Pages

Thursday, May 17, 2012

কাশ্মীর : হিন্দুদের পবিত্রভূমিতে দানবরা যেভাবে প্রবেশ করেছিল



কাশ্মীরে কীভাবে ইসলাম এসেছিল? এ প্রশ্নের উত্তর আসে যে, সূফীদের শান্তিপূর্ণভাবে প্রচারণার মাধ্যমে ইসলাম এসেছিল কাশ্মীরে।

পৃথিবীব্যাপী শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম প্রচারের জন্য সর্বজনীনভাবে সূফীদেরকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়। এক কিংবদন্তী অনুযায়ী কাশ্মীরে কোন এক কালে এক রাজা ছিলেন যার কোন ধর্ম ছিল না। একদিন তিনি ঠিক করলেন, যে তিনি কোন একটি ধর্ম গ্রহণ করবেন। মুসলমান এবং হিন্দু উভয় দলই রাজাকে স্বধর্মে দীক্ষিত করতে চাইল। অতঃপর রাজা উভয় পক্ষের পরস্পর বিরুদ্ধ বক্তব্য শুনে বিভ্রান্ত হলেন এবং ঠিক করলেন যে, “পরদিন সকাল বেলায় তিনি প্রাসাদ থেকে রাস্তায় বেরিয়ে যে ব্যক্তিকে প্রথম দেখবেন তিনি তার ধর্ম গ্রহণ করবেন।” (Chapter 2, Baharistan-i-Shahi, an anonymous 17th-century Persian book on the history of Kashmir, translated by Prof. K. N. Pundit)। এবং পরদিন রাজা প্রথম দেখা পেলেন এক সুফি-দরবেশের এবং এভাবে কাশ্মীরে ইসলামে প্রবেশ করল।
অনেক জায়গাতে এ ধরনের কিংবদন্তীয় কাহিনী প্রচলিত আছে যেঃ একজন সূফী তার অলৌকিক ক্ষমতাবলে অথবা অন্য কোনভাবে সেখানকার রাজাকে ইসলামে দীক্ষিত করেছিলেন। এভাবে সে রাজ্যে শান্তিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করে এবং ইসলামের এ শান্তিপূর্ণ প্রচারের জন্য সূফীদেরকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়।
আমার এক কাশ্মীরী বন্ধু বর্বর শিক্ষার জন্য ইসলামের উচ্ছেদ চাইলেও আমাকে বলেঃ ইসলামের এ বর্বর চরিত্র সত্ত্বেও সূফীদের শান্তিপূর্ণ প্রচারের মাধ্যমে কাশ্মীরে ইসলাম এসেছিল। এবং সে আফসোচ করে যে, ইসলামের সে শান্তিময় উপত্যকা কীভাবে আজ বর্বরতার ভূমিতে পরিণত হয়েছে? এর জন্য সে দায়ী করে ওয়াহাবী ইসলামি মতবাদকে।
কাশ্মীর ও সারা পৃথিবীব্যাপী সূফীদের শান্তিপূর্ণ প্রচারের মাধ্যমে ইসলাম প্রসার লাভ করেছিল – এ ধারণা মুসলিম ও অমুসলিম পণ্ডিত ও ঐতিহাসিকদের মাঝে সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত। ইসলামের উপর এক খ্যাতনামা পণ্ডিত ও ঐতিহাসিক এবং সূফীদের উপরে বিশেষজ্ঞ ডঃ যোগিন্দর সিকান্ত্‌কে জিজ্ঞাসা করুন, তিনি এই কথাই বলবেন।
সুফিদের কর্মকাণ্ডের উপর ঐতিহাসিক তথ্য অপ্রত্যুল। তবে যে সব ঐতিহাসিক দলিল পাওয়া যায়, তা থেকে সুফিদের ব্যাপারে ভিন্ন চিত্র, অর্থাৎ বর্বরতামূলক চিত্র, ফুটে উঠে। অথচ সুফিদের শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম প্রচারের চিত্রটি একচেটিয়া ও সফলভাবে প্রচারিত হয়ে চলেছে।
