকড়ে ধরেন। এভাবে সমাজ বিজ্ঞানের সুত্রমেনে ক্রমান্বয়ে পেশা গুলো হয়ে উঠল বংশগত।সঙ্ঘবদ্ধতা মানুষের স্বভাব তাই পাশপাশি কয়েকটি পাল পরিবার মিলে গড়ে উঠল পাল পাড়া বা পাল পল্লী। এতে সমাজে ঐক্যবদ্ধতা এল, বাড়ল সামাজিক নিরাপত্তা।এ ধরনের সমাজে সামাজিক মর্যাদার সমতা রক্ষা হত ।ফলে পারস্পরিক সহযোগিতা সহজতর হয়ে উঠল।পরস্পরের মধ্যে সহজ ও সাবলীল সম্পর্ক গড়ে উঠল তাদের সম মর্যাদার ভিত্তিতে।সমাজ নির্মাণের এ ধ্রুব সত্য মেনে তাঁরা নিজেদের ছেলে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে সম্পর্কে দৃঢ় করল।সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে তাঁরা একে অপরের পরিপূরক হয়ে উথল।আজকের দিনে অনেকেই ভিন্ন সমাজে নিজেদের সন্তানদের বিয়ে দিতে চান না; ভাবেন এতে বুঝি ধর্মের অবমাননা হয়। এবার একটু চিন্তা করে বলুন তো একজন শিক্ষকের ছেলের সাথে কি চিকিৎসকের মেয়ের বিয়ে দিতে ধর্মের কোন বাধা আছে?নাই।তেমনি বিভিন্ন বর্ণের বা পেশার মধ্যেও আত্মীয়তা করতে ধর্মে কোন নিষেধ নাই। আবার একজন ব্যবসায়ী চাইতে পারেন তাঁর ছেলেকে বিয়ে দেবেন তাঁর পরিচিত অন্য একজন ব্যবসায়ীর মেয়ের সাথে; কারণ তাঁদের দু পরিবারের সামাজিক মর্যাদা বা স্ট্যাটাস সমান আর পরিবার দুটির মধ্যে সুসম্পর্ক রয়েছে।আসলে বর্ণপ্রথার ধারণটাও এর ব্যতিক্রম নয়।
বর্তমান সমাজে পেশা বৃত্তি উন্মুক্ত ও সহজলভ্য। সমাজের যে কেউ শিক্ষা অর্জন করে যে কোন পেশায় অংশগ্রহণ করতে পারেন।তাই এ সমাজে আদি সমাজের বর্ণপ্রথার উপযোগিতা হারিয়েছে। যে প্রথা একসময় সময়ের প্রয়োজনে সৃষ্টি হয়েছিল তা সমাজের সাথে সাথে মূল্যহীন হয়ে গেছে।এ সমাজে একজন অশিক্ষিত কৃষকের সন্তানও চিকিৎসক, প্রকৌশলী ,আইনজীবী বা যে কোন ধরনের পেশা বেছে নিতে পারেন তাঁর মেধা, যোগ্যতা, শিক্ষার গুনে।
আসুন এবার দেখি সনাতন সমাজে বহুল প্রচলিত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র সম্পর্কে আমাদের পবিত্র ‘বেদ’ এ কি আছে—
ঋগবেদ ১.১১৩.৬
"একজন জ্ঞানের উচ্চ পথে(ব্রাক্ষ্মন) ,অপরজন বীরত্বের গৌরবে(ক্ষত্রিয়) , একজন তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে(পেশাভিত্তিক), আরেকজন সেবার পরিশ্রমে(শূদ্র)। সকলেই তার ইচ্ছামাফিক পেশায়,সকলের জন্যই ঈশ্বর জাগ্রত।
ঋগবেদ ৯.১১২.১
একেকজনের কর্মক্ষমতা ও আধ্যাত্মিকতা একেক রকম আর সে অনুসারে কেউ ব্রাক্ষ্মন কেউ ক্ষত্রিয় কেউ বেশ্য কেউ শূদ্র।
ব্রাক্ষ্মন কে? ঋগবেদ ৭.১০৩.৮
যে ঈশ্বরের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত, অহিংস,সত্,নিষ্ঠাবান, সুশৃঙ্খল,বেদ প্রচারকারী, বেদ জ্ঞানী সে ব্রাক্ষ্মন।
ক্ষত্রিয় কে?
