Pages

Saturday, July 14, 2012

`এক বর্ণ’' বেদ ও গীতা বিরুদ্ধ কিনা


গৌরমোহন দাস




বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু সমাজ সংস্কার সমিতির সাপ্তাহিক বিষয়ভিত্তিক সেমিনারের ১৩ জুলাই ‘সাধক বাম্যাাপার আধ্যাত্মিকতা’ সেমিনারে আমার দেয়া স্বাগত ভাষণটি পড়ে দুজন বন্ধু 
Manik Rakshit & Krishna Chandra Chakraborty জানতে চেয়েছেন - সমিতির শ্ল্ল্লোগানে ‘এক ধর্ম, এক বর্ণ, এক সমাজ, এক সংস্কার।’ -এর ‘এক বর্ণ’ বেদ ও গীতা বিরুদ্ধ কিনা। জানার আগ্রহে সমিতির খুবই খুশি হয়েছি এবং আপনাদের/তাদের কথার জবাবেই আমার এ লেখা।
 প্রশ্ন করা বা জানার ক্ষেত্রে প্রথমেই আমি শ্রীশ্রী গীতার ‘শ্র্দ্ধাবান্ লভতে জ্ঞানং তৎপরঃ সংযতেন্দ্রিয়’ কথাটি স্মরণ করিয়ে দিতে বলতে চাই যে,
প্রতিটি শিশুই সনাতন ধর্মে জন্মগ্রহণ করে, সনাতনী প্রথায় সনাতনী প্রক্রিয়ায়। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, বোম পাঁচটি উপদানে মানুষ তৈরি। এদের কিছু ইন্দ্রিয় সংযোগ রয়েছে-চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, ত্বক ও জিহ্বা। এদের কাজ আমরা জানি কিন্তু জানি না কার প্রভাবে এরা কাজ করে? তাকে আমাদের জানতে হবে। এরা হলো -স্বত্ত্ব, রজোঃ ও তমো গুণ। এই গুণগুলো কার প্রভাবে কাজ করে? কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ ও মাৎসর্য ষড়রিপুর প্রভাবে। এই ১৪টি উপাদান মানুষের কর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে।
 মানুষের ধর্ম এক। ঈশ্বর প্রদত্ত সনাতন মানব ধর্ম। পরবর্তীকালে উপাসনা পদ্ধতি, ঈশ্বরের সাকার-নিরাকার, আছেন কি নেই ইত্যাদি নিয়ে আমরা ভিন্নমত পোষণ করি। ঐ ভিন্ন মতগুলো সবই উপাসনা পদ্ধতি নিয়ে। উপাসনার ভিন্নতায় আমরা ভিন্ন ভিন্ন নাম দিই। আসলে তা ‘মানুষই’ পালন করে। ভিন্ন মতাবলম্বী হলেও কেউ মনুষ্য পদবাচ্য থেকে বিচ্যুৎ হয় না। মতগুলোর অনুসারীদের সংখ্যাধিক্য, অর্থ, প্রতিপত্তি এসব মিলিয়ে আমরা প্রাধান্য দেই। বিভেদ সৃষ্টি আমরাই (মানুষ) করি, এ জন্য ঈশ্বর দায়ী নন। ঈশ্বরের কাছে সব মানুষ সমান। নিজের মতা বা প্রভুত্ব দেখানোর জন্য মানুষ মানুষে পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। আমরা মানুষ একই ধর্ম (সনাতন) আমাদের পালনীয় তবু আমরা বিভক্ত। মানুষই সম্প্রদায় গড়তেও ওস্তাদ। হিন্দু সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব, সৌর, গাণপত্য ইত্যাদি সম্প্রদায় গড়েছে। এছাড়াও সম্প্রদায় গড়েছেনÑ শ্রীরামকৃষ্ণ, প্রভু জগদ্বন্ধু, স্বামী স্বরূপানন্দ, শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র, শ্রীশ্রী রামঠাকুর, শ্রীশ্রী দুর্গাপ্রসন্ন প্রমুখ গুরুগণ। শুধু যে আমাদের মধ্যে ভাগ তা নয়। মুসলিমদের মধ্যে আছে- সিয়া, সুন্নী, হানাকী, সাফী, মোজাদ্দেদী, হাম্বলী; খ্রিস্টানদের  মধ্যে আছে- রোমান ক্যাথলিক ও প্রটেষ্টান্ট। বৌদ্ধদের মধ্যে আছে- হীনযান ও মহাযান। সবই মানুষের তৈরি। শ্রীশ্রী গীতাকে অবলম্বন করলে এরূপ সম্প্রদায় সৃষ্টি সম্ভব নয়। সমিতি মনে করে সকল মানুষ ঈশ্বরের কাছে এক, তার প্রদত্ত ধর্ম সনাতনধর্ম বা মানব ধর্ম। তারই প্রচার প্রসারে সমিতি নিয়োজিত। বেদেও তো বলা আছে- ‘সংগচ্ছধ্বং সংবদধ্বং সং বো মনাংসি জানতাম’ অর্থাৎ এক সঙ্গে চল, এক চিন্তা ধারায় অভিস্নাত হয়ে এক সঙ্গে বল, একে জান অন্যেও মনকে।