কাশ্মীরে ইসলামী শাসন কখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেটা জানা কঠিন। ৭১৫ খ্রীষ্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাসিম কাশ্মীর আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তারপর থেকে কাশ্মীর অনেকগুলি ইসলামী আক্রমণের শিকার হয়। মুসলমানরা যাকে নিয়ে গর্ব করে, কিন্তু যিনি শ্রেষ্ঠ বর্বর ছাড়া আর কিছু নন, সেই সুলতান মাহমুদও সেখানে একটি ব্যর্থ অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। হিন্দু অঞ্চলগুলির বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ পরিচালনার জন্য খলীফা আল মনসুর (৭৫৫-৭৪) হাশাম বিন আমরুর নেতৃত্বে একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। কান্দাহার এবং কাশ্মীরের মধ্যে বহু স্থান তিনি দখল করেন এবং তিনি “কাশ্মীরকে পদানত করে বহু সংখ্যক বন্দী ও দাসকে নিয়ে যান” [Elliot H.M. & Dawson J., "History of India as Told by Its Own Historians" (এতে মুসলমানদের দ্বারা লিপিবদ্ধ ঘটনাপঞ্জি থেকে বিভিন্ন অংশ নেওয়া হয়েছে), Vol. 1, p. 122-23, 203]। সুলতান মাহমুদের পুত্র সুলতান মাসুদ তার পিতার মত কীর্তিমান ছিলেন না। ১০৩৩ খ্রীষ্টাব্দে তিনি পিতার ব্যর্থতার প্রতিকারের উদ্দেশ্যে “কাশ্মীরের সুরসুতি দুর্গ আক্রমণ করেন। নারী ও শিশু বাদে দুর্গের সকল সৈন্যকে হত্যা করা হয় এবং জীবিত নারী ও শিশুদেরকে দাস হিসাবে নিয়ে যাওয়া হয়।”
এটা বলা কঠিন যে এ সকল অভিযানের মধ্যে কোনটি দ্বারা কাশ্মীরে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে কাশ্মীরকে ইসলামীকরণে তথাকথিত শান্তির দূত সূফীদের যে একটা প্রধান ভূমিকা ছিল সেটা নিশ্চিত বলা যায়। কিন্তু তাদের পন্থাটা ছিল বর্বরোচিত।
কাশ্মীরে জনগণের ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে আমরা যে ধারণা পাই সেটা হচ্ছে এ রকমঃ ১৩৭১ অথবা ১৩৮১ সালের দিকে একজন বিখ্যাত সূফী দরবেশ বা সাধু সাঈদ আলী হামদানী কাশ্মীরে আসেন, এবং তার সঙ্গে কাশ্মীরে আসে ইসলামি গোড়ামি। তিনি প্রথম যে কাজ করেছিলেন, সেটা হচ্ছে “একটি ছোট মন্দির যেটাকে ধ্বংস করা হয়েছিল”, সেই জায়গার উপর তার খানকা (আস্তানা বা আশ্রম) স্থাপন করা (Baharistan, p. 36)। তার আগমনের পূর্বে শাসনকারী সুলতান কুৎবুদ্দীন ইসলামী আইন বলবৎ করার ব্যাপারে সামান্যই মনোযোগ দিয়েছিলেন। কাশ্মীরের সহনশীল হিন্দু সংস্কৃতি ও আচার-আচরণের ভিতরে সুলতান থেকে কাজী পর্যন্ত সমাজের সকল স্তরের মুসলমানরা নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল (Baharistan, p. 37)।কিন্তু সূফী দরবেশ সাঈদ হামদানী কাশ্মীরী মুসলমানদের এমন সকল আচার-কার্য দেখে আতঙ্কিত হন এবং ইসলামী নিয়ম পালনে শৈথিল্য দূর করে গোঁড়া ইসলাম প্রবর্তনের চেষ্টা করেন। শাসক কুৎবুদ্দীন তার ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামী গোঁড়ামি অনুশীলন করার চেষ্টা করেন, কিন্তু “আমীর সাঈদ আলী হামদানীর ইচ্ছা এবং আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী ইসলাম প্রচারে ব্যর্থ হন” (ঐ)। এর ফলে সূফী দরবেশ পৌত্তলিক সংস্কৃতি ও আচার-অনুষ্ঠান প্রাধান্যের দেশে বাস করতে নারাজ হয়ে ও প্রতিবাদস্বরূপ কাশ্মীর ছেড়ে চলে যান।
