ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করে জীবন উৎসর্গ করেছেন মাস্টারদা সূর্য সেন (১৮৯৪-১৯৩৪)। চট্টগ্রাম বিদ্রোহের নায়ক হিসেবে মাস্টারদার নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে উপমহাদেশের সব স্তরের মানুষ। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রামে ব্রিটিশদের অস্ত্রাগার লুট করে তিনি বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছিলেন।
অথচ রাষ্ট্রীয় নথিতে তিনি দেশের শত্রু। চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়া গ্রামে সেই মহান বিপ্লবীর বাড়ি-ঘর চিহ্নিত করা হয়েছে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে। কারণ তিনি 'শত্রু রাষ্ট্র' ভারতের বাসিন্দা! নোয়াপাড়া ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ রাধা রানী দেবী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ব্রিটিশদের চোখে মাস্টারদা শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হওয়া স্বাভাবিক। পাকিস্তানি শাসকদের কাছেও তিনি শত্রু বলে গণ্য হতে পারেন। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি কেন শত্রু হিসেবে গণ্য হবেন?'
নোয়াপাড়া ইউনিয়ন ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, মাস্টারদা সূর্য সেনের বাড়ি ১৯৭৬ সালের ৮ নভেম্বর শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে সরকার, যার নথি নম্বর-২৩৯। সে নথিতে সূর্য সেনের হাল সাকিন দেখানো হয়েছে ভারত। অথচ ১৯৩৪ সালে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়। রাউজান থানার নোয়াপাড়া মৌজার প্রত্যর্পণযোগ্য সম্পত্তির তালিকা থেকে জানা যায়, নোয়াপাড়া মৌজায় সূর্য সেনের জমির বিএস (বাংলাদেশ সার্ভে) দাগ নম্বর-১৮৫৪৭, ১৮৫৪৮, ২০২১২, ১৮১৪৮, ১৮২৪০, ১৮১৪৫, ১৮১৪৬, ১৮৫৪৫ ও ১৮৪৮৭। সেখানে জমির পরিমাণ মোট ৮৩ শতাংশ।
তা ছাড়া একই মৌজার বিএস ১৮৫৪১, ১৮৫৪৪, ২০১০৯, ১৮৫৩৯, ১৮৫৪৩, ১৮৬৩৮, ২০১০৮, ১৮৬৩৮ ও ২০১০৭ নম্বর দাগে সূর্য সেনের পরিবারের আরো দুই একর সোয়া আট শতাংশ জমি রয়েছে। ওই জমির শ্রেণী উল্লেখ করা হয়েছে বসতভিটি, পুকুর, পথ, নাল ও খাই (ছোট জলাধার) হিসেবে। ওই জমি ১৯৬৭ সালের ৩০ জানুয়ারি শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়, যার নথি নম্বর-৩৫৯। নোয়াপাড়ার পথেরহাট বাজারে ইউনিয়ন তহসিল অফিসে গিয়ে সহকারী ভূমি কর্মকর্তা রঞ্জিত কুমার পালের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এরই মধ্যে সূর্য সেন ও তাঁর পরিবারের সব সম্পত্তি মাস্টারদা সূর্য সেন স্মৃতি সংসদের নামে লিজ দেওয়া হয়েছে। সম্পত্তির ওপর সূর্য সেনের স্মৃতিস্তম্ভ ও হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়েছে। তবে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন পাস না হওয়া পর্যন্ত এসব সম্পত্তি শত্রু বা অর্পিত হিসেবেই তালিকাভুক্ত থাকবে বলে তহসিলদার রঞ্জিত কুমার পাল জানান।
বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার জন্য পাকিস্তান গণপরিষদে ১৯৪৮ সালের ২৫ আগস্ট প্রথম দাবি তুলেছিলেন কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮৬-১৯৭১)। মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৯ মার্চ তাঁকে ও তাঁর ছেলেকে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে পাক-হানাদার বাহিনী। তাঁর লাশের হদিস পাওয়া যায়নি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রামরাইলে তাঁর বাড়ি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে সরকার। 'যাঁর রক্তে দেশ স্বাধীন হলো, তাঁর বাড়ি কিভাবে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত হলো' সে প্রশ্ন কুমিল্লার সংস্কৃতি কর্মী জাবেদ আখতারের।
জানা যায়, কুমিল্লা শহরে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বসতবাড়ি জাল দলিলপত্রের মাধ্যমে দখলের চেষ্টা করা হয়। এ ব্যাপারে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনি আরমা দত্ত বলেন, 'অনেক চেষ্টা-তদবির করেও দাদুর বাড়ি শত্রু সম্পত্তির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যায়নি। এত বড় দেশপ্রেমিকের বাড়ি-ঘর শত্রু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করার মতো লজ্জা আর কী হতে পারে?'
