সুশান্ত বন্দ
এক।
ভাগবতের আলোকে কোয়ান্টাম থিওরী (Quantum Theory) -
ভাগবতে মহাবিশ্বের যে পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা প্রদান করিয়াছে কোয়ান্টাম তত্ত্ব সেটার অংশ বিশেষ । ভাগবতের আলোকে কোয়ান্টাম তত্ত্ব এখানে আলোচনা করা হল । পরমাণুর সংজ্ঞা -
চরমঃ সদ্বিশেষাণামনেকোহসংযুতঃ সদা ।
পরমাণুঃ স বিজ্ঞেয়ো নৃণামৈক্যভ্রমো যতঃ ।। (ভাগবত ৩/১১/১)
অনুবাদ - জড় জগতের যে ক্ষুদ্রতম অংশ অবিভাজ্য এবং দেহরূপে যাহার গঠন হয় না, তাহাকে বলা হয় পরমাণু । তাহা সর্বদা তাহার অদৃশ্য অস্তিত্ব নিয়ে বিদ্যমান থাকে, এমনকি প্রলয়ের পরেও । জড় দেহ এই প্রকার পরমাণুর সমণ্বয়, কিন্তু সাধারন মানুষের সেই সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারনা রয়েছে । এই শ্লোকে পরমাণুর সংজ্ঞা প্রদান করা হইয়াছে । এ বিষয়ে আমরা পরবর্তী পোষ্টে আলোচনা করব ।মহাবিশ্ব পরমাণু দ্বারা গঠিত -
সত এব পদার্থস্য স্বরূপাবস্থিতস্য যৎ ।
কৈবল্যং পরমমহানবিশেষো নিরন্তর ।।(ভাগবত ৩/১১/২)
অনুবাদ - পরমাণু হইতেছে ব্যক্ত জগতের চরম অবস্থা । যখন তাহারা বিভিন্ন প্রকারের শরীর নির্মাণ না করিয়া তাহাদের স্বরূপে স্থিত থাকে, তখন তাহাদের বলা হয় পরম মহৎ ।ভৌতিক রূপে নিশ্চয়ই অনেক প্রকারের শরীর রহিয়াছে, কিন্তু পরমাণুর দ্বারা সমগ্র জগৎ সৃষ্টি হয় । এই শ্লোকে বর্ণনা করা হইয়াছে, পরমাণু দ্বারা জগত গঠিত যাহা কোয়ান্টাম তত্ত্বে বলা হইয়াছে । ভগবান পরমাণু থেকে বিশাল ব্রহ্মান্ড সব জায়গায় বিরাজিত -
পরমাণুপরমমহতো-সত্বমাদ্যন্তান্তরবর্তী ত্রয়বিধুরঃ ।
আদাবন্তেহপি চ সত্ত্বানাং যদ্ ধ্রুবং তদেবান্তরালেহপি ।।(ভাগবত ৬/১৬/৩৬)
অনুবাদ - এই জগতে পরমাণু থেকে শুরু করিয়া বিশাল ব্রহ্মান্ড এবং মহত্তত্ত্ব পর্যন্ত সব কিছুরই আদি, মধ্য এবং অন্তে আপনি বর্তমান রহিয়াছেন । অথচ আপনি আদি, মধ্য এবং অন্ত রহিত সনাতন । এই তিনটি অবস্থাতেই আপনার অবস্থা উপলব্ধি করা যায় বলিয়া আপনি নিত্য । যখন জগতের অস্তিত্ব থাকে না, তখন আপনি আদি শক্তিরূপে বিদ্যমান থাকেন । এই শ্লোকে বর্ণনা করা হইয়াছে প্রলয়ের সময় পরমাণু ধ্বংস হইয়া শক্তিতে পরিণত হয়, আবার যখন সৃষ্টি শুরু হয় তখন শক্তি থেকে পরমাণু সৃষ্টি হয় । পরবর্তী পোষ্টে আমি আলোচনা করব সৃষ্টির শুরুতে গর্ভোদক নামক শক্তি থেকে সবকিছু সৃষ্টি হয় ।কোয়ান্টাম তত্ত্বে বর্ণনা করা হইয়াছে শক্তি হইতে পরমাণু সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু শক্তি আসল কোথা থেকে ? এই প্রশ্নের উত্তরে বিজ্ঞানীরা বলেছেন এই মহাবিশ্বে সর্বমোট শক্তির পরিমাণ ০ (শূন্য) । এই প্রশ্নের সাথে এই উত্তরের কি সামঞ্জস্য তা আমি উপলব্ধি করতে পারছি না । আমাদের প্রশ্ন শক্তি আসল কোথা থেকে ? তার উত্তরে বলল, মহাবিশ্বের সর্বমোট শক্তির পরিমাণ শূন্য । কিভাবে এই সমস্যার সমাধান হল তা আমি উপলব্ধি করতে পারছি না । শক্তি কোথা হইতে আসিল-
শাস্ত্রে তা এভাবে প্রদান করিয়াছে
একোহপ্যসৌ রচয়িতুং জগদন্ডকোটিং যচ্ছক্তিরস্তি
জগদন্ডচয়া যদন্তঃ
অন্ডান্তরস্থপরমাণুচয়ান্তরস্থং
গোবিন্দমাদি পুরুষং তমহং ভজামি ।। (ব্রহ্ম সংহিতায় ৫/৩৫)
অনুবাদ – আমি পরমেশ্বর ভগবান গোবিন্দের ভজনা করি, যিনি তাঁহার এক অংশের দ্বারা প্রতিটি ব্রহ্মান্ড এবং প্রতিটি পরমাণুতে প্রবিষ্ট হইয়াছেন, এইভাবে তিনি সমগ্র সৃষ্টিতে তাঁহার অনন্ত শক্তির প্রকাশ করিয়াছেন ।
এই শ্লোকে বর্ণনা করা হইয়াছে ভগবানের শক্তি পরমাণুতে প্রবেশ করিবার ফলে সৃষ্টি কার্যক্রম শুরু হয় অর্থাৎ পরমাণু ভগবানের শক্তি থেকে সৃষ্টি হয় । শক্তি আসিল কোথা থেকে তার উত্তর শাস্ত্রে বলা হয়েছে, শক্তি ভগবান থেকে এসেছে । পরে আমি ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি পর্বে আলোচনা করব এই মহাবিশ্ব প্রধান নামক একটি চিন্ময় বা বিপরীত পদার্থ থেকে সৃষ্টি হয়েছে । সুতরাং বলা যায় পরমাণু চিন্ময় বা বিপরীত পদার্থ থেকে সৃষ্টি হয়েছে যা বিজ্ঞানীদের ধারণা । সুতরাং বলা যায় বৈজ্ঞানিকেরা যে অসম্পূর্ণ কণাবাদী তত্ত্ব (Quantum Theory) আবিষ্কার করেছেন ভাগবত সেটাকে আরো পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশ করিয়াছে ।
দুই।
বৈদিক মহাবিশ্ব সৃষ্টি রহস্য (The Vedic Concept of Creation of the whole Universe)
মহাবিশ্ব আসিয়াছে কোথা থেকে এবং যাচ্ছে বা কোথায় ? মহাবিশ্বের কি কোন শুরু ছিল ? যদি থাকিয়া থাকে তবে তাহার আগে কি ঘটেছিল ? কালের চরিত্র কি ? কাল কি কখনও শেষ হবে ? আমি কে ? কোথা হইতে আসিয়াছি ? কোথায় যাব ? আমি এরূপ প্রশ্ন করিতেছি কেন ?
এ সকল মানুষের শাশ্বত প্রশ্ন এর সঠিক উত্তর জানবার জন্য বিজ্ঞানীরা বহুদিন যাবৎ গবেষণা করিতেছে । এসব বিষয় নিয়ে অসংখ্য বিজ্ঞানী গবেষণা করিয়াছেন এবং এখনো করছে । তাহারা ইতিমধ্যে মহাবিশ্ব সৃষ্টি রহস্য বিষয়ে অনেক তত্ত্ব, মতবাদ, হাইপোথিসিস, সূত্র আবিষ্কার করেছেন । বিজ্ঞানীদের অনেক আবিষ্কার আছে পরস্পর বিরোধী একটির সাথে অন্যটির মিল নেই ।
মহাবিশ্ব সৃষ্টি রহস্য বিষয়ে যে সকল মতবাদ বিজ্ঞানীরা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করিতেছে সেইগুলি নিম্নে প্রকাশ করা হইল ।
১। আইনষ্টাইনের ব্যাপক আপেক্ষিক তত্ত্ব (Einstein’s Law of Relativity)
২। বিগব্যাঙ্গ থিওরী (Big Bang Theory)
৩। বিগ ক্রাঞ্চ (Big Crunch Theory)
৪। বুদবুদ তত্ত্ব (Bubbles Theory)
৫। কণাবাদীতত্ত্ব (Quantum Theory)
৬। মানবতত্ত্ব নীতি (Anthropic Principle)
ক) দুর্বল মানবতত্ত্ব নীতি (Weak Anthropic Principle)
খ) সবল মানবতত্ত্ব নীতি (Strong Anthropic Principle)
এই নীতিগুলি সম্বন্ধে ভাগবতে বিস্তারিত আলোচনা করা হইয়াছে । দেখা গিয়াছে বেশিরভাগ নীতির মধ্যে সামঞ্জস্য নাই । আজ বিজ্ঞানী সমাজের সামনে একটি চ্যালেঞ্জ, মহাবিশ্ব সম্বন্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ সম্পূর্ণ তত্ত্ব আবিষ্কার করা এবং আমরা যে বিশ্বে বসবাস করি তাহার একটি সম্পূর্ণ বিবরণ দেওয়া ।
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী স্টিফেন ডব্লূ হকিং তাঁহার A Brief History of Time (কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস) বইটিতে আবেদন করেছেন ভবিষ্যতে হয়ত আমাদের চেয়ে বুদ্ধিমান মানুষের আগমন ঘটবে যারা মহাবিশ্ব সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ বিবরণ প্রদান করতে পারবে । আমার মতে ভাগবত (বৈদিক শাস্ত্র) মানুষের সেই আদিম ইচ্ছাকে পূরণ করিতে পারবে । ভাগবতে বিশ্বব্রহ্মান্ড বা মহাবিশ্বের গঠন সম্বন্ধে অত্যন্ত পূর্ণাঙ্গ ও গঠনমূলক বর্ণনা করেছে যদি সেইসব বর্ণনা পূর্ণাঙ্গভাবে উল্লেখ করা হয় তা হলে একটি বৃহৎ গ্রন্থে রূপ নিবে সেইজন্য অত্যন্ত সংক্ষেপে কিছু উল্লেখ করা হল যারা বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টি রহস্য পূ্ণাঙ্গভাবে জানতে চান তাদেরকে ভাগবত পড়িতে হবে ।
ভাগবতের আলোকে মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য উপলব্ধি করতে হলে আমাদের কয়েকটি বিষয় সম্বন্ধে ধারণা নিতে হইবে ।
জড় জগত (Material World):
আমরা যে জগতে বাস করি তাকে জড় জগত বলে । এই জগত জড় অর্থাৎ প্রাণহীন, ইহার সৃষ্টি ও ধ্বংস আছে । এই সৃষ্টি ও ধ্বংস কার্যক্রম চক্রাকারে চলিতে থাকে অর্থাৎ প্রথমে সৃষ্টি হয় তারপর কিছুদিন অবস্থান করে, কিছুদিন পর আবার ধ্বংস হয় । সুতরাং জড় জগতের সৃষ্টি, অবস্থান এবং ধ্বংস শাশ্বত নিয়মে নির্দিষ্ট সময় পর পর ঘটিতেছে । এইভাবে বিচার করিলে দেখা যায়, জড় জগতের সৃষ্টি ও ধ্বংস শাশ্বত ইহার কোন শুরু বা শেষ নাই ।
জড় জগত পুণঃপুণঃ সৃষ্টি ও ধ্বংস হয় ----
সর্বভূতানি কৌন্তেয় প্রকৃতং যান্তি মামিকাম্ ।
কল্পক্ষয়ে পুনস্তানি কল্পানি কল্পাদৌ বিসৃজাম্যহম্ ।।
প্রকৃতিং স্বামবষ্টভ্য বিসৃজামি পুনঃ পুনঃ
ভূতগ্রামমিমং কৃৎস্নমবশং প্রকৃতের্বশাৎ ।। (ভাগবত ২/১০/৩)
অনুবাদ
কল্পান্তে সম্পূর্ণ সৃষ্টি, যথা জড় জগত এবং প্রকৃতিতে ক্লেশ প্রাপ্ত জীব আমার দিব্য দেহে লয় প্রাপ্ত হয় এবং নতুন কল্পের আরম্ভে আমার ইচ্ছার প্রভাবে তাহারা পুণরায় প্রকাশিত হয় । এ ভাবে প্রকৃতি আমার নিয়ন্ত্রনে পরিচালিত হয় । আমার ইচ্ছার প্রভাবে তাহা পুণঃপুণঃ প্রকট হয় এবং লয় হয় ।
স এষ আদ্যঃ পুরুষঃ কল্পে কল্পে সৃজত্যজঃ ।
আত্মাত্মন্যাত্মনাত্মানং স সংযচ্ছতি পাতি চ ।। (ভাগবত ২/৬/৩৯)
অনুবাদ
সেই আদিপুরুষ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জন্মরহিত হওয়া সত্ত্বেও প্রথম অবতার মহাবিষ্ণু রূপে নিজেকে বিস্তার করিয়া এই ব্যক্ত জগতের সৃষ্টি করেন । তাঁহার মধ্যেই অবশ্য সৃষ্টি প্রকাশিত হয় এবং জড় পদার্থ ও জড় অভিব্যক্তি সবই তিনি স্বয়ং কিছুকালের জন্য তিনি তাহাদের পালন করেন এবং তারপর তিনি পুণরায় তাহাদের আত্মসাৎ করিয়া নেন ।
উপরের শ্লোক দুইটি থেকে বুঝা যায় জড়জগত পুণঃপুণঃ সৃষ্টি এবং ধ্বংস হচ্ছে । আমরা জড় জগতের একটি ব্রহ্মান্ডের মধ্যে অবস্থিত পৃথিবী নামক গ্রহে বসবাস করিতেছি । এরকম অনন্তকোটি ব্রহ্মান্ড নিয়া বিশ্ব ব্রহ্মান্ড গঠিত । ইহাকে জড়জগত বলে ।
ব্রহ্মান্ডের সংখ্যা --------
ক্ষিত্যাদিভিরেষ কিলাবৃতঃ সপ্তভির্দশগুণোত্তরৈরন্ডকোশঃ ।
যত্র পতত্যণুকল্পঃ সহস্রকোটিকোটিভিস্তদনন্তঃ ।। (ভাগবত ৬/১৬/৩৭)
অনুবাদ
প্রতিটি ব্রহ্মান্ড মাটি, জল, আগুন, বায়ু, আকাশ, মহতত্ত্ব এবং অহংকার এই সাতটি আবরণের দ্বারা আচ্ছাদিত এবং প্রতিটি আবরণ পূর্ববর্তী থেকে দশগুন অধিক । এই ব্রহ্মান্ডটি ছাড়া আরও কোটি কোটি ব্রহ্মান্ড রহিয়াছে এবং সেইগুলি আপনার মধ্যে পরমাণুর মতো পরিভ্রমণ করিতেছে । তাই আপনি অনন্ত নামে প্রসিদ্ধ ।
এই শ্লোকে বর্ণনা করা হইয়াছে ব্রহ্মান্ডের সংখ্যা কোটি কোটি । জড় জগত সম্বন্ধে আধুনিক বিজ্ঞানের ধারণা সঠিক । কারণ বিজ্ঞানে বলা হয়েছে কোটি কোটি গ্রহ নক্ষত্র লইয়া এই মহাবিশ্ব বা বিশ্বব্রহ্মান্ড গঠিত ।
ব্রহ্মান্ড (Universe)
কতগুলি গ্রহ, নক্ষত্র, সূর্য, চন্দ্র নিয়ে একটি ব্রহ্মান্ড গঠিত হয় । যেমন – আমাদের সৌর পরিবারের সাথে আরো কিছু গ্রহ নক্ষত্র যোগ করিলে আমাদের ব্রহ্মান্ড গঠিত হয় । ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে প্রত্যেকটি ব্রহ্মান্ডের একটি নির্দিষ্ট আয়তন এবং আবরণ রয়েছে । প্রতিটি ব্রহ্মান্ডের ব্যাসের গভীরতা আলাদা আলাদা । যেমন –
আমাদের ব্রহ্মান্ডেরর ব্যাস
শ্রীশুক উবাচ
এতাবানেব ভূবলয়স্য সন্নিবেশঃ ।
প্রমাণলক্ষণতো ব্যাখ্যাতঃ ।। (ভাগবত ৫/২১/১)
অনুবাদ
শুকদেব গোস্বামী বলিলেন – হে রাজন, এইভাবে আমি প্রমাণ এবং লক্ষণ প্রদর্শন পূর্বক ব্রহ্মান্ডের পরিমাণ বর্ণনা করিলাম ।
এই শ্লোকে আমাদের ব্রহ্মান্ডের ব্যাসের কথা বর্ণনা করা হয়েছে । পরবর্তী শ্লোকে দেখিব আমাদের ব্রহ্মান্ডের ব্যাস ৫০ কোটি যোজন বা ৪০০ কোটি মাইল । আমাদের ব্রহ্মান্ডকে ৪(চার) গুন ধরিয়া অন্য ব্রহ্মান্ডগুলি বড় হইতে থাকে অর্থাৎ আমাদের পরবর্তী ব্রহ্মান্ডের আয়তন ৫(পাঁচ) গুণ । ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে এইভাবে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি গুণ বড় ব্রহ্মান্ড রয়েছে ।
তিন।
ব্রহ্মান্ডের আবরণ (Layer of Universe)
প্রত্যকটি ব্রহ্মান্ড ৭(সাত) টি আবরনের দ্বারা আবৃত ।
ব্রহ্মান্ডের আবরনের ধরন ও ব্যাস
বিকারৈঃ সহিতো যুক্তৈর্বিশেষাদিভিরাবৃতঃ ।
আন্ডকোশো বহিরয়ং পঞ্চাশৎ কোটিবিস্তৃতঃ ।। (ভাগবত ৩/১১/৪০)
অনুবাদ
আটটি জড় উপাদানের সমন্বয়ে ষোড়শ প্রকার বিকার থেকে প্রকাশিত এই যে ব্রহ্মান্ড, তাহার অভ্যন্তর পঞ্চাশ কোটি যোজন বিস্তৃত এবং নিম্নলিখিত আবরণের দ্বারা আবৃত ।
এইখানে ব্রহ্মান্ডের আবরণের কথা বলা হয়েছে এবং ব্রহ্মান্ডের ব্যাস ৫০(পঞ্চাশ) কোটি যোজন তাহা উল্লেখ করা হয়েছে । এখানে ব্রহ্মান্ডের আবরণের যে উপাদান সেইগুলিকে বিকার গ্রস্ত বলা হয়েছে অর্থাৎ গ্যাসীয় অবস্থায় বিদ্যমান । যেমন – জলের আবরণ ইহা H2 ও O2 গ্যাস দ্বারা গঠিত, ব্রহ্মান্ডের আবরণগুলি বিকার গ্রস্ত হওয়ার জন্য একটি ব্রহ্মান্ড থেকে অন্য ব্রহ্মান্ডে আলোক রশ্মি গমন করতে পারে ।
ব্রহ্মান্ডের আবরণ
দশোত্তরাধিকৈর্যত্র প্রবিষ্টঃ পরমাণুবৎ ।
লক্ষ্যতেহন্তর্গতাশ্চান্যে কোটিশো হ্যন্ডরাশয়ঃ ।। (ভাগবত ৩/১১/৪১)
অনুবাদ
ব্রহ্মান্ডকে আবৃত করে যে সমস্ত তত্ত্ব, তাহা উত্তরোত্তর দশগুন অধিক বিস্তৃত এবং সমস্ত ব্রহ্মান্ডগুলি এক বিশাল সমন্বয়ের পরমাণু মতো প্রতিভাত হয় ।
এই শ্লোকে বর্ণনা করা হইয়াছে ব্রহ্মান্ডের প্রথম আবরন থেকে দ্বিতীয় আবরণ দশ গুন বড়, তৃতীয় আবরণ আবার দ্বিতীয় থেকে দশ গুন বড় এভাবে ক্রমান্বয়ে আবরণগুলির বিস্তৃতি বাড়িতে থাকে ।
শ্লোকের দ্বিতীয় অংশে আরো বর্ণনা করা হয়েছে আবরণগুলি বৃত্তাকারে ব্রহ্মান্ডকে ঘিরিয়া রাখিয়াছে এই জন্য ইহা দেখতে একটি পরমাণুর মত গোল । এখানে ব্রহ্মান্ডের আবরণকে পরমাণুর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে যাহা অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে । একটি পরমাণুতে প্রোটন ও নিউট্রনকে কেন্দ্র করে ইলেকট্রন গুলি এমনভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে যাহাতে কেন্দ্রকে বাহির হইতে দেখ যায় ঠিক সেরকম ব্রহ্মান্ডের ৭(সাত) টি আবরণ থাকা সত্ত্বেও ব্রহ্মান্ডকে বাহির হইতে দেখ যায় এবং ব্রহ্মান্ড থেকে আলোক নির্গত হইতে পারে । প্রত্যেকটি ব্রহ্মান্ড গোলাকার বল বা পরমাণু মত সেই বিষয়টিও এখানে উল্লেখ করা হয়েছে । প্রতিটি ব্রহ্মান্ডের ভিতরে নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা রয়েছে যাহা গোলাকার ।
প্রতিটি ব্রহ্মান্ড ৭(সাত) টি আবরণ দ্বারা আবৃত সেই আবরণগুলি বিভিন্ন পদার্থ দ্বারা গঠিত ।
ব্রহ্মান্ডের আবরণের বিস্তৃতি
এতদন্ডং বিশেষাখ্যং ক্রমবৃদ্ধৈর্দশোত্তরৈঃ ।
তোয়াদিভিঃ পরিবৃতং প্রধানেনাবৃতৈর্বহিঃ ।
যত্র্রলোকবিতানোহয়ং রূপং ভগবতো হরেঃ ।। (ভাগবত ৩/২৬/৫২)
অনুবাদ
এই ব্রহ্মান্ডকে বলা হয় জড়া প্রকৃতির প্রকাশ । তাহাতে জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ, অহংকার এবং মহত্তত্ত্বের যে আবরণ রহিয়াছে, তাহা ক্রমান্বয়ে পূর্বটির থেকে পরবর্তী আবরণটি দশ গুণ অধিক এবং তাহার শেষ আবরনটি হইতেছে প্রধানের আবরণ । এই ব্রহ্মান্ডে ভগবানের বিরাটরূপ বিরাজ করিতেছে, যাহার দেহের একটি অংশ হচ্ছে চতুর্দশ ভুবন ।