পরবর্তী কালে তার পুত্র ও আরেক বিখ্যাত সূফী দরবেশ আমীর সাঈদ মুহাম্মদ বিখ্যাত প্রতিমা-ধ্বংসকারী সুলতান সিকান্দারের শাসনকালে কাশ্মীরে আগমন করেন। সুলতান সিকান্দার পবিত্র সূফী দরবেশ সাঈদ মুহাম্মদের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত এতটা বর্বর ও গোঁড়া ছিলেন না। সূফী দরবেশ কাশ্মীরে ইসলামী আইন কার্যকর করার জন্য সিকান্দারকে প্রণোদিত করেন। সুলতান কুৎবুদ্দীন সূফী দরবেশের নির্দেশনা মানেন নই, কিন্তু সুলতান সিকান্দার তা মেনে নিতে রাজী হন। এভাবে কাশ্মীর থেকে মূর্তিপূজা এবং তার অনুসারীদের সকল চিহ্ন মুছে ফেলার জন্য সিকান্দার এবং সূফী সাধক সাঈদ মুহাম্মদ ঐক্যবদ্ধ হন।
দিল্লী সম্রাটের দরবারের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মুহাম্মদ ফেরিশতা (মৃত্যু ১৬১৪) জানান (History of the Rise of the Mahomedan Power in India, Vol. 1V. 1997, imprint, p. 268) যে, সিকান্দার আদেশ জারী করেন:
“.... কাশ্মীরে মুসলমান ছাড়া অন্য কোন ধর্মের অনুসারীর বসবাস বেআইনী ঘোষণা ক’রে; এবং তিনি চান যাতে কেউ কপালে কোন চিহ্ন না লাগায়। ....সবশেষে তিনি সকল স্বর্ণ ও রৌপ্য নির্মিত মূর্তি ভাঙ্গার এবং সেগুলি গলিয়ে ধাতব মুদ্রায় পরিণত করেন। অনেক ব্রাহ্মণ তাদের ধর্ম অথবা দেশ ত্যাগের পরিবর্তে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। কেউ কেউ বাসভূমি ত্যাগ করে দেশান্তরী হন, কেউ কেউ বিতাড়নের শাস্তি এড়ানোর জন্য মুসলমান হন। ব্রাহ্মণরা দেশান্তরী হলে সিকুন্দুর (সিকান্দার) কাশ্মীরের সকল মন্দির ধ্বংস করার নির্দেশ দেন। ....কাশ্মীরের সকল প্রতিমা ধ্বংস করে তিনি “প্রতিমা ধ্বংসকারী” উপাধি অর্জন করেন।”
আরেক সপ্তদশ শতাব্দীর পারস্যীয় বিবরণ, HM Chaudurah-র Tarikh-i-Kashmir-এ বলা হয়েছেঃ সিকান্দার “অবিশ্বাসীদেরকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস সাধনের কাজে অবিরামভাবে ব্যস্ত ছিলেন এবং অধিকাংশ মন্দির ধ্বংস করেছিলেন” (Trans. Razia Bano, Delhi, 1991, p. 55)।
বিদ্বান ফারিশতার নিকট সুলতান সিকান্দারের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি ছিল এটাই। আর এর জন্য আসল কৃতিত্ব ছিল কার? এই প্রশ্নের উত্তরে Baharistan-i-Shahii-এর গর্বিত লেখকের কথা থেকেই বের করে নিন, যিনি লিখছেনঃ “...এই ভূমির বাসিন্দাদের বিবেকের আয়না থেকে নাস্তিকতা এবং সত্য ধর্মে অবিশ্বাসের চিহ্ন পর্যন্ত মুছে ফেলার কৃতিত্ব ছিল” সূফী দরবেশ সাঈদ মুহাম্মদের (ঐ, পৃঃ ৩৭)।
