লেখকঃদেবাশীষ ভট্টাচার্য্য
মুখবন্ধ
(ভূমিকা লিখতে বসে আমি যা দেখলাম যে সেটাতেই একটা ছোটখাটো বই হয়ে যাবে। তাই তাকেও আবার বহু কষ্টে সংক্ষিপ্ত করে আমি ঠিক করলাম এমন এক ধরনের মুখবন্ধ লিখি যা হয়েতো আজ অবদি কোন গ্র্যন্থে রচিত হয়েনি। আমি ভূমিকাটিকেও কয়েকটি পর্বে ভেঙ্গে দিলাম। কারন আমার এই গ্রন্থ রচনার যে উদ্দেশ্য তা বিরাট। বিপুল। যার ব্যপারে বলতে গেলে কম পরিমান স্থানে তা সম্ভব নয়। আর তাছাড়া এই গ্রন্থ যাদের মূল উদ্দেশ্য করে লিখতে চলেছি তাদের মনস্তাত্মীক স্তর ভিন্ন। তাই আমি কয়েকটি পর্বে ভেঙ্গে দিয়েছি আমার গ্রন্থে ভূমিকা।)
যারা নিজেদের নাস্তিক বলে গর্ব করেন
আমি সনাতন ধর্মে জন্মগ্রহন করেছি। এ আমার পরম সৌভাগ্য। আমি জানি সে কথা, কিন্তু আরও পাঁচজন সনাতন ধর্মে জন্মগ্রহন করা মানুষ কি তা মানেন? সনাতন ধর্ম, যাকে আমরা হিন্দু ধর্ম বলেও জানি, একথাই হয়েত অনেকের জানা নেই, নিজের ধর্মটার মুল কথা জানা তো দুরঅস্ত। আমি একজন হিন্দু হওয়ার যে সৌভাগ্যের কথা বলছি, সকলেই কি তা মন থেকে মানেন যে তিনি হিন্দু হয়ে জন্মেছেন এ তার পরম সৌভাগ্য? কেন মানেননা জানেন? আপনি হিন্দু বা সনাতন ধর্মের যে কি মহানতা, এর ভেতরে যে কি অপরিসীম, অকল্পনীয় বিজ্ঞান ও জীবনচেতনা লুকিয়ে আছে তা আপনাদের জানা নেই। কখনো জানার চেষ্টাটুকুও কি করে দেখেছেন? কোন মহান ব্যাক্তি বা হিন্ধু ধর্মের সম্পর্কে প্রগার জ্ঞান আছে এমন কোন মানুষের কাছে বসেছেন কি সৎসঙ্গ করতে? তবে কিভাবে জানবেন এই মহান ধর্মের মহানতা। যেখানে সামান্য কোন অজানা বিষয় সম্পর্কে জানতেই আমাদের ওপরের সাহায্য নিতে হয় সেখানে কিভাবে আপনি এই সৎসঙ্গ ছাড়া সেই মহানতার আন্দাজ পাবেন? অনেকে হয়েতো বিজ্ঞানের কিছু তথ্য জেনে নিজেকে এতোটাই পন্ডিত ভাবছেন যে আসল বিজ্ঞানটিকেই শুধু কিছু কুসংস্কার আর মিথ্যা বিশ্বাস ভেবে উড়িয়ে দিলেন। কিন্তু ভেবে দেখুন আপনি সেই বিজ্ঞানটুকু জেনে কিন্তু মহান কিছু করতেও পারেননি। যদি আইনস্টাইনের মতন কোন একজন হতে পারতেন তবুও বুঝতাম আপনার জ্ঞান সার্থক। কই তাওতো হলনা। কেন হয়েনি জানেন? কারন আপনার জ্ঞানে অনেক ফাঁক থেকে গেছে। আইন্সটাইন নিজেও কিন্তু ঈশ্বরের শক্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন। কারন? কারন যা আসল জ্ঞান তাই যদি না পান তবে জ্ঞাণী হলেন কিকরে? তবে আপনার এই যে ধর্মের প্রতি বিরূপ ভাব তার কারনও অস্বীকার করিনা। সত্যজ্ঞানের অভাবেই এই জগতে সৃষ্টি হয়ে এসেছে একের পর এক কুসংস্কার। মানুষ অন্ধকারে দুবে থাকছে আর সেই সুযোগের সদ্ব্যাবহার করে জন্ম নিয়েছে হাজার হাজার লোক ঠকানো জ্যোতিষী, তান্ত্রিক, বাবা ইত্যাদি। যেখানে জ্যোতিষ শাস্ত্র একটি অতি উন্নত বিজ্ঞান সেখানে এই সমস্ত ভন্ড মানুষদের নিচ মানসিকতা, ও লোভের কারনে সেই অতি উত্তম শাস্ত্রকে ভুল কাজে ব্যাবহার করার