এই শ্লোকে ব্রহ্মান্ডের ৭(সাত) টি আবরণের পদার্থের নাম উল্লেখ করা হয়েছে । প্রতিটি আবরণ পূবটির থেকে ১০ গুণ চওড়া । যেমন ব্রহ্মান্ডের প্রথম আবরণটি জলের তৈরী এখানে জল মানে জলের বিকার অবস্থা যা আগের শ্লোকে দেখানো হয়েছে অর্থাৎ জলের বায়বীয় অবস্থায় অবস্থান করে । ব্রহ্মান্ডের ব্যাস ৫০ কোটি যোজন অর্থাৎ জলের আবরণ ৫০ × ১০ = ৫০০ কোটি যোজন পুরু । এইভাবে পরবর্তী আবরণগুলি বৃদ্ধি পেতে থাকে ।
যদি ব্রহ্মান্ডের ব্যাস X ধরা হয় তা হলে ব্রহ্মান্ডের আবরণকে নিম্নলিখিত ভাবে প্রকাশ করা যায় ।
ব্রহ্মান্ডের আবরণগুলির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা
১ম আবরণ ১০ × X = ১০X বিস্তৃতি/চওড়া জল(বিকার অবস্থা)দিয়ে তৈরী
২য় আবরণ ১০X × ১০ = ১০০X বিস্তৃতি/চওড়া আগুন দিয়ে তৈরী
৩য় আবরণ ১০০X × ১০ = ১০০০X বিস্তৃতি/চওড়া বায়ু দিয়ে তৈরী
৪র্থ আবরণ ১০০০X × ১০ = ১০০০০X বিস্তৃতি/চওড়া আকাশ(ইথার)
৫ম আবরণ ১০০০০X × ১০ = ১০০০০০X বিস্তৃতি/চওড়া অহংকার(সূক্ষ্ম পদার্থ যা সাধারণভাবে অনুভব করা যায় না কিন্তু ইহা জড় পদার্থ)
৬ষ্ঠ আবরণ ১০০০০০X × ১০ = ১০০০০০০X বিস্তৃতি/চওড়া মহতত্ত্ব(বিশ্বব্রহ্মান্ড তৈরীর প্রাথমিক পদার্থ যা দ্বারা ব্রহ্মান্ড তৈরী হয়)
৭ম আবরণ ১০০০০০০X × ১০ = ১০০০০০০০০X বিস্তৃতি/চওড়া প্রধান(সূক্ষ্ম অব্যক্ত বস্তু, যা অনুভব করা যায় না, ইহাকে সাধারণভাবে শূন্যস্থান বলা যাইতে পারে)
মোট – ১১১১১১১০X বিস্তৃতি/চওড়া
উপরের হিসাব থেকে দেখা যায় ব্রহ্মান্ডের মোট আবরণের বিস্তৃতি ব্রহ্মান্ডের ব্যাসের ১ কোটি ১১ লক্ষ গুণ বড়, এভাবে হিসাব করলে দেখা যায় আমাদের পার্শ্ববর্তী ব্রহ্মান্ডের আবরণের বিস্তৃতি আমাদের চেয়ে একটু বেশী কারণ আমাদের নিকটতম ব্রহ্মান্ডটি ৫ গুণ আর আমাদের ব্রহ্মান্ডটি ৪ গুণ সুতরাং আমাদের চেয়ে কিছুটা বড় সেজন্য সেটির আবরণ আমাদের চেয়ে আরো একটু পুরু হইবে ।
আমাদের ব্রহ্মান্ডের আবরণের বিস্তৃতি
= ৫০ কোটি যোজন × ১১১০০০০০
= ৫৫৫০০০ ০০০ কোটি যোজন × ৮ [১ যোজন = ৮ মাইল]
= ৪৪৪ ০০০ ০০০ কোটি মাইল × ১০০০০০০০
= ৪৪৪০ ০০০ ০০০ ০০০ ০০০ মাইল
৫৮৬৫৬৯৬৬০০০ ০০০ মাইল = ১ আলোক বর্ষ
সুতরাং ৪৪৪০ ০০০ ০০০ ০০০ ০০০ মাইল
(৪৪৪০ ০০০ ০০০ ০০০ ০০০ ÷ ৫৮৬৫৬৯৬৬০০০ ০০০) আলোক বর্ষ
= ৭৫৭৬.৭৯ আলোক বর্ষ
এই হিসাব থেকে বুঝা যায় আমাদের ব্রহ্মান্ডের আবরণের ভিতর দিয়ে আলো যেতে ৭৫৭৬.৭৯ বছর সময় লাগবে ।
আমাদের নিকটবর্তী ব্রহ্মান্ড আমাদের চেয়ে একটু বড় সেইজন্য সেটির আবরণের বিস্তৃতি আমাদের চেয়ে একটু বেশি । আনুমানিক ধরা যেতে পারে ৭৯২৩.২১ আলোক বর্ষ ।
আমাদের ব্রহ্মান্ড থেকে আমাদের নিকটবর্তী ব্রহ্মান্ডের দূরত্ব হবে
(৭৫৭৬.৭৯ + ৭৯২৩.২১) আলোক বর্ষ
= ১৫৫০০ আলোক বর্ষ
সুতরাং দেখা যাচ্ছে আমাদের নিকটতম ব্রহ্মান্ডের দূরত্ব ১৫৫০০ আলোক বর্ষ । এভাবে আমরা যদি পাশাপাশি দুইটি ব্রহ্মান্ডের কথা বিবেচনা করি তাহা হলে দেখা যায় ১৫৫০০ আলোক বর্ষ দূরত্বের মধ্যে দুটি আগুনের স্তর বা আবরণ রহিয়াছে যাহার প্রতিটি ৪০,০০০ কোটি মাইল করে বিস্তূত, ব্রহ্মান্ডের এই সকল জ্বলন্ত আবরণকে বিজ্ঞানীরা জ্বলন্ত নক্ষত্র বলে মনে করছে । ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে প্রত্যেকটি ব্রহ্মান্ডে ১(এক) টি করে সূর্য রয়েছে, সেজন্য দুইটি ব্রহ্মান্ডে ২(দুই) টি সূর্য আছে কিন্তু বিজ্ঞানীরা ব্রহ্মান্ডের এই আগুনের আবরণকে জ্বলন্ত নক্ষত্র বা সূর্যের মত পদার্থ বলে ভুল করছে । বিজ্ঞানীদের হিসাবে দুইটি ব্রহ্মান্ডে ৪(চার) টি সূর্য হয়ে যায় । আমাদের ব্রহ্মান্ডের চেয়ে কোটি কোটি গুণ বড় ব্রহ্মান্ড রয়েছে সে সকল ব্রহ্মান্ডের আগুনের আবরণ কোটি কোটি গুণ বড় হইবে । সেগুলিকে কোটি কোটি গুণ বড় নক্ষত্র বলে মনে হবে ।
চার।
আন্তঃনাক্ষত্রিক মহাজাগতিক পদার্থ (Interstellar Galactic Material) ----
দুইটি নক্ষত্র বা ছায়াপথের (Milky Way) মাঝে বিজ্ঞানীরা বিশাল বিশাল জায়গা শূন্যস্থান দেখতে পাইতেছেন । এ জায়গাগুলি ধূলিবালিসহ বিভিন্ন তরল ও গ্যাসীয় পদার্থ দ্বারা ভর্তি, বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, দুইটি ছায়াপথের মাঝের আয়তন এত বেশী যাহা ছায়াপথ বা নক্ষত্রের নিজের আয়তন থেকে অনেক বেশী । এই জন্য Interstellar Galactic Material কে তাহারা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছেন ।