প্রতিমা ধ্বংসকারী সিকান্দারের পুত্র আমীর খান (আকা আল্লী শাহ্‌) কাশ্মীরে হিন্দু নিধন অব্যাহত রাখেন। ফারিশতা বলেনঃ “এরপরেও যে সামান্য কিছু সংখ্যক ব্রাহ্মণ তাদের স্ব-ধর্মে অটল ছিলেন, তাদেরকে তিনি নির্যাতন করেন এবং যারা ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন তাদের সকলকে হত্যা করেন। এরপরেও যারা কাশ্মীরে ছিলেন তাদের সকলকেই সেই রাজ্য থেকে বিতাড়ন করেন” (ঐ, পৃঃ ২৬৯)।
এরপর উদার ও সহিষ্ণু সুলতান জয়নুল আবেদীন (১৪২৩-১৪৭৪) নিগৃহীত অমুসলমানদের জন্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফিরিয়ে আনেন। তিনি ধর্মীয় স্বাধীনতাকে অনুমোদন দেন, এমনকি জবরদস্তিমূলকভাবে ধর্মান্তরিত হিন্দুদেরকে তাদের নিজ ধর্মে ফিরে যেতেও অনুমতি দেন। এটা হিন্দু ধর্মের সমৃদ্ধি ঘটতে সাহায্য করে, “যা কিনা প্রতিমা ভগ্নকারী সুলতান সিকান্দারের ইতিপূর্বেকার শাসনকালে উচ্ছেদ হয়েছিল” (ঐ, পৃঃ ৭৪)। সিডনি ওয়েন বলছেনঃ ভিন্ন ধরনের শাসক জয়নুল আবেদীনের শাসনাধীনে, “অনেক হিন্দু (অর্থাৎ জবরদস্তির মাধ্যমে ইসলামে ধর্মান্তরিত হিন্দুগণ) হিন্দুধর্মে ফিরে যায়” (From Mahmud Ghazni to the Disintegration of Mughal Empire, Delhi, p. 127)| সুলতান জয়নুল আবেদীনের নীতিতে অসন্তুষ্ট ও আতঙ্কিত Baharistan-i-Shahi-র লেখক তাঁর অধীনে হিন্দুধর্মের উত্থান এবং ইসলাম ধর্মের পতনের ব্যাপারে আফসোচ করে বলেন (পৃঃ ৭৪):
“... অবিশ্বাসীরা এবং তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত ও অনৈতিক আচার-আচরণ এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে, এমনকি এ দেশের উলেমা, সাইয়ীদ (সম্ভ্রান্ত) এবং কাজীগণও সে সব অপকর্মের কোন রকম বিরোধিতা করার পরিবর্তে বরং সেগুলিতে ডুবে যান। তাদেরকে নিষেধ করার মত কেউ ছিল না। এর ফলে ইসলাম ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং এর অনুশাসন ও নীতিমালা পালনে শিথিলতা দেখা দেয়; প্রতিমা পূজা এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ও অনৈতিক আচার-অনুষ্ঠান বিস্তার লাভ করে।”
আকবরের মত সুলতান জয়নুল আবেদীন ধার্মিকদের মুসলমানদেরকে অগ্রাহ্য ও ক্রুদ্ধ করে সকল ধর্মের প্রতি উদার নীতি অনুসরণ করেন। উদাহরণ হিসাবে সুলতানের উদার নীতিতে না’খুশ পারস্য পণ্ডিত মুল্লা আহমদের চিঠির কথা উল্লেখ করা যায়, যেখানে তিনি সুলতানকে স্মরণ করিয়ে দেনঃ
“...তাদের উপর জিযিয়া কর আরোপের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদেরকে অপমান করা। ...তাদেরকে অপমানিত করার জন্যই ঈশ্বর জিযিয়া কায়েম করেছিলেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের অবমাননা এবং মুসলমানদের মর্যাদা ও সম্মান (প্রতিষ্ঠা)” (Quted by KS Lal, "Theory and Practice of Muslim State in India", p.113)।