ফলে আজ মানুষ সেই শাস্ত্রকেও অবহেলা করছে। জ্যোতিষের কথা শুনলেই তাই আজ শিক্ষিত মানুষরা জ্যোতিষশাস্ত্রের কত শক্তি, কত উন্নত সেই বিজ্ঞান তা না জেনেই, বা তার বিচার বিশ্লেষন না করেই তাকে অবজ্ঞা করতে শিখেছে। আর এর ফলেই ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয়েছে ধর্ম, শাস্ত্র ইত্যাদির প্রতি মানুষের অণীহা। আর এর জন্যে দায়ী সেই সব পাষন্ড, ধর্মের নামে নিজের স্বার্থসিদ্ধি চরিতার্থ করতে তৎপর লোভী মানুষের দল। এখন আবার নতুন একটি সমস্যা। সব জ্যোতিষীই তবে লোভী বা ভুল? না তাও নয়। অনেক ভালো মানুষ আজও এই পৃথিবীতে আছেন। তা না থাকলে আজও একটি লোক রোদে মাথা ঘুরে পরে গেলে বা ট্রেনে উঠতে গিয়ে পরে গেলে দশজন মানুষ তাকে সাহায্য করতে, তাকে ধরতে ছুটে আসত না।
দেখুন আপনি নিজেকে নাস্তিক মানেন, কিন্তু আপনি কি নিজেকে বিশ্বাস করেননা? করেনতো? তাহলে কিকরে বলেন "আমি ধর্ম মানিনা"? আমাদের ধর্মের তো এটাই শুরু থেকেই শিক্ষা যে নিজেকে চেন। আত্মজ্ঞান না জন্মালে, নিজেকে না চিনলে ধর্ম মানা হয়েনা। তাহলে আপনিতো না জেনেই ধর্ম মেনে বসে আছেন। আচ্ছা, আপনি আপনার গুরুজনদের শ্রদ্ধা করেননা? তাহলে কিকরে বললেন শাস্ত্র মানেন না? শাস্ত্রেতো একথাই লেখা আছে। আপনি কি চান, সমস্ত মানুষ নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মরে যাক? এই পৃথিবী শ্মশানপুরিতে পরিনত হোক? নিশ্চয়ই চাননা? তাহলে কিকরে বলেন শাস্ত্র, ধর্ম মানিনা। কারন সেখানেতো পরস্পকে প্রেম ভালোবাসার কথাই বলা হয়েছে বারে বারে। কি, তাও হচ্ছেনা? আসলে তাও মানবেননা কারন আপনার মাথায় তো ঢুকে আছে সেইসব কথাগুলো যা কোন শুভ বিচারের মাধ্যমে বিচার না করে, কিছু ভুল বিচারে আপনার কাছে পৌঁছেছে। ভেবে দেখুন, আপনি হিন্দু ধর্মের নানা গোঁড়ামির কথাই জানলেন আর তা দেখে ভেবে বসলেন যে এই ধর্ম শুধু ভ্রান্ত কিছু ধারনা, গোঁড়ামি আর কুসংস্কার ছাড়া আর কিছু নয়। আসল বিষয়সমুহ জানার প্রয়োজনটুকু ভুলে। কিন্তু ভেবে দেখুনতো আপনি কি গোঁড়া নন? কুসংস্কারী নন? যেখানে আপনি কোন বড়সড় বিজ্ঞানি না হয়েও কিছু বিজ্ঞানের কথা যেনে ধর্মকেই মানতে চাননা, চোখে দেখেননা বলে ভগবানকে মানতে চাননা, আপনি কি গোঁড়ামি করছেননা? আচ্ছা, আপনি মোবাইল ব্যাবহার করেন। আপনাকে যদি বলি আপনার মোবাইলটায় যে তরঙ্গের মাধ্যমে কথাগুলো পৌঁছচ্ছে, আপনি কি আমায় দেখাতে পারবেন? খালি চোখে? কোন যন্ত্র ব্যাবহার ছাড়াই? পারবেন কি? পারবেন না?যাঃ। যা মানুষের তৈরী বস্তু, যার প্রতিটি বিষয় বিজ্ঞানের হস্তগত, তাও আপনি দেখাতে পারছেননা কোন কিছুর সাহায্য ছাড়া খালি চোখে, তাহলে যিনি স্বর্বশক্তিমান, তাঁকে আপনি খালি চোখে দেখতে চান কিভাবে? হ্যাঁ তাও সম্ভব। কিকরে? যেমন আপনি আপনার কোন যন্ত্রের মাধ্যমে আপনার ওই মোবাইলের তরঙ্গ দেখাতে পারবেন ঠিক তেমন করেই। এখানে আপনাকে যে যন্ত্রটি ব্যবহার করতে হবে তার নাম "আধ্যাত্মিকতার জাগরন ও উন্নতি"। আর সেই পথেই আপনি সব প্রশ্নের উত্তর পাবেন, বা যাকে কোনভাবেই মেনে নিতে পারেননা, তাঁকে জানতে পারবেন। তখন দেখবেন আপনি যা জানতেন তার থেকে আরোও কত কিছু জানলেন। শুধু কষ্ট করে এই গ্রন্থ পরুন একটি বাজে গল্পের বই পরে সময় নষ্ট করছেন ভেবেই পরুন। ভগবান আপনাকে সুমতি দিন।
নাম নিয়ে আরও কিছু আলোচনা করা যাক যার ভেতর থেকে আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর বেড়িয়ে আসবে। আপনি একজন মানুষ। কিন্তু ভেবে দেখুন আপনারই কত রূপ। কিভাবে? আপনি কারও ছেলে। তখন মা বাবার কাছে আপনার একজন সন্তানের রূপ। তখন আপনার এই রূপের ক্রিয়া কি? ভক্তি, শ্রদ্ধা ইত্যাদি। এখন আপনি হয়েত কারও স্বামী। তখন আপনার ক্রিয়া প্রেম, ভালোবাসা, দায়িত্ব ইত্যাদি। আবার আপনার সন্তানের ক্ষেত্রে আপনার রূপ বাবার ন্যায়। সেই অনুযায়ী আপনার ক্রিয়ারও ভেদ হবে। শুধু এই নয়, আপনার কর্মজগতে, অফিসে, রাস্তাঘাটে, বন্ধুদের কাছে, পাড়ার মানুষদের কাছে ইত্যাদি নানা যায়গায় নানা মানুষের কাছে আপনার নানা রূপ ও ক্রিয়া। এবার ভেবে দেখুন আপনি একজন সাধারন মানুষ হয়েই যদি আপনার এত মানুষের চোখে নানান বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে চরিত্র, ক্রিয়া ইত্যাদির ভেদ দেখা যায়, তবে যিনি সর্বস্ব, সর্বশক্তিমান, যিনি সবার ওপরে, তাঁর নানা রূপ নানা শক্তি কল্পনা কি নিরর্থক? আবার ঠিক একই কারনে একই রূপের আবার বহু নামও আছে। যেমন শ্রীকৃষ্ণের একশত আট নাম ইত্যাদি।
প্রকৃতির যে শক্তিতে দুষ্টের দমন হয়, দুর্গতির বিনাশকারি ঈশ্বরের সেই শক্তির রূপের নাম মা দুর্গা। এখন লক্ষ করুন, প্রকৃতির মাঝে পর্বত সবচেয়ে উচ্চ বস্তু। আর তার মধ্যে ভারতীয়দের কাছে সর্বচ্চ পর্বত হল হিমালয়। আর এই কারনেই সেই প্রকৃতি স্বরূপিনী মা দুর্গার পিতার নাম হিমালয়। কত অপুর্ব এই চিন্তা। যিনি বা যাঁরা এই কল্পনা করেছিলেন। আমরা শ্রী শ্রী চন্ডী থেকে জেনেছি যে মা কালীর উৎপত্তি হয় মা চন্ডীর কপালের তৃতীয় নেত্র থেকে। এই রূপকটির অর্থ নির্নয় করা যাক। মানুষের যখন প্রচন্ড রাগ উৎপন্ন হয় তখন কপালে ভাঁজ পরে। অর্থাৎ ভ্রূকুটি কুটির হয়। তাই এই কপাল থেকে মা কালীর উৎপত্তির মাধ্যমে প্রচন্ড রাগকেই বোঝান হয়েছে। যা প্রচন্ড ধ্বংসের প্রতিক। আর তাই মা কালী মহা প্রলয় বা ধ্বংসের দেবী রূপেই অঙ্কিতা হয়েছেন। এই প্রসঙ্গে আরোও একটি সুন্দর ব্যাখ্যা নিয়ে আসি যা আমার মাথায় যখন এসেছিল আমি নিজেই হতবাক হয়ে গেছিলাম। তা যে মায়ের কৃপাতেই আমার মাথায় এসেছিল তা বুঝতে অসুবধা হয়েনি। আর মা আমার মাথায় এই বিষয়গুলি কেন প্রবেশ করান, তা যে শুধুই মানুষকে জানানর উদ্দেশ্যে সে বিষয়েও আমার মনে কোনপ্রকারের সন্ধেহের অবকাশ নেই। কারন ছাড়া কার্য