ঋগবেদ ১০.৬৬.৮
দৃড়ভাবে আচার পালনকারী, সত্কর্মের দ্বারা শূদ্ধ, রাজনৈতিক জ্ঞান সম্পন্ন,অহিংস,ঈশ্বর সাধক,সত্যের ধারক ন্যায়পরায়ন,বিদ্বেষমুক্ত ধর্মযোদ্ধা,অসত্ এর বিনাশকারী সে ক্ষত্রিয়।
বৈশ্য কে? অথর্ববেদ ৩.১৫.১
দক্ষ ব্যবসায়ী দানশীল চাকুরীরত এবং চাকুরী প্রদানকারী।
শূদ্র কে?
ঋগবেদ ১০.৯৪.১১
যে অদম্য,পরিশ্রমী, অক্লান্ত জরা যাকে সহজে গ্রাস করতে পারেনা,লোভমুক্ত কষ্টসহিষ্ণু সেই শূদ্র।
"একজন জ্ঞানের উচ্চ পথে(ব্রাক্ষ্মন) ,অপরজন বীরত্বের গৌরবে(ক্ষত্রিয়) , একজন তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে(পেশাভিত্তিক), আরেকজন সেবার পরিশ্রমে(শূদ্র)। সকলেই তার ইচ্ছামাফিক পেশায়,সকলের জন্যই ঈশ্বর জাগ্রত।
ঋগবেদ ৯.১১২.১
একেকজনের কর্মক্ষমতা ও আধ্যাত্মিকতা একেক রকম আর সে অনুসারে কেউ ব্রাক্ষ্মন কেউ ক্ষত্রিয় কেউ বেশ্য কেউ শূদ্র।
ব্রাক্ষ্মন কে? ঋগবেদ ৭.১০৩.৮
যে ঈশ্বরের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত, অহিংস,সত্,নিষ্ঠাবান, সুশৃঙ্খল,বেদ প্রচারকারী, বেদ জ্ঞানী সে ব্রাক্ষ্মন।
ক্ষত্রিয় কে?
ঋগবেদ ১০.৬৬.৮
দৃড়ভাবে আচার পালনকারী, সত্কর্মের দ্বারা শূদ্ধ, রাজনৈতিক জ্ঞান সম্পন্ন,অহিংস,ঈশ্বর সাধক,সত্যের ধারক ন্যায়পরায়ন,বিদ্বেষমুক্ত ধর্মযোদ্ধা,অসত্ এর বিনাশকারী সে ক্ষত্রিয়।
বৈশ্য কে? অথর্ববেদ ৩.১৫.১
দক্ষ ব্যবসায়ী দানশীল চাকুরীরত এবং চাকুরী প্রদানকারী।
শূদ্র কে?
ঋগবেদ ১০.৯৪.১১
যে অদম্য,পরিশ্রমী, অক্লান্ত জরা যাকে সহজে গ্রাস করতে পারেনা,লোভমুক্ত কষ্টসহিষ্ণু সেই শূদ্র।
এ হচ্ছে নির্ভেজাল যোগ্যতা অনুযায়ী ব্যবস্থা। যেমনভাবে এখনকার সময়ে ডিগ্রী প্রদান করা হয়, যজ্ঞোপবীত দেয়া হতো বৈদিক নিয়ম অনুসারে। তাছাড়া, আচরণবিধির সাথে অসম্মতি ঘটলে যজ্ঞোপবীত নিয়ে নেয়া হতো বর্ণগুলোর। ডাক্তার এর ছেলে যেমন ডাক্তার হবেই এমন কোন কথা নেই।ডাক্তার এর ঘরে জন্ম নিলেই এম.বি.বি.এস এর সার্টিফিকেট যেমন পাওয়া যায়না ঠিক তেমন ব্রাহ্মন এর ঘরে জন্ম নিলেই ব্রাহ্মন হওয়া যায়না।বৈদিক বর্নাশ্রম ও একই। বৈদিক ইতিহাসে অনেক উদাহরণ রয়েছে এ ধরনের-
(ক) ঋষি ঐতরেয়া ছিলেন দাস বা অপরাধীর পুত্র কিন্তু
তিনি পরিণত হন শীর্ষ ব্রাহ্মণদের মধ্যে একজন এবং লেখেন ঐতরেয়া ব্রাহ্মন এবং
ঐতরেয়াপোনিষদ। ঐতরেয়া ব্রাহ্মনকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ধরা হয় ঋগবেদ বোঝার জন্য।
(খ) ঋষি ঐলুশ জন্মেছিলেন দাসীর ঘরে যিনি ছিলেন জুয়াখোর এবং নিচু চরিত্রের লোক। কিন্তু এই ঋষি ঋগবেদের উপর গবেষণা করেন এবং কিছু বিষয় আবিষ্কার করেন। তিনি শুধুমাত্র ঋষিদের দ্বারা আমন্ত্রিতই হতেন না এমনকি আচার্য্য হিসেবেও অধিষ্ঠিত হন। (ঐতরেয়া ব্রহ্ম ২.১৯)
(গ) সত্যকাম জাবাল ছিলেন এক পতিতার পুত্র যিনি পরে একজনব্রাহ্মণ হন।
(ঘ) প্রীষধ ছিলেন রাজা দক্ষের পুত্র যিনি পরে শূদ্র হন। পরবর্তীতে তিনি তপস্যা দ্বারা মোক্ষলাভ করেন প্রায়ঃশ্চিত্তে র পরে। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.১.১৪) যদি তপস্যা শূদ্রদের জন্য নিষিদ্ধ হতো যেমনভাবে উত্তর রামায়ণের নকল গল্প বলে, তাহলে প্রীষধ কিভাবে তা করল?
(ঙ) নবগ, রাজা নেদিস্থের পুত্র পরিণত হন বৈশ্যে। তার অনেক পুত্র হয়ে যান ক্ষত্রিয়। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.১.১৩)
(চ) ধৃষ্ট ছিলেন নবগের (বৈশ্য) পুত্র কিন্তু পরে ব্রাহ্মণ হন এবং তার পুত্র হন ক্ষত্রিয়। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.২.২)
(ছ) তার পরবর্তী প্রজন্মে কেউ কেউ আবার ব্রাহ্মণ হন। (বিষ্ণু পুরাণ ৯.২.২৩)
(জ) ভাগবত অনুসারে অগ্নিবেশ্য ব্রাহ্মণ হন যদিও তিনি জন্মনেন এক রাজার ঘরে।
(ঝ) রাথোটর জন্ম নেন ক্ষত্রিয় পরিবারে এবং পরে ব্রাহ্মণ হন বিষ্ণু পুরাণ ও ভাগবত অনুযায়ী।
(ঞ) হরিৎ ব্রাহ্মণ হন ক্ষত্রিয়ের ঘরে জন্ম নেয়া সত্ত্বেও। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.৩.৫)
(ট) শৌনক ব্রাহ্মণ হন যদিও ক্ষত্রিয় পরিবারে জন্ম হয়। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.৮.১) এমনকি বায়ু পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ ও হরিবংশ পুরাণ অনুযায়ী শৌনক ঋষির পুত্রেরা সকল বর্ণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
একই ধরনের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় গ্রীতসমদ, বিতব্য ও বৃৎসমতির মধ্যে।
(ঠ) মাতঙ্গ ছিলেন চন্ডালের পুত্র কিন্তু পরে ব্রাহ্মণ হন।
(ড) রাবণ জন্মেছিলেন ঋষি পুলৎস্যের ঘরে কিন্তু পরে রাক্ষস হন।
(ঢ) প্রবৃদ্ধ ছিলেন রাজা রঘুর পুত্র কিন্তু পরে রাক্ষস হন।
(ণ) ত্রিশঙ্কু ছিলেন একজন রাজা যিনি পরে চন্ডাল হন।
(ত) বিশ্বামিত্রের পুত্রেরা শূদ্র হন। বিশ্বামিত্র নিজে ছিলেন ক্ষত্রিয় যিনি পরে ব্রাহ্মণ হন।
(থ) বিদুর ছিলেন এক চাকরের পুত্র কিন্তু পরে ব্রাহ্মণ হন এবং হস্তিনাপুর রাজ্যের মন্ত্রী হন।
(খ) ঋষি ঐলুশ জন্মেছিলেন দাসীর ঘরে যিনি ছিলেন জুয়াখোর এবং নিচু চরিত্রের লোক। কিন্তু এই ঋষি ঋগবেদের উপর গবেষণা করেন এবং কিছু বিষয় আবিষ্কার করেন। তিনি শুধুমাত্র ঋষিদের দ্বারা আমন্ত্রিতই হতেন না এমনকি আচার্য্য হিসেবেও অধিষ্ঠিত হন। (ঐতরেয়া ব্রহ্ম ২.১৯)
(গ) সত্যকাম জাবাল ছিলেন এক পতিতার পুত্র যিনি পরে একজনব্রাহ্মণ হন।
(ঘ) প্রীষধ ছিলেন রাজা দক্ষের পুত্র যিনি পরে শূদ্র হন। পরবর্তীতে তিনি তপস্যা দ্বারা মোক্ষলাভ করেন প্রায়ঃশ্চিত্তে র পরে। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.১.১৪) যদি তপস্যা শূদ্রদের জন্য নিষিদ্ধ হতো যেমনভাবে উত্তর রামায়ণের নকল গল্প বলে, তাহলে প্রীষধ কিভাবে তা করল?