বিজ্ঞানীরা যাহাকে আন্তঃনাক্ষত্র্রিক মহাজাগতিক পদার্থ বলছে ভাগবতের বর্ণনা অনুসারে সেটা হল ব্রহ্মান্ডের আবরণ এই আবরণ জল, আগুন, বায়ু, আকাশ (ইথার), মহতত্ত্ব ইত্যাদি দ্বারা গঠিত । সেজন্য ইহাকে ধূলাবালি পূর্ণ অসম বলিয়া মনে হয় । ব্রহ্মান্ডের আবরণের দৈর্ঘ্য উক্ত ব্রহ্মান্ডের ব্যাসের ১ কোটি ১১ লক্ষ গুণ বড় । সুতরাং ব্রহ্মান্ডের নিজস্ব আয়তন থেকে আবরন অনেক বড়, সেটাই বিজ্ঞানীরা প্রতিপন্ন করেছেন । তারা বলছেন আন্তঃনক্ষত্রিক জাগতিক পদার্থের পরিমান অনেক বেশি ।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আদিম মহাবিশ্ব সম্ভবত অত্যন্ত বিশৃংঙ্খলা এবং নিয়ম বিহীন অবস্থায় ছিল । বিজ্ঞানী সমাজের ধারনা মহাবিশ্ব যদি সত্যিই স্থানিকভাবে অসীম হয় কিংবা মহাবিশ্বগুলির সংখ্যা যদি অনন্ত হয় তা হলে সম্ভবত কোন স্থানে এমন কতগুলি বৃহৎ অঞ্চল থাকবে যেগুলো হয়েছিল মসৃণ-সমরূপভাবে ।
ব্যাপারটা অনেকটা সেই বহূ পরিচিত বাঁদরের বিরাট দলের মত । তাহারা টাইপরাইটারের আঙ্গুল ঠুকিয়ে চলিয়াছে – যাহা ছাপা হচ্ছে তাহার বেশির ভাগটাই ভূষিমাল কিন্তু দৈবাৎ তারা শেক্সপিয়ারের একটি সনেটও টাইপ করিয়া ফেলিতে পারে । তেমনিভাবে মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে এমন কি হতে পারে যে আমরা এমন একটি অঞ্চলে রয়েছি যেটা ঘটনাচক্রে মসৃন এবং নিয়মবদ্ধ ? আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপারটি খুবই অসম্ভব মনে হতে পারে কারণ ওই রকম মসৃণ অঞ্চলের চাইতে বিশৃঙ্খল এবং নিয়মবিহীন অঞ্চলের সংখ্যা অনেক বেশি । কিন্তু যদি অনুমান করা যায় মসৃন অঞ্চলগুলিতেই নীহারিকা এবং তাঁরকা গঠিত হয়েছে এবং এই সমস্ত অঞ্চলেই আমাদের মত আত্মজ (self replicating) সৃষ্টি করিতে সক্ষম জটিল জীব বিকাশের মতো সঠিক পরিস্থিতি রয়েছে এবং এই জীবরাই প্রশ্ন করতে সক্ষম মহাবিশ্ব এরকম মসৃণ কেন ? এটা হইল যাহাকে নরত্বীয় নীতি (anthropic princple) বা মানবতত্ত্ব নীতি বলে ।
বিজ্ঞানীরা এই আলোচনা থেকে প্রতিপন্ন করা যায় মহাবিশ্ব যদি অসীম হয় এবং ব্রহ্মান্ডের সংখ্যা অনন্ত হয় তা হলে বৃহৎ বৃহৎ মসৃণ সমরূপ অঞ্চল থাকবে । বিজ্ঞানীদের এই মতবাদের সাথে ভাগবত একমত । কারণ ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে ব্রহ্মান্ডের সংখ্যা অনন্ত কোটি এবং প্র্রত্যেকটি ব্রহ্মান্ডে গ্রহ নক্ষত্র সজ্জিত সুশৃঙ্খল সৌর পরিবার রয়েছে । প্রতিটি ব্রহ্মান্ডে একটি সূর্য ব্রহ্মান্ডের মাঝখানে অবস্থান করিয়া সম্পূর্ণ ব্রহ্মান্ডকে তাপ ও আলোক প্রদানের মাধ্যমে জীবিত রেখেছে এবং প্রতি ব্রহ্মান্ডে আমাদের চেয়ে অধিক বুদ্ধিমান মানুষসহ ৮৪ লক্ষ প্রজাতির জীব রয়েছে । সুতরাং দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞানীদের এই ধারনার সাথে ভাগবতের মিল আছে ।
এই আলোচনার অন্য অংশে বর্ণনা করা হয়েছে কতগুলি বানর টাইপ করতে করতে ঘটনাচক্রে যেমন শেক্সপিয়ারের একটি সনেট কবিতা টাইপ করতে পারে ঠিক সেইরকম কোন ঘটনা চক্রে এই মহাবিশ্বে মসৃণ অঞ্চলের সৃষ্টি হয়েছে ফলে মানুষের মত বুদ্ধিমান জীবের সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে । ভাগবত এই অংশের তীব্র প্রতিবাদ করয়া বলেছে এই মহাবিশ্বে কোন কিছু ঘটনা চক্রে হঠাৎ ঘটে নাই সকল সৃষ্টির পিছনে সৃষ্টিকর্তার সুনির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রন রহিয়াছে ।
অনন্ত কোটি ব্রহ্মান্ডে সুশৃংঙ্খল সাজানো পরিবেশ রয়েছে
যস্য প্রভা প্রভবতো জগদন্ডকোটিকোটিষবশেষবসুধাদি বিভূতিভিন্নম্ ।
তদ্ ব্রহ্ম নিষ্কলমনন্তমেষভূতং গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।।(ব্রহ্ম-সংহিতা ৫/৪০)
অনুবাদ
অনন্তকোটি ব্রহ্মান্ডে অনন্ত বসূধাদি বিভূতির দ্বারা যিনি ভেদপ্রাপ্ত হইয়াছেন, সেই পূর্ণ, নিরবিচ্ছিন্ন এবং অশেষভূত ব্রহ্ম যাঁহার প্রভা, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি ।
অনন্তকোটি ব্রহ্মান্ডের প্রতিটি ব্রহ্মান্ডই বিভিন্ন আকৃতি এবং পরিবেশ সমন্বিত অসংখ্য গ্রহ নক্ষত্রে পূর্ণ । সে সমস্ত প্রকাশিত হয়েছে অনন্ত অদ্বয়-ব্রহ্ম থেকে, যাহা পূর্ণ জ্ঞানে বিরাজমান । সেই অন্তহীন ব্রহ্মজ্যোতির উৎস হচ্ছে, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীগোবিন্দের চিন্ময় দেহ এবং সেই গোবিন্দই আদি পুরুষরূপে বন্দিত হয়েছেন ।
এখানে বর্ণনা করা হয়েছে ব্রহ্মান্ডের সংখ্যা অনন্তকোটি এবং প্রতিটি ব্রহ্মান্ডের সুনির্দিষ্ট সজানো গোছানো সুন্দর পরিবেশ রয়েছে যা জীব বসবাসের উপযুক্ত এবং ব্রহ্মান্ডগুলি ভগবাণের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে । সুতরাং বিজ্ঞানীদের যে ধারনা মহাবিশ্বের মসৃণ অঞ্চল ঘটনাচক্রে সৃষ্টি হয়েছে ভাগবত সেটা সমরর্থন করে না ।। আসলে যে বিষয়টি ঘটছে তা হল একটি ব্রহ্মান্ডের আবরণগুলির দৈর্ঘ্য ইহর ব্যাসের ১ কোটি ১১ লক্ষ গুণ বড় এবং আবরণ আগুন, পানি, বায়ু ইত্যাদি দ্বারা গঠিত । সেজজন্য ইহা অসম, অস্থির, বিশৃংঙ্খল বলিয়া মনে হয় । আমরা যদি বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের কথা বিবেচনা করি তা হলে দেখা যাবে মসৃণ ব্রহ্মান্ডের তুলনায় অমসৃণ জায়গা ১ কোটি ১১ লক্ষ গুণ বেশী । এজন্য বিজ্ঞানীরা এই মহাবিশ্বকে অমসৃন বিশৃংঙ্খল বলিয়া ভাবিতেছেন ।