  পুরোহিত দর্পণে আছে শূদ্রের কিংবা মহিলাদের বেদ পাঠে অধিকার নেই। ওঁ বা প্রণব উচ্চারণ সকলে করতে পারবে না। আর তা সুযোগ সন্ধানী কিছু লোক জন্মসূত্রে নিজেকে ব্রাহ্মণ দাবি করে সে কথাগুলো পালন করে যাচ্ছে। সমাজও মেনে নিচ্ছে নিজেদের অজ্ঞতার কারণে। ডাক্তারের পুত্র যেমন ডাক্তার হয় না, প্রকৌশলীর পুত্র যেমন প্রকৌশলী হয় না; তেমনি ব্রাহ্মণের পুত্রও ব্রাহ্মণ হয় না তা আমরা ভাবি না। দস্যু রতœাকর পরবর্তীতে বাল্মিকী, নিষাদ পুত্র একলব্য ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেছে, ত্রিয় থেকে বিশ্বমিত্র ব্রাহ্মণ হয়েছেন.. .. .. শাস্ত্রেও এমন বহু বহু উদাহরণ রয়েছে। বর্ণিত গুরুদেবগণও সকলের পূজনীয় হয়েছেন গুণের কারণে। আবার ভাবি না বা জানি না যে বেদে মন্ত্রদ্রষ্টা অনেক মহিলা ঋষিও রয়েছেন। তাঁদেরকে অস্বীকার করব? ওঁ বা প্রণব হলো মন্ত্রের প্রাণ। প্রাণ ছাড়া মন্ত্র নির্জীব বা মন্ত্রের ক্রিয়া হয় না। কারো কি উচিৎ মন্ত্রের ক্রিয়াশীলতা নষ্ট করা বা অধিকার বঞ্চিত করা? আমরা গুণ ও কর্মের পরিবর্তে শুধু পারিবারিক ভাবধারার প্রাধান্য দিচ্ছি। প্রচলিত পদবিকে ‘জাত’ বলে স্বীকার করছি।
  বেদের দশম মণ্ডলের ৯০ সূক্তের ১২ নং ঋকের ব্রাহ্মণস্য মুখমাসীদ্বাহু রাজন্যঃ কৃত।/ উরু তদস্য যদ্বৈশ্যঃ পদ্ভ্যাং শূদ্রা অজায়ত॥’ অর্থাৎ (ঐ পুরুষের) এর মুখ হলো ব্রাহ্মণ, দু’বাহু রাজন্য বা ত্রিয়, উরু বৈশ্য এবং দুচরণ হলো শূদ্র। এখানেও গুণ ও কাজের কথাই বলা রয়েছে। এখন ‘শ্রীশ্রী গীতা’র কথায় আসা যাক। চতুর্থ অধ্যায়ের ১৩ নং শ্লোকে বলা হয়েছে - চতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণ কর্ম বিভাগশঃ অর্থাৎ গুণ ও কর্মানুসারে বর্ণ বিভাগের কথা বলা আছে। তা হলে সবাই ব্রাহ্মণ হতে পারবে? গুণ ও কর্ম বিচারের মাধ্যমে ‘ব্রাহ্মণ’ হতে পারবে। আমরা সে ব্রাহ্মণের সন্ধান চাই, জ্ঞান চর্চায় ব্রাহ্মণ বানাতে চাই। তাই সমিতি বলে থাকে, দেবতা সকলের, পূজার অধিকারও সকলের। গুণ অর্জন করে, মন্ত্র ও ক্রিয়া-কর্ম জেনে দেব-দেবীর পূজা নিজে করুন।
সনাতন ধর্মে উচ্চ বর্ণ নিচ বর্ণ বলে কিছু নেই। তমো ও রজঃ গুণ পরিত্যাগ করে আমরা কি স্বত্ত্ব গুণে গুণান্বিত হতে পারি না! অপরের কল্যাণ চিন্তা, পার্থিব সম্পদে লোভ পরিত্যাগ, শাস্ত্র জ্ঞান লাভে অনুসন্ধিৎসা, কর্মের উন্নত পরিবেশ তৈরি ইত্যাদি কোনো বর্ণে নিষেধ করে নি। প্রত্যেক বর্ণকেই উন্নত করার বিধি সনাতন শাস্ত্রে আছে। সমিতি সকল মানুষকে নির্লোভ, কল্যাণকামী, ঈশ্বরপ্রেমী ও শাস্ত্রজ্ঞানী হওয়ার প্রার্থনায় এক বর্ণে উন্নীত হওয়ার কাজে উদ্বুদ্ধ করছে। এ-ই বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু সমাজ সংস্কার সমিতির “এক বর্ণ”। এখন বলুন তা কি বেদ কিংবা শ্রীশ্রীগীতা বিরুদ্ধ কাজ?
প্রসঙ্গত বলতে চাই যে, জ্যোতিষ শাস্ত্রমতে মানুষের মধ্যে বর্ণভাগ জন্মকালীন সময়েই হয়ে থাকে। বর্ণ নির্ধারিত হয় তিথি, রাশি, নত্র অনুসারে। পরবর্তী জীবনে সে বর্ণ অনুযায়ী কর্ম স্থীর হয়। আমরা কি তা পালন করছি?
আসুন সকলে শাস্ত্র অধ্যয়ন করি, জানি নিজের ধর্মকে।
(বর্ণনা একটু বড় হয়েছে বলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি কামনা করছি।)

1 comment: