তক্ষশীলা প্রাচীন গান্ধারা(বর্তমানে পাকিস্তানের রাওল পিণ্ডি) রাজ্যের রাজধানী, এক বিলুপ্ত শিক্ষালয়ের নাম, এক সফল বানিজ্য কেন্দ্র, উন্নত কারুশিল্প ও সংষ্কৃতি বিকাশের তীর্থস্থান, বৌদ্ধ, হিন্দু, জৈণ যুগের শিক্ষা সভ্যতার মূল্যবান পুরাতত্ত্বের অনন্য এক প্রাচীন সভ্যতার মহিমামন্ডিত নিদর্শনের স্মারক।শিক্ষা স্ফুরনের এই বিদ্যাপীঠটি পাকিস্তানের ইসলামাবাদের ৩০-৩২ কিঃমিঃ উত্তর পশ্চিমে রাওয়াল পিন্ডি জেলার পাঞ্জাবে অবস্থিত হলেও তা আমাদের অখন্ড ভারতীয় উপ মহাদেশের শিক্ষা, সভ্যতা, ঐতিহ্য, জ্ঞান গরিমা বিকাশের উত্তরাধিকারী গৌরব জনক অতীত ও হতাশার সংমিশ্রণের যৌথ ইতিহাস। হতাশা জনক এই কারনে বলছি খৃষ্ট পূর্ব কয়েক’শ বছর আগে যেখানে বর্তমান সভ্য ও উন্নত দেশ বলে পরিচিত অনেক দেশে অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অজ্ঞান ও কুসংষ্কারের ঘোর অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছিল তারো বহু আগে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা অমূল্য শিক্ষা মশালটি আমাদের হাতে তুলে দিয়ে স্থিতিশীল করতে চেয়েছেন তাদের রাজ্য শাসন আর আমাদের ভবিষ্যত গড়তে চয়েছিলেন আলোক উজ্জ্বল, গড়তে চেয়েছিলেন একটি নিরাপদ শিক্ষিত সৌম্য শান্ত জন গোষ্ঠির দেশ। কিন্তু তাকে সঠিক পথে এগিয়ে নেয়া, পরিচর্যা, রক্ষনা বেক্ষনের অভাব, ধর্মীয় বিদ্বেষ, বারবার দখলদার বহিঃশক্তির নৃশংস আক্রমন ও অবহেলার কারনে আমরা আজ অনেক পিছিয়ে পড়া জাতি। যে দেশটি শিক্ষা, সভ্যতা, কৃষ্টি, সংষ্কৃতি ও সম্পদে ছিল ঈর্ষার পাত্র আজ সেই দেশ বহিঃবিশ্বের কাছে উন্নিত হয়েছে হত দরিদ্র তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসাবে করুনার পাত্রে।
এই বিশ্ব বিদ্যালয়টি র সূচনা কবে হয়েছিল তার সঠিক দিন ক্ষন জানার আজ আর কোন উপায় নেই। ইতিহাসবিদরা মোটামুটি একটা হিসাব কষে বলেন খৃষ্টপূর্ব আনুমানিক ৬০০-৭০০ বছর আগে স্থাপিত হয়ে থাকতে পারে। মনে করা হয় শিক্ষা ইতিহাসে তক্ষশীলা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। কিছু কিছু পন্ডিত ব্যক্তি অবশ্য এটাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাপকাঠিতে স্বীকৃতি দিতে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভোগেন। তাদের দাবী তক্ষশীলা শিক্ষালয়টি বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল গঠনগত কাঠামোর সাথে ঠিক মানান সই নয়। বিশ্ব বিদ্যালয় বলতে সাধারনত আমাদের চোখে ভেসে উঠে কোন একটি একক উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেটা পরিচালিত হয় কোন সুনির্দিষ্ট নীতি মালা দিয়ে। কিন্তু তক্ষশীলার ক্ষেত্রে তা নয় এখানে প্রত্যেক শিক্ষক ছিলেন নিজের খেয়াল খুশি মতে কাজ করতে স্বাধীন। খন্ড খন্ড বিভাগের দায়িত্বে থেকে তাঁর নিজস্ব বিভাগের শিক্ষা কার্যক্রম, পাঠ্যসূচী নিজের ইচ্ছামত পরিচালনা করতেন। কোন বিষয়ে কত জন ছাত্র ভর্তি করা হবে তা সম্পূর্ণ নির্ভর করত ঐ বিষয়ের শিক্ষকের একক সিদ্ধান্তের উপর। কোন শিক্ষকের ছাত্র সংখ্যা অতিরিক্ত হয়ে গেলে পুরানো মেধাবী কোন ছাত্রকে দিয়ে নবীন ছাত্রদের শিক্ষা দানের প্রাথমিক দায়িত্ব দিতেন। তাছাড়া গঠনগত ও পরিচালনা দিক থেকে তক্ষশীলা ছিল নালন্দার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচে গড়া। এতসব বৈচিত্রের কারনে তক্ষশীলাকে বিশ্ব বিদ্যালয় রূপে বিবেচনা করা যায় কিনা তা নিয়ে বিজ্ঞ মহলে যুক্তি পাল্টা যুক্তির তীর নিক্ষেপ চললেও তক্ষশীলা যে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল সে বিষয়ে সকলে ছিলেন এক মত।
তক্ষশীলা মূলত ছিল একটি প্রাচীন নগরী যা বিখ্যাত হয়ে উঠে উচ্চ শিক্ষা প্রচার প্রসারে জন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারনে।প্রাক্ বুদ্ধের সময় কাল থেকে তক্ষশীলা বিদ্যা শিক্ষায় প্রসিদ্ধ ছিল।বৌদ্ধ জাতক গুলোতে তক্ষশীলার নাম এসেছে অনেকবার।
তক্ষশীলার নাম করন করা হয়েছে রাজা তক্ষের নাম অনুসারে। ধারনা করা হয় কোন এক সময় তক্ষশীলা ও উজবেক স্থানের রাজধানী তাজখন্দ তাঁর শাসনাধীন ছিল। আবার রামায়ন মতে রামের ভাই ভরতের ১ম ছেলের নাম তক্ষ অনুসারে এই এলাকার নাম হয়েছে তক্ষশীলা। এখানেই শেষ নয় আরো দাবি করা হয় উজবেক স্থানের রাজধানী তাসখন্দও নাম করন হয়েছে ভরত পুত্র তক্ষানুসারে। পাকিস্তানের সোয়াত নদীর কোল ঘেসে খাইবার পাক্তুনখোয়া এলাকায় প্রাচীন পাহাড়ি নগর ছিল পুস্কলাবতী। এই পুষ্কলাবতী নাম পরে পরিবর্তিত হয়ে নতুন নাম পায় পেশোয়ার। দাবি মতে ভরতের ২য় পুত্রের পুষ্কলের নাম অনুকরনে এলাকাটির নাম হয় পুষ্কলাবতী। তক্ষ নাম করনের ব্যখ্যা মোটামুটি এই, আর শীলা নামটি এসেছে পাথর খন্ড থেকে। তক্ষশীলার চারপাশে বহুদূর ব্যাপি বিস্তৃর্ন এলাকা জুড়ে ছোট বড় বিভিন্ন আকারের প্রচুর পাথরের উপস্থিতি বিদ্যমান। এমন কি বড় বড় পাথরের পাহাড় ও দেখা যায় অনেক।এই বিশ্ববিদ্যালয়টি কে স্থাপন করেছেন আমার সীমিত জ্ঞানে অনেক খোজাখুজি করেও তা সন্ধান করতে পারিনি।এই বিষয়ে কোন বিদগ্ধ পাঠকের কোন প্রকার তথ্য থাকলে তা জানালে খুব উপকৃত হব। সম্ভবত প্রথম দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে গড়ে না উঠে ধীরে ধীরে প্রসারিত হওয়ায় এই প্রতিষ্ঠানটির স্থপতির নাম অদৃশ্যমান হয়ে আছে আজো। তৎকালীন সমাজের ধনী বিদ্যাউৎসাহী ব্যক্তিদের সহযোগীতা আর বিশেষ করে মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্র গুপ্তের নাতি সম্রাট অশোক ও কুশান বংশের রাজাদের পৃষ্ঠ পোশকতায় তক্ষশীলার প্রভূত অগ্রগতি সাধিত হয়। সাথে ছোঁয়া লাগে প্রাচীন গ্রীক শিল্প সভ্যতা বিচ্ছুরনের সোনালী আভা। এসময় দ্রুত গড়ে ওঠে বিভিন্ন মঠ, বিহার, মন্দির ও শিক্ষার প্রচার প্রসার।