হয়েনা। তা যদি আবার মায়ের কার্য হয় তবেতো তার কারন আরও ব্যপক এ কথাতো মানবেন। যাই হউক, বিষয়টিতে প্রবেশ করি। যে শক্তিকে বা পরমেশ্বরের যে রূপকে আমরা পূজা করি তার ঠিক সেই প্রকারের পূজার উপচার, স্থান ও নিয়ম নির্দিষ্ট করা হয়েছে। অনেকের মতে ইহা হয়েতো ভন্ডামি। কিন্তু কেন তা নয়, এবং এইসকল উপচারের কিবা প্রয়োজন তার বিচার করছি। পরমেশ্বর ও তাঁর শক্তি সর্বত্র এতো জানাই হয়েছে। তাই একথা শোনা যায় যে যেকোন স্থানেই তাঁকে পূজা করা যায়। একথা সত্য। কিন্তু সাধারন মানুষ সেই কল্পনা সাধারন ভাবে করতে পারেনা, সেই মূর্তি বা তাঁর অপার শক্তির কল্পনা করতে পারেননা বলেই নানা মুর্তির প্রয়োজন হয়ে থাকে। যেমন আমি আগেই দুঃখ, রাগ, হাসি ইত্যাদি প্রকাশে নানা ধরনের ছবির ব্যাবহারের কথা বলেছি। তাই মন্দির, পূজার আয়োজন ইত্যাদির প্রয়োজনও আছে। ভেবে দেখুন, আপনাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে প্রচুর জানজটের মাঝে যদি কেউ মোবাইলে খুব ভালো কোন সিনেমা দেখায়, আপনার কি ততটা ভালো লাগবে যতটা ভালো লাগবে কোন মাল্টিপ্লেক্স সিনেমাহলে বসে, এসির শিতল হাওয়ায় পপকর্ন খেতে খেতে চিন্তা মুক্ত মাথায় দেখলে? সিনেমা দেখাটিকে এক্ষেত্রে যদি পূজা ধরি তবে সিনেমা হলটি হল মন্দির। পপকর্ন ও এসি হল পূজার সামগ্রী ইত্যাদি। এই কারনেই পূজার আয়োজনে সঠিক স্থানে তা হোলে সমগ্র মনটি তাতে নিবিষ্ট হয়ে যায়। ব্যাতিক্রম শুধু মহাপুরুষগন। তাঁদের কাছে রাস্তাতেও যে ঈশ্বর, মন্দিরেও তাই। কিন্তু সাধারন মানুষের কাছে এই কল্পনা অনেক কঠিন, তাই এই ব্যাবস্থা। এখন প্রশ্ন হল তবে কি স্থান মাহাত্য বলে কিছু নেই? সর্বস্থানে ঈশ্বর রয়েছেন, সর্বস্থানে তাঁকে পূজা করা গেলে বিশেষ বিশেষ স্থানে জ্যোতির্লিঙ্গ, সতীপিঠ ইত্যাদির কি তবে মাহাত্ম নেই? আছে বৈকি। তারও সহজ সরল উদাহরন স্বরূপ ব্যাখ্যা দি এইস্থানে। ধরুন আপনি ডাক্তার। আপনি রুগি চেম্বারে দেখেন, কলে যাননা। আপনার কোন রুগি যদি আপনাকে খুঁজতে অযথা কোন ভুল স্থানে না গিয়ে আপনার চেম্বারে ঠিক সময় আসেন তবে আপনাকে পাওয়ার সুযোগ থাকবে সেতো বলাই বাহুল্য। দেখুন, এখানে সময়েও একটা ব্যাপার। দিন, সময় ইত্যাদি। কারন ডাক্তারের সেই সময়, দিন ইত্যাদি স্থির থাকে। ঠিক এই কারনেই আবার বিশেষ বিশেষ দেবতার পূজারও দিন সময় ইত্যাদিও ঠিক করেছিলেন সেই মহাত্মাগন। যেমন সোমবার শিবের পূজা ইত্যাদি। এই হল স্থান, সময় ইত্যাদির মাহাত্ম। তবুও যাঁরা মহাত্মা, তাঁরা যেকোন সময় যেকোন স্থানেই একই ফল লাভে সমর্থ হন। এরও সরল উদাহরন আছে। আপনার রুগি যদি বিরাট কোন ব্যাক্তিত্য হন তখন আপনি নিজের সময় বা স্থানের বাইরে গিয়েও তাঁকে দেখতে যেতে পারেন। যেমন আপনাকে যদি দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজের চিকিৎসার জন্যে ডেকে পাঠান, হয়েত আপনি সারা দেবেন। ঠিক এই ব্যাপারটাই ঘটে মহাত্মাদের ক্ষেত্রে। তাঁরা তাদের কর্ম দ্বারা এতই ওপরের স্তরে পৌঁছে গেছেন যেখানে ঈশ্বর তাঁদের ডাকে সারা না দিয়ে পারেন না। যেস্থানে যে অবস্থাতেই ডাকুন না কেন। এখন দেখুন ঈশ্বরের শক্তিভেদে ও রূপভেদে আবার স্থান, পূজা ইত্যাদির পদ্ধতি কেমন সুন্দর করে আমাদের পূর্বপুরুষগন সৃষ্টি করে গেছেন। সেই আলোচনা এবারে করা যাক।