(ঙ) নবগ, রাজা নেদিস্থের পুত্র পরিণত হন বৈশ্যে। তার অনেক পুত্র হয়ে যান ক্ষত্রিয়। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.১.১৩)
(চ) ধৃষ্ট ছিলেন নবগের (বৈশ্য) পুত্র কিন্তু পরে ব্রাহ্মণ হন এবং তার পুত্র হন ক্ষত্রিয়। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.২.২)
(ছ) তার পরবর্তী প্রজন্মে কেউ কেউ আবার ব্রাহ্মণ হন। (বিষ্ণু পুরাণ ৯.২.২৩)
(জ) ভাগবত অনুসারে অগ্নিবেশ্য ব্রাহ্মণ হন যদিও তিনি জন্মনেন এক রাজার ঘরে।
(ঝ) রাথোটর জন্ম নেন ক্ষত্রিয় পরিবারে এবং পরে ব্রাহ্মণ হন বিষ্ণু পুরাণ ও ভাগবত অনুযায়ী।
(ঞ) হরিৎ ব্রাহ্মণ হন ক্ষত্রিয়ের ঘরে জন্ম নেয়া সত্ত্বেও। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.৩.৫)
(ট) শৌনক ব্রাহ্মণ হন যদিও ক্ষত্রিয় পরিবারে জন্ম হয়। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.৮.১) এমনকি বায়ু পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ ও হরিবংশ পুরাণ অনুযায়ী শৌনক ঋষির পুত্রেরা সকল বর্ণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
একই ধরনের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় গ্রীতসমদ, বিতব্য ও বৃৎসমতির মধ্যে।
(ঠ) মাতঙ্গ ছিলেন চন্ডালের পুত্র কিন্তু পরে ব্রাহ্মণ হন।
(ড) রাবণ জন্মেছিলেন ঋষি পুলৎস্যের ঘরে কিন্তু পরে রাক্ষস হন।
(ঢ) প্রবৃদ্ধ ছিলেন রাজা রঘুর পুত্র কিন্তু পরে রাক্ষস হন।
(ণ) ত্রিশঙ্কু ছিলেন একজন রাজা যিনি পরে চন্ডাল হন।
(ত) বিশ্বামিত্রের পুত্রেরা শূদ্র হন। বিশ্বামিত্র নিজে ছিলেন ক্ষত্রিয় যিনি পরে ব্রাহ্মণ হন।
(থ) বিদুর ছিলেন এক চাকরের পুত্র কিন্তু পরে ব্রাহ্মণ হন এবং হস্তিনাপুর রাজ্যের মন্ত্রী হন।
"শূদ্র" শব্দটি বেদে দেখা গেছে প্রায় ২০ বারের মতো। কোথাও এটি অবমাননাকরভাবে ব্যবহৃত হয়নি। কোথাও বলা হয়নি শূদ্রেরা হলো অস্পর্শযোগ্য, জন্মগতভাবে এই অবস্থাণে, বেদ শিক্ষা হতে অনুনোমোদিত, অন্যান্য বর্ণের তুলনায় নিম্ন অবস্থাণের, যজ্ঞে অনুনোমোদিত।
বেদে বলা হয়েছে শূদ্র বলতে বোঝায় কঠিন পরিশ্রমী ব্যক্তি। (তপসে শূদ্রম্ - যজুর্বেদ ৩০.৫) একারণেই পুরুষ সুক্ত এদের ঘোষনা দিয়েছে মানব সভ্যতার কাঠামো হিসেবে।
এজন্যেই পবিত্র বেদ ঘোষনা করেছে সাম্যের বানী- অজ্যেষ্ঠাসো অকনিষ্ঠাস এতে সং ভ্রাতারো তাবৃধুঃ সৌভগায় যুবা পিতা স্বপা রুদ্র এযাং সুদুঘা পুশ্নিঃ সুদিনা মরুদ্ভঃ ॥ (ঋগবেদ ৫.৬০.৫)
বঙ্গানুবাদ :কর্ম ও গুনভেদে কেউ ব্রাহ্মন,কেউ ক্ষত্রিয়,কেউ বৈশ্য,কেউ শুদ্র।তাদের মধ্যে কেহ বড় নয় কেহ ছোট নয়।ইহারা ভাই ভাই । সৌভাগ্য লাভের জন্য ইহারা প্রযত্ন করে ।ইহাদের পিতা তরুন শুভকর্ম ঈশ্বর এবং জননীরুপ প্রকৃতি।পুরুষার্থী সন্তানই সৌভাগ্য প্রাপ্ত হন।