কোন কোন ঐতিহাসিকদের মতে চন্দ্র গুপ্ত তক্ষশীলায় লেখাপড়া করেন এই তথ্য সঠিক হলে তক্ষশীলাকে মৌর্য বংশের ভিত্তিভূমি বলা হলেও মিথ্যা বলা হয় না কেননা প্রাচীন ভারতের অর্থশাস্ত্রের জনক কৌটিল্যের (চানাক্য) সাথে লেখাপড়ার সূত্র ধরে সম্পর্ক জোরদার হয় প্রখর বুদ্ধি দীপ্ত দূরন্ত উচ্চবিলাসি বালক চন্দ্রগুপ্তের। যা মৌর্য বংশের রাজ্য প্রতিষ্ঠায় বিশাল ভূমিকা রাখে পরবর্তিতে কিংবা বলা চলে ঐতিহাসিক মৌর্য বংশ প্রতিষ্ঠার যোগাযোগ লগ্ন। মৌর্য বংশের ধারাবাহিকতায় আনুমানিক ৩০৪ খ্রীষ্টপূর্বে জন্ম হয় ভারত উপ মহাদেশের অনন্য বিচক্ষন জনদরদি, প্রজাসেবি ও বিদ্যানুরাগী পরাক্রমশালী সম্রাট অশোকের।
ব্যবেলিয়ন, গ্রীস, সিরিয়া, পারস্য, আরব, চীন সহ পৃথীবির বিভিন্ন দেশ থেকে বিদ্যা লোভী ছাত্ররা এখানে এসে ভীড় করত প্রতিকূল যোগাযোগ ব্যবস্থা, এবড়ো থেবড়ো অমসৃন পথের দুঃসহ যন্ত্রনা ও যাত্রা পথে মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে উচ্চ শিক্ষার হিরন্ময় সাফল্য লাভের আসায়।
তক্ষশীলায় যাওয়া আসার তিনটি প্রধান পথ খোলা ছিল সেসময়-
উত্তরা পথঃ ভারত বর্ষের তৎলালীন মগধের রাজধানী পাটালিপুত্র হয়ে গান্ধারা রাজ্যে প্রবেশ করেছিল।উত্তর-পশ্চিমা পথঃ বেকট্রিয়া, কেপিসা হয়ে পুষ্কালাভাটি। অর্থাৎ এই পথটি বর্তমানে গ্রীক, ইরান, চীন উজবেকস্থান, আফগানিস্থান হয়ে পেশোয়ারে প্রবেশ করেছিল।সিন্ধু পথঃ কাশ্মির, শ্রীনগর, পাকিস্তানের খাইবার পাক্তুনখোয়া, হরিপুর উপত্যকা, চীন হয়ে মধ্য এশিয়ার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করত।
তক্ষশিলায় প্রাপ্ত মূর্তি।
এই সব যাত্রা পথের বিপদ, ক্লান্তি ও দুঃস্বপ্নকে জয় করে তক্ষশীলায় দেশী বিদেশী ছাত্র সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১০,৫০০ ছাত্রদের লেখা-পড়া, থাকা-খাওয়া বাবদ প্রচুর পয়সা গুনতে হত তক্ষশীলায়। বয়স কম পক্ষে ১৬ বা তার চেয়ে বেশী বয়সের শিক্ষার্থীদের এখানে ভর্তির সুযোগ দেয়া হত। তবে শর্ত ছিল তাদের অবশ্যই নিজ নিজ এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষার অধ্যায়টি শেষ করে এসে তক্ষশীলায় পড়ার উপযুক্ততা প্রমান দিতে হবে। নগদ পয়সা ছাড়াও সোনা দানা জমা দিয়েও পড়ার ব্যবস্থা ছিল। পড়াশুনার খরচ বাবদ ধনী ছাত্রদের কাছ থেকে অগ্রিম ১০০০ মুদ্রা বা কম বেশী অর্থ জমা নেওয়া হত। মেধাবী অথচ হত দরিদ্রদের বিশেষ ছাড় দেয়ার ব্যবস্থা ছিল। নিয়ম এত কঠোর ছিল রাজার ছেলে হয়েও যোগ্যতা প্রমানে ব্যর্থ হলে তক্ষশীলায় পড়ার কোন প্রকার সুযোগ দেয়া হত না। ছাত্রদের যোগ্যতা অনুযায়ী