মনে করা যাক কৃষ্ণের মূর্তি। তিনি তাঁর বাঁশি হাতে অপুর্ব সুন্দর সুরমাধুরিতে চারিদিকে মুখরিত করছেন। এই পরিবেশে যদি তাঁকে পূজা করা হয়, স্মরন করা হয়, শ্রদ্ধা জানান হয় তবে কেমন পরিবেশ প্রয়োজন? মনরম, সুগন্ধিতে ভরা, আনন্দে উন্মত্ত মনে, সঙ্গীতে বাদ্যে মুখরিত পরিবেশে। তাই নয় কি? আবার অপর দিকে খেয়াল করুন, মা তারা, ঈশ্বরের এই শক্তি রূপটি যে পরিবেশে কল্পনা করা হয়েছে তা শত্রু দমনে সমস্ত শত্রুর মস্তক ছিন্ন করে মা সকলকে রক্ষা করছেন। অর্থাৎ মা কোন স্থানে অবস্থান করছেন? কি রূপে? যেখানে চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে শত্রুদের মৃতদেহ। এখন ভেবে দেখুন প্রচুর মৃতদেহ কোথায় দেখা যায়? শ্মশানে। সেই ভয়ঙ্কর পরিবেশ, যা ভাবলে মানুষের মন শিউরে ওঠে সেই পরিবেশের উপযুক্ত স্থান শ্মশানই। তাই না? আর তাই মা তারার ধ্যান, চিন্তন ইত্যাদির ক্ষেত্রে উপযুক্ত স্থান বিহিত হয়েছে শ্মশান। ইহা কি অনুপযুক্ত হয়েছে? তাই যদি হবে তবে কৃষ্ণের ক্ষেত্রেও অনুপযুক্ত হওয়া উচিত? তাই নয় কি? এই কারনেই আমি বলি কৃষ্ণও যিনি কালীও তিনি।
এবারে মহাদেবের রূপকার্থ বর্ননা করছি। প্রলয় কর্তা অর্থে ঈশ্বরের নাম মহেশ্বর। কোন কিছুর সৃষ্টি হলেই ধ্বংস অবশ্যম্ভাবি। কিন্তু এই সৃষ্টি থেকে ধ্বংসের মাঝে কিছু সময় বা কালের ব্যাবধান থাকে। তাই মহাদেবকে একাধারে মহাকালও বলা হয়ে থাকে। আবার যিনি সকল ধ্বংসের কর্তা তাঁর কি নিজের কোন ধ্বংস থাকতে পারে? তাই শিবের আরেক নাম মৃত্যঞ্জয়। যাঁর মৃত্যু নেই। মহাদেবকে আদি দেব বলা হয়। এর তাতপর্য এই যে কাল সবসময় বর্তমান ছিল। যখন কিছুই ছিলনা তখনও কাল ছিল। তাই তিনিই ঈশ্বরের আদি রূপ। তিনিই যেহেতু ঈশ্বরের কালরূপে কল্পিত তাই তিনি সর্বজ্ঞ। কারন সমগ্র কালে তিনি ছিলেন তাই সব কালের কথাই তাঁর অবগত আছে। শিবের শক্তি হলেন মা কালী। তিনি শিবের ওপরে অবস্থিতা। শিব মা কালীর পায়ের নিচে শবরূপে অবস্থিত। "শবরূপ মহাদেব হৃদয়োপরিসংস্থিতাম" (মা কালীর ধ্যান মন্ত্রের অংশ)। এর কি ব্যখ্যা? এর ব্যখ্যা এই যে, যেন কোন মানুষের শরির থেকে শক্তি নির্গত হয়েছে আর তাই শক্তিবিহীন শরীরটি পরে রয়েছে শবরূপে। আর তাঁর সেই শক্তি তাঁর কার্যই সাধন করছেন। অর্থাৎ ধ্বংস কার্য। এই এর রূপকার্থ। ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরানের প্রকৃতি খন্ডেও ঐ কথাই বলা হয়েছে। "শিবশক্তস্তয়া শক্ত্যাশবাকারস্তয়া বিনা"। অর্থাৎ শিব শক্তিসহ থাকলেই শক্তিমান, নয়েত শবাকার হন। শিব শবরূপে শয়ন করে আছেন আর তাঁর শক্তি মা কালী তাঁর ক্রিয়া করছেন তাঁর শরীর থেকে নির্গত হয়ে। তাই শিবও যিনি, কালীও তিনি।