কিন্তু মালিক রাইনা এবং কাজী চাকের রাজত্বকালে কাশ্মীরের অমুসলিমদের উপর পুনরায় সন্ত্রাস নেমে আসে। তারা হিন্দুদেরকে তলোয়ার দ্বারা ইসলামে ধর্মান্তরিত করেন। আর এবারে এমন বর্বরতায় উস্কানীদাতা ছিলেন আরেক সূফী দরবেশ আমীর শামসুদ্দীন মুহাম্মদ ইরাকী, যিনি কিনা কাশ্মীরে আগত সর্বশ্রেষ্ঠ সূফী সাধক হিসাবে পরিচিত।মালিক মুসা রাইনা ১৫০১ সালে কাশ্মীরের শাসক হবার পর মুহাম্মদ ইরাকী কাশ্মীরে আগমন করেন, এবং মালিক মুসার সঙ্গে জোট বেঁধে তিনি যেসব কর্মকাণ্ড চালান, সে সম্পর্কে Baharistan-i-Shahi (p. 93-94)-তে বলা হয়েছেঃ
“আমীর শামসুদ্দীন মুহাম্মদ সকল মূর্তিপূজার গৃহ পাইকারীভাবে ধ্বংস করেন এবং সেই সঙ্গে নাস্তিকতা ও অবিশ্বাসের ভিত্তিমূল পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করেন। মূর্তিপূজার প্রতিটি গৃহ ধ্বংস করার পর ইসলামী কায়দায় উপাসনা করার জন্য তার উপর মসজিদ নির্মাণ করার আদেশ দেন।”
এবং “শামসুদ্‌-দীন ইরাকীর অনুরোধে মুসা রাইনা আদেশ জারী করেন যে, প্রত্যেক দিন ১৫০০-২০০০ অবিশ্বাসীকে মীর শামসুদ্দীনের অনুসারীরা তার সামনে হাজির করবে, এবং তাদের পবিত্র সূতা খুলে ফেলবে, তাদেরকে কলেমা (ইসলামের মূল মন্ত্র) পড়াবে, খৎনা করানো হবে এবং গরুর মাংস খাওয়ানো হবে”; এবং এভাবে “বলপ্রয়োগ এবং বাধ্যতাপূর্বক ২৪,০০০ (চব্বিশ হাজার) হিন্দু পরিবারকে ইরাকীর ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়” (ঐ, পৃঃ ১০৫-১০৬)।
সুলতান মুহাম্মদ শাহর অধীনে ১৫১৯ খ্রীষ্টাব্দে মালিক কাজী চাক সেনানায়ক হওয়ার পর সাধু-সন্ত ইরাকী তার ভয়াবহ কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখেন। Baharistan-i-Shahi (p. 116)-তে বলা হয়েছে: “তিনি (কাজী চাক) আমীর শামসুদ্দীন মুহাম্মদ ইরাকীর যে প্রধান নির্দেশটি কার্যকর করেন, সেটা হল এ দেশের অবিশ্বাসী ও পৌত্তলিকদেরকে পাইকারীভাবে হত্যা।” এ নিহতদের মধ্যে এমন অনেকেই ছিল যারা মালিক রাইনার সময়ে জোরপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার পর আবার পৌত্তলিকতায় (হিন্দুধর্ম)-এ ফিরে গিয়েছিল। মুসলমানরা এ গুজব ছড়িয়ে দেয় যে, সেসব ধর্মত্যাগীরা “পাছার নীচে পবিত্র কুরআন রেখে তার উপর বসেছিল।” এটা শুনে সূফী দরবেশ ক্রুদ্ধ হয়ে কাজী চাকের নিকট এটা বলে প্রতিবাদ জানায় যেঃ
“এ মূর্তি-পূজারী সম্প্রদায় ইসলামী ধর্মবিশ্বাস গ্রহণ ও তাতে আত্মসমর্পণ করার পর এখন ধর্মভ্রষ্টতা ও ধর্মদ্রোহে ফিরে গেছে। যদি আপনি নিজে শরীয়ার বিধান অনুযায়ী তাদেরকে শাস্তি (ইসলামে ধর্মদ্রোহের শাস্তি হচ্ছে মৃত্যু) না দেন এবং তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গ জনিত শাস্তি না দেন, তাহলে আমার নিকট স্বেচ্ছা-নির্বাসনে যাওয়া প্রয়োজনীয় ও বাধ্যতামূলক হবে।” (ঐ, পৃঃ ১১৭)