তাদের পছন্দসই বিষয় পড়ার সুযোগ থাকত। ভেদাস, ভাষা, ব্যাকরন, দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র, ধনু বিদ্যা, রাজনীতি, যুদ্ধ বিদ্যা, জ্যোতিঃশাস্ত্র, হিসাব বিজ্ঞান, গনিত, অর্থনীতি, গান, নাচ, হস্তশিল্প, ইত্যাদি বিষয় সহ এখানে কোর্সের সংখ্যা ছিল ৬০ ঊর্ধ। কোর্স চলাকালীন সময় শিক্ষক যদি মনে করেন তাঁর কোন ছাত্র ঐ নির্দিষ্ট বিষয়ে পড়ার উপযুক্ত নয় বা কোন কারনে উপযুক্ততা হারিয়েছে সেক্ষেত্রে শিক্ষক চাইলে তাকে খেদিয়ে বিদায় করার ক্ষমতা রাখতেন। প্রায় প্রত্যেকটা পাঠ্য বিষয়ের মেয়াদ ছিল ৮ বছর ব্যাপি। দিনের সাথে সাথে রাতের বেলায়ও শিক্ষক ছাত্রের বিদ্যা দান ও গ্রহনের অপূর্ব কোলাহলে চঞ্চল থাকত এই শিক্ষানিকেতন।
ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত খ্রিষ্টপূর্ব- ২০০-১০০ অব্দের তক্ষশীলার মুদ্রা
আধুনিক কালের এলোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা যুগের সূচনার আগে মানুষের জীবন রক্ষায় একমাত্র ভরসা ছিল গাছ-পালা, কান্ড, ফল-মূলের নির্যাস দিয়ে তৈরী ঔষধ। চিকিৎসা শাস্ত্রে যা ভেষজ বা আয়ুর্বেদ নামে পরিচিত। বর্তমানে অবশ্য তা হারবাল চিকিৎসা নামে সমগ্র পৃথিবী ব্যাপী পরিচিতি পেয়েছে। তক্ষশীলা ছিল ভেষজ ও শৈল্য চিকিৎসা বিদ্যার প্রাণ কেন্দ্র। এখানে বিভিন্ন রোগের কারন ও প্রতিকার নিয়ে চলত দিন রাত গবেষনা। রোগ যন্ত্রনা নিয়ন্ত্রন ও মানুষেয় দীর্ঘ আয়ু লাভের প্রচেষ্টায় বছরে বছরে উৎপাদন করা হত প্রচুর চিকিৎসক। তাদের অনেকে নিজ সৃষ্টি কর্মের যোগ্যতা, প্রতিভা ও নিরলস প্রচেষ্টায় স্থান দখল করে উজ্জ্বল হয়ে আছেন প্রাচীন ভারতের চিকিৎসা ইতিহাসের পাতা জুড়ে।
সাফল্যের সাথে কোর্স শেষে কোন প্রকার সনদ প্রদানের ব্যবস্থা সে আমলে গড়ে না উঠলেও শিক্ষা শেষে ছাত্ররা নিজ নিজ দেশে ফিরে আসলে মর্যাদা পেত বরেণ্য পন্ডিত ব্যক্তি রূপে। কোন ছাত্র তার শিক্ষা খরচ পরিশোধে ব্যর্থ হলে তাকে গুরু গৃহের কৃষিকাজ, পানি আনা, আগুনের জন্য শুকনো কাঠ জোগাড় করা সহ বিভিন্ন গৃহস্থালি কাজ করে তা শোধ করার রেওয়াজ ছিল তক্ষশীলায়।
সেই সময় সম্ভবত নারীদের উচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোন অবকাঠামো তৎলালীন সমাজে গড়ে উঠেনি। তক্ষশীলায় নারী শিক্ষার কোন প্রমান এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায় নি।
প্রাচীন বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রলেপ মেখে নীরবে বসে থাকেনি তক্ষশীলা, রত্ন গর্ভার মত একের পর এক জন্ম দিয়ে গেছে ভারত বর্ষের পথ চলার ইতিহাসে জ্বল জ্বল করে দ্যুতি ছড়ানো অনেক ঐতিহাসিক নক্ষত্রের। তার মধ্যে-
চাণক্যঃ