আগে বলেছি কৃষ্ণও যিনি কালীও তিনি, এখন শিবও যিনি কালীও তিনি প্রমান হওয়াতে বোঝা গেল শিব, কালী ও কৃষ্ণে কোনই ভেদ নেই। শুধু আমাদের মনের ভ্রান্ত ধারনায়, বোঝার ভুলে যতসব ভেদের সৃষ্টি হয়।
এবারে বিষ্ণুর রূপ। ঈশ্বরের সৃষ্টি কার্যের রূপই হলেন বিষ্ণু। তাঁর চারটি হাত। দুটি হাতে চক্র ও গদা, যা সৃষ্টি কার্যে বাঁধাদের দূর করার প্রতিক। আর দুহাতে শঙ্খ ও পদ্ম যা যথাক্রমে শত্রু দমনের পর শত্রু বিজয়ের প্রতিক ও শান্তির প্রতিক। কোমলতা ও সুন্দরতার প্রতিক। এবার লক্ষ করার মতন বিষয় হল, এই বিষ্ণুরই অবতার কৃষ্ণের কিন্তু দুটি হাত কল্পনা করা হয়েছে। কারন তিনি শত্রু নিধনে নন, বাঁশি হাতে একজন সুন্দর প্রেমিক রূপেই বেশি করে আমাদের আছে গ্রহনযোগ্য, আর তাঁকে সেইভাবেই কল্পনা করা হয়েছে। এইভাবে সেই মহান পূর্বপুরুষগন তাঁদের মহানুভবতার দ্বারায় নানা দেবদেবীর কল্পনা অতি নিপুন ভাবে করে ছিলেন। (এই স্থানেই একটি কথা বলি যে এইসব দেবদেবীর একএকজনেরই রূপকার্থ বোঝা বা তাকে বিশ্লেষন করার ক্ষমতা আমার নেই, এবং যদি কেউ তা করে থাকেন তবে একটি রূপের ব্যখ্যা দিতে গিয়েই সারা জীবন কেটে যাবে এনাদের রূপকার্থ এতই ব্যপক। তবুও আমার এই গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্যের খাতিরে এইটুকুই ব্যখ্যা দেওয়া উপযুক্ত মনে করি। এক্ষেত্রেও আমার উদাহরন প্রয়োগ করি। যেমন প্রথম শ্রেনীর কোন শিক্ষার্থীর কাছে গ্রহ সম্পর্কে জানাতে গেলে শুধু তাদের নাম ও সামান্য কিছু বিষয় বলেই ছেড়ে দেওয়া হয়, গ্রহ সম্পর্কিত মহা মহা তথ্য তাদের জানান হয়েনা তারা কিছুই বুঝবেনা সেই কারনে, ঠিক তেমনই আমি নিজে আধ্যত্মিক জগতের একজন নিচু শ্রেনীর ছাত্র (হয়েত বা তাও নই) হয়ে, একজন প্রথম শ্রেনীর মানুষকে জানাতে গেলে এটুকুই ব্যাক্ত করা উপযুক্ত মনে করলাম।)
এইভাবেই যদি বিশ্লেষন করা যায় তবে দেখা যাবে যে আমরা প্রত্যেকটি দেবদেবীরই উৎপত্তির কারন ও মায়ের সেইসব শক্তিগুলির রূপ সম্পর্কে একটি সচ্ছ ধারনা পাব। যদিও তাঁরা সকলেই এক। শ্রী শ্রী সিতারাম দাস ওঙ্কারনাথ ঠাকুর একবার একটি দুর্গা মুর্তি দেখে এই বিষয়টিকেই কত সুন্দর করে বলেছিলেন "তাইত তোমায় চেনবার উপায় নাই, বাঁশি লুকিয়েছো , সে কাল রঙ আর নাই, দু’হাতের স্থানে দশ হাত করেছো, তিনটি নয়ন হয়েছে, পুরুষদেহ ত্যাগ করে রমনী হয়েছো, সবই ছেড়েছো, কিন্তু ত্রিভঙ্গ ঠামটি ত ছারতে পারনি! এইখানে ধরা পড়ে গেছো।" কত সরলভাবে বুঝিয়ে দিলেন যে মা দূর্গাই শ্রীকৃষ্ণ।