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, রবি নিয়োগী ও কবি নবীন চন্দ্র সেনের জমিজমাও শত্রু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, 'আসলে শত শত কোটি টাকার সম্পত্তি দখল করে নেওয়ার জন্যই তাঁদের শত্রু হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।' তিনি বলেন, 'যত বড় দেশপ্রেমিক কিংবা বিপ্লবী হোক না কেন, তাঁদের একমাত্র অপরাধ তাঁরা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ছিলেন। এ একটি মাত্র কারণেই এ দেশের অসংখ্য মানুষকে শত্রুর তালিকায় ফেলে তাঁদের সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া হয়েছে।' সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন বলেন, 'রাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি অবিচার করেছে জে এম সেন অর্থাৎ যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের প্রতি। তিনি ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন সেনের প্রধান অনুসারী এবং ব্যারিস্টার। ১৯২১ সালে স্বাধীনতার জন্য তিনি অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে নিজের আইন পেশা পরিত্যাগ করেন। তাঁর স্ত্রী নেলী সেনগুপ্ত ছিলেন ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি। এমন সম্মান দেশের খুব কম মহিলার ভাগ্যেই জুটেছে। অথচ তিনি জীবিত থাকাকালে রহমতগঞ্জের বাড়ি থেকে তাঁকে নির্মমভাবে উচ্ছেদ করে সে বাড়ি দখল করে নেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। সেখানে তিনি শিশুবাগ নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে এখনো সে বাড়িটি দখল করে রেখেছেন। ১৯৩৩ সালে রাঁচী জেলে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় দেশপ্রিয় মারা গেলেও তাঁকে দেশের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাঁর বাড়ি ১৯৬৫ সালের আইনে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়।'
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, স্থাপত্যশৈলীর কারুকাজ করা দোতলা বাড়ির ফটকে 'শিশুবাগ' লেখা সাইনবোর্ড টাঙানো আছে। এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নাম আছে সামসুদ্দীন মোহাম্মদ ইসহাকের।
সিলেটের চৌহাট্টার 'সিংহবাড়ী' দেশবাসীর কাছে রবীন্দ্র ও নজরুল স্মৃতিধন্য হিসেবে পরিচিত হলেও সে বাড়ি বর্তমানে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত। সিংহবাড়ীর অন্যতম উত্তরসূরি সুজেয় সিংহ মজুমদার জানান, তাঁর দাদু গোবিন্দ সিংহ মজুমদারের আমন্ত্রণে কবিগুরু ও বিদ্রোহী কবি সিলেটে এসে সিংহবাড়ীতে অবস্থান করেন। সে বাড়ি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত। তিনি জানান, ৯৫.৬০ শতাংশ জমির ওপর সিংহবাড়ী গড়ে উঠেছে। এ সম্পত্তির ওয়ারিশসূত্রে মালিক উপেন্দ্র নারায়ণ সিংহ মজুমদার, সুধীরেন্দ্র নারায়ণ সিংহ মজুমদার, শুভব্রত সিংহ মজুমদার ও সত্যব্রত সিংহ মজুমদার। তাঁদের মধ্যে সুধীরেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার ও শুভব্রত সিংহ মজুমদার ভারতে চলে গেলে তাদের জমি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। উপেন্দ্র নারায়ণ সিংহ মজুমদারের চার ছেলে সঞ্জয় সিংহ মজুমদার, সুজেয় সিংহ মজুমদার, জ্যোতির্ময় সিংহ মজুমদার ও সুধাময় সিংহ মজুমদার নিজবাড়িতে থেকে রেকর্ড ও খারিজ করে বসবাস করছেন। কিন্তু অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন ২০০১-এর তালিকায় পুরো জমিই রয়েছে। এমনকি বাংলাদেশ জরিপে (বিএস) সিংহবাড়ীর ৯৫.৬০ শতাংশ জমিই শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তি হিসেবে রেকর্ড করা হয়। ফলে তাঁরা বাড়ির খাজনা দিতে পারছেন না। ৩০ ধারায় রেকর্ড সংশোধনী মামলা করা হলেও সেটলমেন্ট কোর্ট তা আমলে আনছেন না। ২০০৩ সালে এ সিংহবাড়ী সিলেটের মাকসুদ বখতের কাছে লিজ দেওয়া হলে তা নিয়ে সিলেটে ব্যাপক আন্দোলন হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন সে লিজ বাতিল করতে বাধ্য হয়।