বেদে বলা হয়েছে শূদ্র বলতে বোঝায় কঠিন পরিশ্রমী ব্যক্তি। (তপসে শূদ্রম্ - যজুর্বেদ ৩০.৫) একারণেই পুরুষ সুক্ত এদের ঘোষনা দিয়েছে মানব সভ্যতার কাঠামো হিসেবে।
এজন্যেই পবিত্র বেদ ঘোষনা করেছে সাম্যের বানী- অজ্যেষ্ঠাসো অকনিষ্ঠাস এতে সং ভ্রাতারো তাবৃধুঃ সৌভগায় যুবা পিতা স্বপা রুদ্র এযাং সুদুঘা পুশ্নিঃ সুদিনা মরুদ্ভঃ ॥ (ঋগবেদ ৫.৬০.৫)
বঙ্গানুবাদ :কর্ম ও গুনভেদে কেউ ব্রাহ্মন,কেউ ক্ষত্রিয়,কেউ বৈশ্য,কেউ শুদ্র।তাদের মধ্যে কেহ বড় নয় কেহ ছোট নয়।ইহারা ভাই ভাই । সৌভাগ্য লাভের জন্য ইহারা প্রযত্ন করে ।ইহাদের পিতা তরুন শুভকর্ম ঈশ্বর এবং জননীরুপ প্রকৃতি।পুরুষার্থী সন্তানই সৌভাগ্য প্রাপ্ত হন।
আজ অনেকে বর্ণ ভেদকে অস্বীকার করলেও ছেলে মেয়েদের বিয়ে দেবার সময় ঠিকই গোত্র জাতি উচু নিচু ভেদাভেদ করেন।তাদেরকে বলতে চাই যখন ধর্মগ্রন্থেই বর্ণ ভেদ, মানুষের মাঝে উঁচু নিচু ভেদাভেদ কে নিশিদ্ধ ঘোষণা করে দেয়া আছে তখন তাকে লালন করা অধর্মেরই নামান্তর। মহাভারতে বিশ্বামিত্রের(ব্রাহ্মণ) কন্যা শকুন্তলার সাথে(যিনি ঋষি কণ্বের আশ্রমে বড় হন) বিয়ে হয় ক্ষত্রিয় রাজা দুশ্মন্তের সাথে। অর্থাৎ তথা কথিত উচ্চ বর্ণের স্ত্রী ও নিম্ন বর্ণের পুরুষের মধ্যকার প্রতিলোম বিয়ে।
আবার একই গ্রন্থে ক্ষত্রিয় রাজা শান্তনুর সাথে জেলে কন্যা সত্যবতীর অনুলোম বিয়েও দেখতে পাই। যদি বর্ণ বিয়ের ক্ষেত্রে কোন যোগ্যতার মাপকাঠি হত তাহলে তৎকালীন কোঠরভাবে বেদ শাসিত সমাজে এ ধরনের অসংখ্য বিয়ে সম্ভব হত না।
অনেকে আবার বর্ণভেদই শুধু মানেন না বর্ণভেদের সাথে সাথে ছুতমার্গ নামক এক বিকৃত রুচিও মেনে থাকেন।অর্থাৎ স্বঘোষিত উচ্চবর্ণের লোকেরা তথাকথিত নিচু বর্ণের লোকেদের ছোঁয়া এড়িয়ে চলেন এমনকি তাঁদের ছায়া পর্যন্ত মাড়ান না। এ সকল বিকৃত মনা হিন্দুদের জন্যে রামায়ণের একটি কাহিনি শোনাতে চাই।আশাকরি সে কাহিনী জানার পর অন্তত তাদের বিকৃত মনের পরিবর্তন হবে।
পিতৃ সত্য রক্ষার্থে রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ বনবাসে যাবার পথে শর্বরী বুড়ি নামক এক বৃদ্ধার কাছে আশ্রয় নেন।আর দশ জনের মত দেশের জনপ্রিয় যুবরাজ রামচন্দ্রের ভক্ত সেই বৃদ্ধাও।পরম স্নেহে তাঁদেরকে তিনি যত্ন করেন এবং কুল বা বরই খেতে দেন। বৃদ্ধা দশরথ তনয় রামকে এত ভালবাসতেন যে কুল গুলো যথেষ্ট মিষ্টি কিনা বা কোন পোকা আছে কিনা এ ভয়ে নিজে আগে সব গুল ফলে কামড় দিয়ে নিরীক্ষা করে দেখছেন আর ভগবান রামচন্দ্র তা ভক্তিভরে খেয়ে নিচ্ছেন।আশা করি এ কাহিনির মর্ম আমাদের তথাকথিত বিকৃত মনা ধর্মপ্রাণ ছুতমার্গ উচ্চবর্ণের হিন্দুরা বুঝতে পেরেছেন।সত্যি কথা বলতে তারা যেন আজ নিজেদেরকে ভগবানেরও উপরে আসনে আসীন করতে চান।ভগবান রামচন্দ্র নির্ভয়ে উচ্ছিষ্ট ফল খেয়েছেন ,তাঁর জাত চলে যায়নি।আর তাদের জাত চলে যায় নিম্নবর্ণের ছোঁয়াতে, ছায়াতে।