তক্ষশীলা ও চাণক্য যেন ছাপানো মুদ্রার এপিট ওপিট। তক্ষশীলা নিয়ে কোন কথা উঠলেই যেমন চাণক্যর নাম আসে অবধারিত ভাবে তেমনি চাণক্যর জীবনী তক্ষশীলাকে বাদ দিয়ে আলোচনা করলে তা হবে অসম্পূর্ন। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, প্রখর মেধা, বাস্তববাদী ও অসাধারন পান্ডিত্যের অধিকারী এই মহা পুরুষ টির শিক্ষা-দীক্ষা ও কর্ম জীবনের প্রথম অধ্যায়টি কাটে তক্ষশীলায়।তিনি তক্ষশীলার রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগে আচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন অনেক দিন।
ব্রাহ্মন পরিবারে জন্ম নেয়া মহাপুরুষটির পিতা মাতার দেয়া নাম ছিল “বিষ্ণুপদ”। “কূটিলা গোত্র” থেকে এসেছেন বলে গোত্র নামকে অক্ষয় করতে “কৌটিল্য” ছদ্ম নামে লেখেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “অর্থশাস্ত্র”। নামে “অর্থশাস্ত্র” হলেও মূলত তা ছিল রাজ্য শাসন ও কূটনৈতিক কলা কৌশল বিষয়ক সুপরামর্শ।“অর্থশাস্ত্র”র মোট ভাগ ১৫ টি। গ্রন্থে মোট শ্লোক সংখ্যা ৬০০০ রাষ্ট্র বিজ্ঞান, শত্রু দমন, রাজস্ব, দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন, প্রভৃতি রাষ্ট্র ও জন কল্যান মূলক বিষয় নিয়ে এই ১৫টি ভাগ গঠিত। খ্রীষ্ট পূর্ব ৪র্থ শতাব্দীতে “চানকা” গ্রামে জন্ম নেওয়ায় বিষ্ণুপদ “চানক্য” নামে ব্যাপক পরিচিতি পান। আবার কোন কোন ইতিহাসবিদদের ধারনা পিতার নাম “চানক” অনুসারে তাঁর নাম হয় “চাণক্য”।
মগধ রাজা “ধনানন্দ”র রাজসভা থেকে বিতাড়িত হয়ে “চাণক্য” ও দাসী “মুরা”র গর্ভে জন্ম নেওয়া “ধনানন্দ”র সৎভাই রাজ্য থেকে বিতারিত “চন্দ্রগুপ্ত” দুজনে মিলে অপমানের প্রতিষোধ নিতে গড়ে তোলেন এক বিশাল শক্তিশালী সেনাবাহিনী। যা নন্দ বংশের রাজা “ধনানন্দ”কে শেষ পর্যন্ত পরাজিত করে গোড়াপত্তন করেন ইতিহাসখ্যাত “মৌর্যবংশ”।
পাণিনিঃ
গান্ধারা রাজ্যের “শালাতুর” বর্তমান লাহোরে জন্ম নেয়া পাণিনি তক্ষশীলা বিশ্ব বিদ্যালয়ের আরেক মহান সৃষ্টি। তাঁর জন্ম সন নিয়ে প্রচুর মতানৈক্য আছে ইতিহাসবিদদের মাঝে। তিনি “অষ্টাধ্যায়ী” নামক সংষ্কৃত ব্যাকরণ রচয়িতা হিসাবে বেশ সুপরিচিত। এই গ্রন্থে তিনি সংষ্কৃত রূপমূলতত্ত্বের ৩৯৫৯টি নতুন নিয়ম যোগ করেন। “অষ্টাধ্যায়ী” প্রাচীন সংষ্কৃত ভাষায় রচিত ব্যাকরণগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান গ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃত। পাণিনি তাঁর ব্যাকরণে শব্দের উৎপত্তি, ধ্বনি তত্ত্ব, বর্ণমালা, উচ্চারণ, সন্ধির নিয়ম কানুন বিজ্ঞান সন্মত করে উপস্থাপন করে গেছেন অত্যন্ত সাবলীল ভাবে।
পণি বা পাণিন হল একটি গোত্রের নাম। গোত্রের নামানুসারে তাঁর নাম হয় “পাণিনি” তাঁর পিতার নাম ছিল শলঙ্ক।তাই পণিনির আরেক নাম “শালাঙ্কি”। তাঁর মা ছিলেন দক্ষ জাতির কণ্যা। তাই অনেকে আবার তাঁকে “দাক্ষিপুত্র” নামেও অভিহত করেন।
চরকঃ