লক্ষ্য করুন যে, কুরআন অবমাননার যে কথা উপরে বলা হয়েছে, ইরাকী সেটা উল্লেখ করেননি, বরং তিনি কেবল ইসলাম গ্রহণের পর হিন্দুরা তা ত্যাগ করার কথা বলেছেন মাত্র, ইসলামে যার শাস্তি হচ্ছে “মৃত্যু”। বাহারিস্তান-ই-শাহী (Baharistan-i-Shahi)-তে বলা হয়েছেঃ ক্রুদ্ধ সূফী দরবেশকে শান্ত করার জন্য মালিক কাজী চাক “অবিশ্বাসীদেরকে পাইকারীভাবে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন।” আশুরার পবিত্র পর্বের দিনকে হত্যার দিন হিসাবে ধার্য করা হয় (মুহররম, ১৫১৮ সাল; ইরাকী ছিলেন শিয়া)। বাহারিস্তান-ই-শাহীতে আরও বলা হয়েছেঃ
“... প্রায় সাতশত থেকে আটশত অবিশ্বাসীকে হত্যা করা হয়। যাদেরকে হত্যা করা হয়, তারা ছিলেন সেই সময় অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব” (পৃঃ ১১৭)।
Baharistan-i-Shahi-এর গর্বিত লেখক আরও বলছেনঃ
“তরবারির মুখে কাশ্মীরে অবিশ্বাসী ও পৌত্তলিকদের পুরো সম্প্রদায়কে ইসলামে দীক্ষিত হতে বাধ্য করা হয়। এটা ছিল মালিক কাজী চাকের সর্বোত্তম কীর্তি” (পৃঃ ১১৭)।
এবং মৌলিক অর্থে এ ভয়ঙ্কর কাজের নির্দেশ যিনি দিয়েছিলেন, তিনি মহান সূফী দরবেশ ব্যতীত আর কেউ নন।
সূফীদের আসল চরিত্র তুলে ধরার জন্য আমার আর কিছুই বলার প্রয়োজন নাই। ভারতে শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম প্রসারের সর্বশ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত হিসাবে মুসলমানরা যে কাশ্মীরকে ঢাকঢোল পিটিয়ে জাহির করে, সে কাশ্মীরের ঘটিত ঘটনা ছিলএরূপ! ধর্মান্তরের জন্য চমৎকার শান্তিপূর্ণ পদ্ধতি বটে! এবং এটাই হচ্ছে মুসলিম বিশ্ব থেকে ভারতে আগত সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ সূফীদের কীর্তি-কাহিনী।
ভারতের অন্যান্য শ্রেষ্ঠ সূফীদের কাহিনীও এর চেয়ে ভাল কিছু নয়। অবিশ্বাসীদের উপর নরমেধ যজ্ঞ চালাবার জন্য জিহাদী ইসলামি দখলদার বাহিনীর সাথে ঘৃণ্য জিহাদী যোদ্ধাদের তারা আসতেন ভারতে। আজমীরের মঈনুদ্দীন চিশতি এসেছিলেন মুহাম্মদ গোরীর সেনাবাহিনীর সঙ্গে, যে ঘৌরী বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণভাবে মানবিক ও মহানুভব রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহানকে পরাজিত করেছিলেন।
বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সূফী দরবেশ শেখ শাহ জালাল সিলেটের হিন্দু রাজা গৌর গোবিন্দের বিরুদ্ধে জিহাদী যুদ্ধে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন বলে বহুল প্রচারিত। এবং এসব সূফীই ওসব রক্তাক্ত যুদ্ধে জয়লাভের ক্ষেত্রে নিজেদের প্রাধান্যকারী ভূমিকার দাবী করে গর্ব প্রকাশ করেছেন। ভারত থেকে আফ্রিকা এবং আফ্রিকা থেকে বলকান পর্যন্ত সর্বত্র শ্রেষ্ঠ সূফীদের অধিকাংশেরই কাহিনী হচ্ছে এ রকম যুদ্ধ, বলপ্রয়োগ ও রক্তপাতময় কর্মকাণ্ডের উস্কানি প্রদান ও তাতে অংশগ্রহণ।*----------------------------------------------* সূফীদের লোকহর্ষক কার্যকলাপ সম্পর্কে আরও বিস্তারিতভাবে জানার জন্য দেখুন আমার বই, "Islamic Jihad: A Legacy of Forced Conversion, Imperialism, and Slavery", p. 115-133 [এম, এ, খান]

No comments:

Post a Comment