এছাড়া শ্রীরামচন্দ্র তাঁর উপনয়ন কালে প্রথম ভিক্ষা গ্রহন করেন ধনী কামারানির কাছ থেকে।রামচন্দ্রের বনবাস কালে গুহক চণ্ডালের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব রামায়ণে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে।
দ্বাপরে শ্রীকৃষ্ণ বৈশ্য জননীর স্তনদুগ্ধ পান করেছেন। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু বলেছেন,
জাতিভেদ যারা মানে তারা শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ , গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুকে ভগবান, ঈশ্বরের অবতার মানেন কিন্তু তাঁদের জীবন আদর্শকে মানেন না।
ভগবান নিশ্চিন্তে জন্মেছেন, খেয়েছেন, বড় হয়েছেন, তাঁর লীলা প্রকাশ করেছেন, বন্ধুত্ব করেছেন সব গোত্র, জাতি সমাজে অথচ আজ ঐ সকল তথাকথিত উঁচু বর্ণের লোকেরা ভয় পান সমাজে তাদের থেকে পিছিয়ে পড়া লোকদের সাথে চলতে।এতে নাকি তাদের ধর্ম নষ্ট হয়।কিন্তু ঈশ্বর তো থাকেন কুলি মজুর শ্রমিক শূদ্রদের মাঝে।আর এঁদেরকে ঘৃণা করা ঈশ্বরকে ঘৃণা করার নামন্তর,এঁদের কে দূরে ঠেলে দেয়া মানে ঈশ্বরের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া।
আশা করি বর্ণ প্রথার আদি অন্ত আপনাদের কাছে পরিষ্কার করতে পেরেছি। বর্তমান সমাজ পুনঃনির্মাণে এ প্রথার উপযোগিতা নাই।সমাজে যেহেতু শিক্ষা ও পেশা সবার জন্য উন্মুক্ত তাই এ প্রথা আজ অপপ্রথায় পরিণত হয়েছে।বরং সমাজে বর্ণ ভেদের কারনে বিভাজন দৃশ্যমান, অগ্রগতির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দারিয়েছে।এ কারনে চূড়ান্ত রুপে এ প্রথাকে বরজন করাই মঙ্গলজনক। আর বর্ণভেদকে মনে আশ্রয় দেবার অর্থ হল পবিত্র ধর্মের বানীকে অস্বীকার করে অধর্মের পথে পা বাড়ান।এ জন্য আসুন শুধু কথায় নয় হৃদয় হতে বর্ণভেদের কালিমা ধুয়ে ফেলি সম্পূর্ণরূপে- চিরতরে।
আজো পরাধীনতার শিকলে বাঁধা আমার স্বাধীনতা।
ReplyDeleteকে বলে আমি স্বাধীন দেশের নাগরিক?
আমিতো স্বাধীনতা দেখিনা,
আমার অধিকার আমি আজো পরিপূর্ন ভাবে পায়নি
সে ৭১থেকে এখনো পর্যন্ত, আমাকে প্রতিনিয়ত পরাধীনতার ছাবুকে রক্তাক্ত করে আমার পরিচয় আমি লিখে দিয়েছে আমি সংঘ্যালঘু আমি মালাউন হিন্দু জাতি
সুন্দর লেখা। অনেক কিছু জানতে পারলাম
ReplyDelete