২০০ খৃষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করা চরক চিকিৎসা শাস্ত্রে তক্ষশীলার আরেক বিস্ময়কর অবদান। যোগ সাধনা চর্চার জন্য অনেকে আবার তাকে চরক মুনি বা ঋষি হিসাবে ডেকে থাকেন। তাঁর অনেক অনুসারী ছিল। ছিলেন কুষাণ সম্রাট কনিষ্কের ব্যক্তিগত চিকিৎসক। তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন ভেষজ চিকিৎসা শাস্ত্র “চরক সংহিতা” রচনা করে।আয়ুর্বেদ চিকিৎসাকে এই বই এনে দিয়েছে বৈপ্লবিক ছোঁয়া। প্রাচীন ভারতের চিকিৎসা শাস্ত্রের ইতিহাসে প্রথম প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসাবে বিবেচিত হয় এই “চরক সংহিতা”এই গ্রন্থে তিনি ৫০০ ঔষধের বর্ননা লিপি বদ্ধ করেছেন।
চরক-সংহিতায় মতে “তাকেই বলে ভেষজ যাতে হয় আরোগ্য”।
চরক ও সুশ্রম্নত সংহিতায় উল্লেখ আছে কাঁচা আমলকির রসের সাথে ২/১ কোয়া রসুন বাটা খেলে যৌবন দীর্ঘস্থায়ী হয়। অতএব আর দেরি নয়, কোন রকম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ঘটার সম্ভাবনাও একেবারে শুন্যের কোঠায়। দীর্ঘ যৌবন প্রত্যাশীরা যৌবন ধরে রাখতে শেষ চেষ্টা চালিয়ে দেখতে পারেন একবার।
জীবকঃ
তক্ষশীলার শৈল্য চিকিৎসা বিদ্যায় জীবক ছিলেন আরেক অনন্য সৃষ্টি। ইতিহাসবিদদের মতে তার জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৬ থেকে ৪৮৬ অব্দের কোন এক সময়ে। তিনি প্রায় ৭ বছর তক্ষশীলায় চিকিৎশাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন। তিনি ছিলেন মগধ রাজ্যের অধিপতি রাজা বিম্বিসার ও বুদ্ধের ব্যক্তিগত চিকিৎসক। জীবক ছিলেন বুদ্ধের সমসাময়িক এবং প্রাচীন ভারতের চিকিৎসাশাস্ত্রের আরেক নক্ষত্র আত্রেয়-এর সেরা শিষ্য। তিনি শরীর ও শল্য উভয় বিদ্যায় সমানে দক্ষতা অর্জন করেন। রোগীর নাড়ী পড়ার অপূর্ব ক্ষমতা রাখতেন তিনি। ছিলেন শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ। জটিল অপারেশনেও তাঁর ক্ষমতা ছিল বলে শোনা যায়। রোগ নির্ণয় এবং তার প্রতিষেধক নিয়ে জীবক লিখিছিলেন অসংখ্য গ্রন্থ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কাশ্যপ-সংহিতা।
ছাত্রবস্থায় চিকিৎসা শাস্ত্রে তাঁর প্রজ্ঞা নিয়ে একটি গল্প চালু আছে তা হলো- তক্ষশীলার জনৈক শিক্ষক তার ছাত্রদের একটি বাগানে নিয়ে বলেন সেখান থেকে গুন হীন উদ্ভিদ খুঁজে বের করতে। শুরু হল খোজা খুজির প্রতিযোগীতা কিন্তু জীবক বাদে অন্য শিষ্যরা তাদের মতে নির্গুণ উদ্ভিদ হাত বোঝাই করে এনে তুলে দেন গুরুর হাতে। কিন্তু জীবক অনেক খোজা খুজি করে ক্লান্ত হয়ে ফিরে এলেন ভগ্ন হৃদয়ে শুন্য হাতে। ফিরে এসে তাঁর শিক্ষককে জানালেন তিনি এমন কোনো উদ্ভিদ খুঁজে পাননি যার ভেতরে কোন না কোন গুণ নেই। শিক্ষক যারপরনাই খুশি হয়ে বলল্লেন একমাত্র জীবকের শিক্ষাই সম্পূর্ণ হয়েছে।