বিজ্ঞানীরা এ বিশাল পরিমাণ আন্তঃনক্ষত্রিক বস্তু লয়ে গুরুত্ব সহকারে গবেষনা করছেন ।
এ বিষয়ে বিজ্ঞানী বয়চটের অভিমত আন্তঃছায়াপথ বা আন্তঃনাক্ষত্রিক (Interstellar Galactic Material) সংযোগকারী এ সব গ্যাস পিন্ডের বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব অত্যাধিক । কেননা “বিশ্ব সৃষ্টির বিবর্তন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে যে ধারণা এখন চালু রয়েছে” – এসব সংযোগকারী গ্যাসপিন্ড সেই ধারণা বহুলাংশে বদলে দিতে পারে ।
বিজ্ঞানীদের ধারনা বিশ্বসৃষ্টির বিবর্তনে হয়ত এই আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তুর ভূমিকা রয়েছে, সেজন্য তারা এই বস্তুগুলিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছেন । আমি আলোচনার মাধ্যমে প্রমাণ করেছি ভাগবত যাকে ব্রহ্মান্ডের আবরণ বলিতেছে বিজ্ঞানীরা সেটাকে আন্তঃনাক্ষত্রিক পদার্থ বলিতেছেন ।
ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে, ব্রহ্মান্ড কারণ সমুদ্র থেকে বুদবুদের মত সৃষ্টি হয় । প্রতিটি বুদবুদের যে আবরণ সেটাই উক্ত ব্রহ্মান্ডের আবরণ এবং উক্ত বুদবুদের মধ্যে ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি হয় । ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির যাবতীয় উপাদান বুদবুদের আবরণ থেকে আসে অর্থাৎ ব্রহ্মান্ডগুলি ইহার আবরণ থেকে সৃষ্টি হয়েছে । এ জন্য বিজ্ঞানীরা ব্রহ্মান্ডের এই আবরণকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা কররছে । এ বিষয়ে ভাগবতের বক্তব্য
কারণ সমুদ্রে বুদবুদ আকারে ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি
যঃ কারণার্ণবজলে ভজতি স্ম যোগনিদ্রামনন্তজগদন্ডসরোমকূ পঃ ।
আধারশক্তিমবলম্ব্য পরাংস্বমূর্তিং গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।।(ব্রহ্ম-সংহিতা ৫/৪৭)
অনুবাদ
এখানে ব্রহ্মাজি বলেছেন, আমি সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি, যিনি তাঁহার অংশাবতার মহাবিষ্ণুরূপে কারণ-সমুদ্রে যোগনিদ্রায় শায়িত এবং তাঁহার দিব্য শরীরের রোমকূপ থেকে অসংখ্য ব্রহ্মান্ড বুদবুদ আকারে প্রকাশিত হইতেছে ।
এ খানে বর্ণনা করা হয়েছে মহাবিষ্ণু কারণ সমুদ্রে (Causal Ocean) যোগনিদ্রায় শায়িত আছেন । তাঁহার রোমকূপ থেকে অসংখ্য ব্রহ্মান্ড বুদবুদ আকারে প্রকাশিত হইতেছে । এই বুদবুদগুলি পরবর্তীতে এক একটি ব্রহ্মান্ডে পরিণত হয় ।
সুতরাং বিজ্ঞানীরা যদি মনে করেন আন্তঃনাক্ষত্রিক পদার্থ থেকে ব্রহ্মান্ডের বিবর্তন বা সৃষ্টি হয়েছে তহা হলে তাহাদের ধরণা ভাগবতের আলোকে সঠিক ।
এক।
ভাগবতের আলোকে কোয়ান্টাম থিওরী (Quantum Theory) -
ভাগবতে মহাবিশ্বের যে পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা প্রদান করিয়াছে কোয়ান্টাম তত্ত্ব সেটার অংশ বিশেষ । ভাগবতের আলোকে কোয়ান্টাম তত্ত্ব এখানে আলোচনা করা হল । পরমাণুর সংজ্ঞা -
চরমঃ সদ্বিশেষাণামনেকোহসংযুতঃ সদা ।
পরমাণুঃ স বিজ্ঞেয়ো নৃণামৈক্যভ্রমো যতঃ ।। (ভাগবত ৩/১১/১)
অনুবাদ - জড় জগতের যে ক্ষুদ্রতম অংশ অবিভাজ্য এবং দেহরূপে যাহার গঠন হয় না, তাহাকে বলা হয় পরমাণু । তাহা সর্বদা তাহার অদৃশ্য অস্তিত্ব নিয়ে বিদ্যমান থাকে, এমনকি প্রলয়ের পরেও । জড় দেহ এই প্রকার পরমাণুর সমণ্বয়, কিন্তু সাধারন মানুষের সেই সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারনা রয়েছে । এই শ্লোকে পরমাণুর সংজ্ঞা প্রদান করা হইয়াছে । এ বিষয়ে আমরা পরবর্তী পোষ্টে আলোচনা করব ।মহাবিশ্ব পরমাণু দ্বারা গঠিত -
সত এব পদার্থস্য স্বরূপাবস্থিতস্য যৎ ।
কৈবল্যং পরমমহানবিশেষো নিরন্তর ।।(ভাগবত ৩/১১/২)
অনুবাদ - পরমাণু হইতেছে ব্যক্ত জগতের চরম অবস্থা । যখন তাহারা বিভিন্ন প্রকারের শরীর নির্মাণ না করিয়া তাহাদের স্বরূপে স্থিত থাকে, তখন তাহাদের বলা হয় পরম মহৎ ।ভৌতিক রূপে নিশ্চয়ই অনেক প্রকারের শরীর রহিয়াছে, কিন্তু পরমাণুর দ্বারা সমগ্র জগৎ সৃষ্টি হয় । এই শ্লোকে বর্ণনা করা হইয়াছে, পরমাণু দ্বারা জগত গঠিত যাহা কোয়ান্টাম তত্ত্বে বলা হইয়াছে । ভগবান পরমাণু থেকে বিশাল ব্রহ্মান্ড সব জায়গায় বিরাজিত -
পরমাণুপরমমহতো-সত্বমাদ্যন্তান্তরবর্তী ত্রয়বিধুরঃ ।
আদাবন্তেহপি চ সত্ত্বানাং যদ্ ধ্রুবং তদেবান্তরালেহপি ।।(ভাগবত ৬/১৬/৩৬)