এই সুত্র ধরেই একটা কথা মনে এলো যে বেশ কয়েকবছর আগে আমার মনে একটা প্রশ্ন জেগেছিল দুর্গা মূর্তি দেখে যে দুর্গার সাথে চার ছেলে মেয়ের যে কাহিনী রয়েছে লোককথার ন্যায় তার বিষয়টা কি? পরে যখন জেনেছিলাম এঁরা সকলেই এক তখন আরো গুলিয়ে গেছিলো বিষয়টি যে তবে মা দুর্গার একার পুজা কেন করা হয়েনা। চারজনের কি প্রয়োজন। মায়ের দয়ায় তারও উত্তর পেয়ে গেলাম। মা দুর্গা শক্তি জেগেছিল অসুর নিধনে, দুর্গতির বিনাশকার্যের কারনে। কোন দুর্গতির বিনাশ কালে মা শক্তির থেকে দুর্গা নামে যে শক্তির উতপত্তি হয় তা পেলে আর্তিকের ন্যায় দুর্যয়, ভয়হীন, সেনাপতির ন্যায় সৌর্য বীর্য সম্পন্ন মানুষের তুল্য হয়ে যায়, তাই কার্তিকের রূপক সাথে থাকে। মহাশক্তির থেকে বহু সিদ্ধির লাভ হয়ে বলে সিদ্ধিদাতা গনেশের কল্পনা। আবার দুর্গতির নাশ হলে, অশুভ জ্ঞানের অন্ধকার কেটে গেলে শুভ জ্ঞানের আলোকে চারিদিক শ্বেতশুভ্র উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তাই মা সরস্বতী দেবীর কল্পনা ও তৎসহ শোভা ও নানা সম্পদের প্রাপ্তির কারনে মা লক্ষী দেবীর কল্পনা বোধহয় যথার্থ। আর সর্বপরি মা দুর্গার মাথার ওপরে ভগবান মহাদেবের থাকার কারন, দুর্গতির বিনাশে, সমস্ত অন্ধকার নাশে, সেই মহান পরমপুরুষ কে আমরা লাভ করতে সমর্থ হতে পারব। তাই উর্গা মুর্তিতে নিচ থেকে উপরিস্থল অবদি শক্তির স্তবন, তার দ্বারা মা দুর্গতি নাশিনী মা শক্তির জাগরন, নানাবিধ কৃপা ও সিদ্ধি লাভ ও সবার ওপরে পরমপুরুষ পরমাত্মাকে লাভ করার ধাপ গুলিকেই একত্র করা হয়েছিল মহান সেই সব পুর্বপুরুষগনের দ্বারা।
এতবধি আলোচনা দ্বারা এই কথাটি তো স্পষ্ট হল যে নামরুপকার্থ কিভাবে পূর্বপুরুষগণ সৃষ্টি করে গেছিলেন। কিন্তু আমি বলছি বলেই যে তা মানতে হবে তা তো নয়, তার জন্যে প্রমানের প্রয়োজন আছে বৈকি। মহানির্বাণ তন্ত্র থেকে এই অংশটি দিলাম :
এবঙ্গুণান্যসারেণ রূপানি বিভিধানিচ।
কল্পিতানি হিতার্থায় ভক্তানামল্পমেধসাং।।
অর্থাৎ এইরূপ গুনের অনুসারে নানা প্রকার রূপ অল্পবুদ্ধি ভক্তদিগের নিমিত্ত কল্পনা করা হয়েছে।
যাই হোক আমার আলোচনা ও রূপ কল্পনা ও তার অর্থ নিয়ে আরো দুচার কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি কারণ সেই বিষয় গুলি ভেবে আমার নিজেরই বড় অবাক লেগেছে। এতক্ষণের আলোচনায় এ বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে ভগবান পরমেশ্বরের নানা কার্যের ক্ষেত্রে পুরুষ রূপ ও তাঁর কার্য করার শক্তিকে স্ত্রী রূপে কল্পনা করা হয়েছে। যদি ভাবি মা সরস্বতী দেবীর কথা। আমাদের যখন সঙ্গীত সাধনার বা বাদ্য সাধনার ইচ্ছা জন্মায় তখন যে শক্তির মাধ্যমে আমরা সেই সাধনা করতে পারি তাই মা সরস্বতী। অধ্যাবসায়ের ক্ষেত্রেও একই কথা। তাই বিদ্যা, সঙ্গীত ইত্যাদির ক্ষেত্রে মা আদ্যাশক্তির সেই সগুণ শক্তির রূপই হলেন মা সরস্বতী। তাই মা সরস্বতীর পূজা বা স্তবন দ্বারা আমরা সেই কর্মগুলি করতে সক্ষম হব এর অর্থ যে আমরা মা অদ্যাশক্তির সেই গুনটিকে পেতে চাই যা মা সরস্বতী রূপে অঙ্কিত হয়েছে।