এছাড়াও রাজা প্রসেনজিত, সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত, মোহালির মত আরো অসংখ্য ইতিহাসিক ব্যক্তিত্ব রাত-দিন নীরব নিভৃতে সুনিপুন ভাবে তৈরী করে গেছে এই মহান প্রতিষ্ঠানটি।
চাণক্য, আত্রেয়, বিষ্ণু শর্মা, নাগার্জুনের মত ইতিহাস খ্যাত প্রথিযশা জ্ঞান তাপস পন্ডিত ব্যক্তিদের শিক্ষক রূপে পেয়ে তক্ষশীলার সুখ্যাতি পৌঁছে গিয়েছিল অনতিক্রম্য উচ্চতায়, দ্রুত নজর কেড়েছিল বিশ্ব দরবারে। তক্ষশীলার খ্যাতির পরশ গ্রিক সেনাপতি আলেকজেন্ডারকে এতটাই তন্ময় করেছিল তিনি তক্ষশীলা দখল করার পর সাথে করে কিছু শিক্ষক বগল দাবা করে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রাচীন শিল্প সভ্যতায় উন্নত গ্রীক সভ্যতাকে আরো গতিশীল করার মানসে।
ছাত্রদের সুশিক্ষা, পন্ডিত শিক্ষকদের সৎ,মানবিক, সুস্থ চিন্তা চেতনার বহিঃপ্রকাশ শুধু বাক সর্বস্ব ছিল না, তার প্রয়োগিক চর্চা করতেন তাদের ব্যবহারিক জীবনে। আমারা তার ঐতিহাসিক প্রমান পাই আলেকজেন্ডারের আগ্রাসী আক্রমনে যখন গৃহ, সহায়-সম্বল, ভিটা-মাটি অর্থ-বিত্ত সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে হাজার হাজার মানুষ জীবন বাঁচতে তক্ষশীলার কোলে আশ্রয় নেয়। এই অনাকাঙ্খিত উদ্ভুত পরিস্থিতিতে কি করা উচিত তা নিয়ে তক্ষশীলার রাজা এক পরামর্শ সভার আয়োজন করে। সে সভায় তক্ষশীলার শিক্ষক মন্ডলি এই সব উদ্বাস্তু লোকদের তক্ষশীলায় ভূমি দানে তাঁদের পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন।
হাজার বছর ধরে ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষা, শিল্প, সভ্যতাকে প্রগতির পক্ষে পরিচালিত করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে উৎপত্তি বিলয়ের জাগতিক ব্যতয়হীন নিয়ম রক্ষার্থে বোধহয় তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে গেছে সাম্রাজ্যবাদী পারস্য, গ্রীক, রোমান, শক, কুষান, আক্রমণ। এই সব আক্রমনে সৃষ্ট অস্থির রাজনৈতিক ঘোর অন্ধকার পরিমন্ডলে আগুয়ান অনিশ্চিত ভবিষ্যতের নিরাপত্তাহীনতার দুশ্চিন্তায় ক্রমে ক্রমে হ্রাস পেতে শুরু করে শিক্ষক ও ছাত্র সংখ্যা। ৪৫০ খ্রীষ্টাব্দে সর্ব শেষ আক্রমণটি আসে হুন দের পক্ষ থেকে। এভাবে বার বার সাম্রাজ্যবাদীর হিংস্র থাবার কবলে পড়ে ধীরে ধীরে মৃত্যু গ্রাস করে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ব বিদ্যালয়টিকে। স্তব্দ হয় তার পথ চলা। শোকের মাতমে যেন অব্যবহৃত ইট সুড়কির দালান কোঠা গুলোতে ধুলোর আস্তর ঢেলে স্মৃতি সমাধি তৈরী করে প্রকৃতি নিজের হাতেই।
যৌবনের সব গৌরব হারিয়ে ভগ্ন জীর্ণ শীর্ণ তক্ষশীলা ১৯৮০ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক world heritage site হিসাবে স্বীকৃতি পায়।
No comments:
Post a Comment