অনুবাদ - এই জগতে পরমাণু থেকে শুরু করিয়া বিশাল ব্রহ্মান্ড এবং মহত্তত্ত্ব পর্যন্ত সব কিছুরই আদি, মধ্য এবং অন্তে আপনি বর্তমান রহিয়াছেন । অথচ আপনি আদি, মধ্য এবং অন্ত রহিত সনাতন । এই তিনটি অবস্থাতেই আপনার অবস্থা উপলব্ধি করা যায় বলিয়া আপনি নিত্য । যখন জগতের অস্তিত্ব থাকে না, তখন আপনি আদি শক্তিরূপে বিদ্যমান থাকেন । এই শ্লোকে বর্ণনা করা হইয়াছে প্রলয়ের সময় পরমাণু ধ্বংস হইয়া শক্তিতে পরিণত হয়, আবার যখন সৃষ্টি শুরু হয় তখন শক্তি থেকে পরমাণু সৃষ্টি হয় । পরবর্তী পোষ্টে আমি আলোচনা করব সৃষ্টির শুরুতে গর্ভোদক নামক শক্তি থেকে সবকিছু সৃষ্টি হয় ।কোয়ান্টাম তত্ত্বে বর্ণনা করা হইয়াছে শক্তি হইতে পরমাণু সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু শক্তি আসল কোথা থেকে ? এই প্রশ্নের উত্তরে বিজ্ঞানীরা বলেছেন এই মহাবিশ্বে সর্বমোট শক্তির পরিমাণ ০ (শূন্য) । এই প্রশ্নের সাথে এই উত্তরের কি সামঞ্জস্য তা আমি উপলব্ধি করতে পারছি না । আমাদের প্রশ্ন শক্তি আসল কোথা থেকে ? তার উত্তরে বলল, মহাবিশ্বের সর্বমোট শক্তির পরিমাণ শূন্য । কিভাবে এই সমস্যার সমাধান হল তা আমি উপলব্ধি করতে পারছি না । শক্তি কোথা হইতে আসিল-
শাস্ত্রে তা এভাবে প্রদান করিয়াছে
একোহপ্যসৌ রচয়িতুং জগদন্ডকোটিং যচ্ছক্তিরস্তি
জগদন্ডচয়া যদন্তঃ
অন্ডান্তরস্থপরমাণুচয়ান্তরস্থং
গোবিন্দমাদি পুরুষং তমহং ভজামি ।। (ব্রহ্ম সংহিতায় ৫/৩৫)
অনুবাদ – আমি পরমেশ্বর ভগবান গোবিন্দের ভজনা করি, যিনি তাঁহার এক অংশের দ্বারা প্রতিটি ব্রহ্মান্ড এবং প্রতিটি পরমাণুতে প্রবিষ্ট হইয়াছেন, এইভাবে তিনি সমগ্র সৃষ্টিতে তাঁহার অনন্ত শক্তির প্রকাশ করিয়াছেন ।
এই শ্লোকে বর্ণনা করা হইয়াছে ভগবানের শক্তি পরমাণুতে প্রবেশ করিবার ফলে সৃষ্টি কার্যক্রম শুরু হয় অর্থাৎ পরমাণু ভগবানের শক্তি থেকে সৃষ্টি হয় । শক্তি আসিল কোথা থেকে তার উত্তর শাস্ত্রে বলা হয়েছে, শক্তি ভগবান থেকে এসেছে । পরে আমি ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি পর্বে আলোচনা করব এই মহাবিশ্ব প্রধান নামক একটি চিন্ময় বা বিপরীত পদার্থ থেকে সৃষ্টি হয়েছে । সুতরাং বলা যায় পরমাণু চিন্ময় বা বিপরীত পদার্থ থেকে সৃষ্টি হয়েছে যা বিজ্ঞানীদের ধারণা । সুতরাং বলা যায় বৈজ্ঞানিকেরা যে অসম্পূর্ণ কণাবাদী তত্ত্ব (Quantum Theory) আবিষ্কার করেছেন ভাগবত সেটাকে আরো পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশ করিয়াছে ।
দুই।
বৈদিক মহাবিশ্ব সৃষ্টি রহস্য (The Vedic Concept of Creation of the whole Universe)
মহাবিশ্ব আসিয়াছে কোথা থেকে এবং যাচ্ছে বা কোথায় ? মহাবিশ্বের কি কোন শুরু ছিল ? যদি থাকিয়া থাকে তবে তাহার আগে কি ঘটেছিল ? কালের চরিত্র কি ? কাল কি কখনও শেষ হবে ? আমি কে ? কোথা হইতে আসিয়াছি ? কোথায় যাব ? আমি এরূপ প্রশ্ন করিতেছি কেন ?
এ সকল মানুষের শাশ্বত প্রশ্ন এর সঠিক উত্তর জানবার জন্য বিজ্ঞানীরা বহুদিন যাবৎ গবেষণা করিতেছে । এসব বিষয় নিয়ে অসংখ্য বিজ্ঞানী গবেষণা করিয়াছেন এবং এখনো করছে । তাহারা ইতিমধ্যে মহাবিশ্ব সৃষ্টি রহস্য বিষয়ে অনেক তত্ত্ব, মতবাদ, হাইপোথিসিস, সূত্র আবিষ্কার করেছেন । বিজ্ঞানীদের অনেক আবিষ্কার আছে পরস্পর বিরোধী একটির সাথে অন্যটির মিল নেই ।
মহাবিশ্ব সৃষ্টি রহস্য বিষয়ে যে সকল মতবাদ বিজ্ঞানীরা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করিতেছে সেইগুলি নিম্নে প্রকাশ করা হইল ।
১। আইনষ্টাইনের ব্যাপক আপেক্ষিক তত্ত্ব (Einstein’s Law of Relativity)
২। বিগব্যাঙ্গ থিওরী (Big Bang Theory)
৩। বিগ ক্রাঞ্চ (Big Crunch Theory)
৪। বুদবুদ তত্ত্ব (Bubbles Theory)
৫। কণাবাদীতত্ত্ব (Quantum Theory)
৬। মানবতত্ত্ব নীতি (Anthropic Principle)
ক) দুর্বল মানবতত্ত্ব নীতি (Weak Anthropic Principle)
খ) সবল মানবতত্ত্ব নীতি (Strong Anthropic Principle)
এই নীতিগুলি সম্বন্ধে ভাগবতে বিস্তারিত আলোচনা করা হইয়াছে । দেখা গিয়াছে বেশিরভাগ নীতির মধ্যে সামঞ্জস্য নাই । আজ বিজ্ঞানী সমাজের সামনে একটি চ্যালেঞ্জ, মহাবিশ্ব সম্বন্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ সম্পূর্ণ তত্ত্ব আবিষ্কার করা এবং আমরা যে বিশ্বে বসবাস করি তাহার একটি সম্পূর্ণ বিবরণ দেওয়া ।
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী স্টিফেন ডব্লূ হকিং তাঁহার A Brief History of Time (কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস) বইটিতে আবেদন করেছেন ভবিষ্যতে হয়ত আমাদের চেয়ে বুদ্ধিমান মানুষের আগমন ঘটবে যারা মহাবিশ্ব সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ বিবরণ প্রদান করতে পারবে । আমার মতে ভাগবত (বৈদিক শাস্ত্র) মানুষের সেই আদিম ইচ্ছাকে পূরণ করিতে পারবে । ভাগবতে বিশ্বব্রহ্মান্ড বা মহাবিশ্বের গঠন সম্বন্ধে অত্যন্ত পূর্ণাঙ্গ ও গঠনমূলক বর্ণনা করেছে যদি সেইসব বর্ণনা পূর্ণাঙ্গভাবে উল্লেখ করা হয় তা হলে একটি বৃহৎ গ্রন্থে রূপ নিবে সেইজন্য অত্যন্ত সংক্ষেপে কিছু উল্লেখ করা হল যারা বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টি রহস্য পূ্ণাঙ্গভাবে জানতে চান তাদেরকে ভাগবত পড়িতে হবে ।