শেরপুরে বিপ্লবী রবি নিয়োগীর দুই একর ৩২ শতাংশ জমি ১৯৬৫ সালে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। রবি নিয়োগীর ছেলে রঞ্জিত নিয়োগী ১৯৭৭ সালে আদালতে মামলা করলে ১৯৭৭ সালে রায়ে ওই সম্পত্তি রবি নিয়োগীর হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু আদালতের রায়ের পরও ১৯৮২ সালে নারায়ণপুর মৌজার বিএস ২৪৬৩, ২৪৬৫ ও ২৪৭৭ নম্বর দাগের সে জমি ফের শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। ১৯৯৩ সালে মামলা করা হলে আদালত ওই জমি শত্রু সম্পত্তির তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার আদেশ দেন। কিন্তু বিএস (বাংলাদেশ সার্ভে) জরিপে দুই একর ৩২ শতাংশ জমির পরিবর্তে দুই একর ৭৫ শতাংশ জমি শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। এ ব্যাপারে রবি নিয়োগীর ছেলে রঞ্জিত নিয়োগী বলেন, 'জমি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত করে আমাদের বারবার রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে ঘোষণা করা হচ্ছে। অথচ আমার বাবা দেশের জন্য ৩৪ বছর জেলে কাটিয়েছেন। তিনি কখনো দেশ ছেড়ে যাননি। জন্মস্থান শেরপুরেই তিনি ২০০২ সালের ১০ মে মৃত্যুবরণ করেন।'
কবি নবীন চন্দ্র সেন লেখনীর মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ রোপণ করেছিলেন। ১৮৭৫ সালে তিনি 'পলাশীর যুদ্ধ' নামে মহাকাব্য লিখে ব্রিটিশদের রোষানলে পড়েছিলেন। অথচ তিনি তখন ব্রিটিশ শাসকদের অধীনে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি করতেন। ওই মহাকাব্য লেখার জন্য তিনি তৎকালীন প্রশাসনের নজরবন্দি ছিলেন। মৃত্যুর ৭৩ বছর পর ১৯৮২ সালের দিকে চট্টগ্রাম শহরের জামাল খান রোডে (চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে) তাঁর বাড়ি শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। এক সময় তাঁর বাড়িটি জামায়াতে ইসলামীর কিছু নেতা দখল করে নিয়েছিলেন। বর্তমানে সেই বাড়ির প্রায় এক বিঘা জমি বিভিন্ন জন দখল করে আছে বলে স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কবি নবীন চন্দ্র সেনের জ্ঞাতী ভাগ্নে বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. অনুপম সেন বলেন, 'নবীন চন্দ্র সেনের মতো এত বড় কবির বাড়ি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কী হতে পারে? রাষ্ট্রের উচিত অচিরেই এ গ্লানি থেকে কবিকে মুক্ত করা।'
বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতি বসুর বারদী মৌজার ৬৮৩ নম্বর সিএস দাগের ৫৩ শতাংশ জমি (বাড়ি) শত্রু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কাদির নামে এক ব্যক্তি বাড়িটি দখল করে বসবাস করছেন। তবে জ্যোতি বসুর নানা শরৎ চন্দ্র দাসের কাছ থেকে পাওয়া একই মৌজার ৯০৬ নম্বর দাগের ৬১ শতাংশ জমি এখনো জ্যোতি বসু ও তাঁর বড় ভাই সৌরিন্দ্র কিরণ বসুর নামে রেকর্ডভুক্ত আছে।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার জমিও শত্রু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত আছে। গোবিন্দ চন্দ্র দেবের জমি সিলেটের বিয়ানীবাজারের লাউতায় এবং জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার বাড়ি বরিশালের বানারীপাড়ায়। দুটি বাড়িই বর্তমানে অবৈধভাবে দখলে আছে।
সুত্রঃ কালের কণ্ঠ
No comments:
Post a Comment