মা মনসার ব্যপারে ভেবে আমরা আরো অবাক লেগেছে যখন তাঁর বিষয় ভেবে কিছু সূত্র পেতে সক্ষম হয়েছি তাঁর কৃপায়। মা মনসা বিষহরি। সর্পের দেবী রূপে অঙ্কিতা। কিন্তু যদি আমরা একটু অন্য ভাবে ভাবি। আমাদের শরীরে কুণ্ডলিনী বলে একটি সুপ্ত শক্তি বর্তমান রয়েছে তা হয়েত অনেকেই জানি। যারা জানেননা তাদের জন্যে নাহয় পরে কোন এক পরিসরে আলোচনা করা যাবে। সেই কুণ্ডলিনী শক্তিকে অঙ্কিত করা হয়েছে সর্পের রূপে। সেই শক্তি জাগ্রত করার কথা আমরা পাই নানা তন্ত্রে। যেখানে সেই শক্তিকে পূজা করা ও জাগরিত করার জন্যে পুরুষ রূপে ভগবান শিবকে পূজা করা হয়। এখন মা মনসাকে সর্পের দেবী বলার অর্থ এই নয় তো যে তিনি এই কুলোকুণ্ডলিনীর সাথে কোন ভাবে যুক্তা? আর তাঁকে ভগবান শিবের কন্যাও বলা হয়েছে। তাই শিবের সাথে তাঁর একটি সম্পর্কও রয়েছে। আবার আমাদের শরীরে রয়েছে সাতটি চক্র যা ভবিষ্যতে কুণ্ডলিনী নিয়ে আলোচনা করার পরিসরেই বলার অপেক্ষায় এখানে আর আলোচনা করলাম না। অর্থাৎ এই সাতটি চক্র সেই কুণ্ডলিনীর সাথে যুক্ত। আবার মনসা মঙ্গল কাব্যে দেখানো হয়েছে মা মনসার কোপে চাঁদ সদাগর বনিকের ৭ টি জাহাজই নষ্ট হয়েছিল। সংখ্যাটি অন্য কিছুও হতে পারতো। কিন্তু সেই ৭ ই ধরা হয়েছিল। আবার তাঁর কোপে বনিক সর্বস্ব হারিয়েছিলেন। অর্থাৎ তার মানে কি এমন কিছু দাঁড়ায় না যে এই কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগাতে পারলেই সেই ৭ টি চক্রকে রক্ষা করা সম্ভব? এখানে মা মনসার কোপ অর্থে কুণ্ডলিনী শক্তির অপব্যবহার বা নিঃব্যবহার। আবার সবকিছু হারান অর্থে যে শক্তি একজন মানুষ কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগরিত করলে পেতে পারেন তা না জাগানোর ফলে হারান। এমন চিন্তার আরেকটি কারনও আছে, মনসামঙ্গল কাব্য কিন্তু তন্ত্র আসার পর লেখা হয়েছে।তাই সেক্ষেত্রে এই কুণ্ডলিনী বিষয়টি থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
১৬৬৬-৭২ সালে স্যার আইজ্যাক নিউটন যখন আমাদের প্রথম দেখালেন যে প্রিজমের মাধ্যমে সূর্যালোক পড়লে ৭ টি রং বিচ্ছুরিত হচ্ছে, মানুষ তখন নিশ্চয়ই অবাক হয়েছিল এই বিরাট আবিষ্কার দেখে। কিন্তু ভেবে দেখুন সেই আবিষ্কারের কয়েক কয়েক হাজার বছর আগে হিন্দু ধর্মের সেইসব মহামানবের কোন অপার বুদ্ধির দ্বারায় সূর্যদেবের ৭ টি ঘোড়ার কল্পনা করেছিলেন? সূর্যদেবের রূপকার্থে তবে কি এই কথাটি বলাই যায়না যে তাঁর ৭ টি ঘোড়া তাঁর সেই সাতটি রঙেরই প্রতিক? আপনারাই ভেবে দেখুন। অবাক না হয়ে পারবেন না তাই না?
এইভাবে আলোচনা করতে থাকলে পাতার পর পাতা শুধু বিশ্লেষনই চলতে থাকবে।তাই এ বিষয় নিয়ে আর কিছু বলছিনা। ভবিষ্যতে আরো কিছু আলোচনা করার অপেক্ষায় নাম রূপকার্থ এখানেই সমাপ্ত করলাম।
No comments:
Post a Comment