ভাগবতের আলোকে মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য উপলব্ধি করতে হলে আমাদের কয়েকটি বিষয় সম্বন্ধে ধারণা নিতে হইবে ।
জড় জগত (Material World):
আমরা যে জগতে বাস করি তাকে জড় জগত বলে । এই জগত জড় অর্থাৎ প্রাণহীন, ইহার সৃষ্টি ও ধ্বংস আছে । এই সৃষ্টি ও ধ্বংস কার্যক্রম চক্রাকারে চলিতে থাকে অর্থাৎ প্রথমে সৃষ্টি হয় তারপর কিছুদিন অবস্থান করে, কিছুদিন পর আবার ধ্বংস হয় । সুতরাং জড় জগতের সৃষ্টি, অবস্থান এবং ধ্বংস শাশ্বত নিয়মে নির্দিষ্ট সময় পর পর ঘটিতেছে । এইভাবে বিচার করিলে দেখা যায়, জড় জগতের সৃষ্টি ও ধ্বংস শাশ্বত ইহার কোন শুরু বা শেষ নাই ।
জড় জগত পুণঃপুণঃ সৃষ্টি ও ধ্বংস হয় ----
সর্বভূতানি কৌন্তেয় প্রকৃতং যান্তি মামিকাম্ ।
কল্পক্ষয়ে পুনস্তানি কল্পানি কল্পাদৌ বিসৃজাম্যহম্ ।।
প্রকৃতিং স্বামবষ্টভ্য বিসৃজামি পুনঃ পুনঃ
ভূতগ্রামমিমং কৃৎস্নমবশং প্রকৃতের্বশাৎ ।। (ভাগবত ২/১০/৩)
অনুবাদ
কল্পান্তে সম্পূর্ণ সৃষ্টি, যথা জড় জগত এবং প্রকৃতিতে ক্লেশ প্রাপ্ত জীব আমার দিব্য দেহে লয় প্রাপ্ত হয় এবং নতুন কল্পের আরম্ভে আমার ইচ্ছার প্রভাবে তাহারা পুণরায় প্রকাশিত হয় । এ ভাবে প্রকৃতি আমার নিয়ন্ত্রনে পরিচালিত হয় । আমার ইচ্ছার প্রভাবে তাহা পুণঃপুণঃ প্রকট হয় এবং লয় হয় ।
স এষ আদ্যঃ পুরুষঃ কল্পে কল্পে সৃজত্যজঃ ।
আত্মাত্মন্যাত্মনাত্মানং স সংযচ্ছতি পাতি চ ।। (ভাগবত ২/৬/৩৯)
অনুবাদ
সেই আদিপুরুষ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জন্মরহিত হওয়া সত্ত্বেও প্রথম অবতার মহাবিষ্ণু রূপে নিজেকে বিস্তার করিয়া এই ব্যক্ত জগতের সৃষ্টি করেন । তাঁহার মধ্যেই অবশ্য সৃষ্টি প্রকাশিত হয় এবং জড় পদার্থ ও জড় অভিব্যক্তি সবই তিনি স্বয়ং কিছুকালের জন্য তিনি তাহাদের পালন করেন এবং তারপর তিনি পুণরায় তাহাদের আত্মসাৎ করিয়া নেন ।
উপরের শ্লোক দুইটি থেকে বুঝা যায় জড়জগত পুণঃপুণঃ সৃষ্টি এবং ধ্বংস হচ্ছে । আমরা জড় জগতের একটি ব্রহ্মান্ডের মধ্যে অবস্থিত পৃথিবী নামক গ্রহে বসবাস করিতেছি । এরকম অনন্তকোটি ব্রহ্মান্ড নিয়া বিশ্ব ব্রহ্মান্ড গঠিত । ইহাকে জড়জগত বলে ।
ব্রহ্মান্ডের সংখ্যা --------
ক্ষিত্যাদিভিরেষ কিলাবৃতঃ সপ্তভির্দশগুণোত্তরৈরন্ডকোশঃ ।
যত্র পতত্যণুকল্পঃ সহস্রকোটিকোটিভিস্তদনন্তঃ ।। (ভাগবত ৬/১৬/৩৭)
অনুবাদ
প্রতিটি ব্রহ্মান্ড মাটি, জল, আগুন, বায়ু, আকাশ, মহতত্ত্ব এবং অহংকার এই সাতটি আবরণের দ্বারা আচ্ছাদিত এবং প্রতিটি আবরণ পূর্ববর্তী থেকে দশগুন অধিক । এই ব্রহ্মান্ডটি ছাড়া আরও কোটি কোটি ব্রহ্মান্ড রহিয়াছে এবং সেইগুলি আপনার মধ্যে পরমাণুর মতো পরিভ্রমণ করিতেছে । তাই আপনি অনন্ত নামে প্রসিদ্ধ ।
এই শ্লোকে বর্ণনা করা হইয়াছে ব্রহ্মান্ডের সংখ্যা কোটি কোটি । জড় জগত সম্বন্ধে আধুনিক বিজ্ঞানের ধারণা সঠিক । কারণ বিজ্ঞানে বলা হয়েছে কোটি কোটি গ্রহ নক্ষত্র লইয়া এই মহাবিশ্ব বা বিশ্বব্রহ্মান্ড গঠিত ।
ব্রহ্মান্ড (Universe)
কতগুলি গ্রহ, নক্ষত্র, সূর্য, চন্দ্র নিয়ে একটি ব্রহ্মান্ড গঠিত হয় । যেমন – আমাদের সৌর পরিবারের সাথে আরো কিছু গ্রহ নক্ষত্র যোগ করিলে আমাদের ব্রহ্মান্ড গঠিত হয় । ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে প্রত্যেকটি ব্রহ্মান্ডের একটি নির্দিষ্ট আয়তন এবং আবরণ রয়েছে । প্রতিটি ব্রহ্মান্ডের ব্যাসের গভীরতা আলাদা আলাদা । যেমন –
আমাদের ব্রহ্মান্ডেরর ব্যাস
শ্রীশুক উবাচ
এতাবানেব ভূবলয়স্য সন্নিবেশঃ ।
প্রমাণলক্ষণতো ব্যাখ্যাতঃ ।। (ভাগবত ৫/২১/১)
অনুবাদ
শুকদেব গোস্বামী বলিলেন – হে রাজন, এইভাবে আমি প্রমাণ এবং লক্ষণ প্রদর্শন পূর্বক ব্রহ্মান্ডের পরিমাণ বর্ণনা করিলাম ।
এই শ্লোকে আমাদের ব্রহ্মান্ডের ব্যাসের কথা বর্ণনা করা হয়েছে । পরবর্তী শ্লোকে দেখিব আমাদের ব্রহ্মান্ডের ব্যাস ৫০ কোটি যোজন বা ৪০০ কোটি মাইল । আমাদের ব্রহ্মান্ডকে ৪(চার) গুন ধরিয়া অন্য ব্রহ্মান্ডগুলি বড় হইতে থাকে অর্থাৎ আমাদের পরবর্তী ব্রহ্মান্ডের আয়তন ৫(পাঁচ) গুণ । ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে এইভাবে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি গুণ বড় ব্রহ্মান্ড রয়েছে ।
তিন।
ব্রহ্মান্ডের আবরণ (Layer of Universe)
প্রত্যকটি ব্রহ্মান্ড ৭(সাত) টি আবরনের দ্বারা আবৃত ।
ব্রহ্মান্ডের আবরনের ধরন ও ব্যাস
বিকারৈঃ সহিতো যুক্তৈর্বিশেষাদিভিরাবৃতঃ ।
আন্ডকোশো বহিরয়ং পঞ্চাশৎ কোটিবিস্তৃতঃ ।। (ভাগবত ৩/১১/৪০)
অনুবাদ
আটটি জড় উপাদানের সমন্বয়ে ষোড়শ প্রকার বিকার থেকে প্রকাশিত এই যে ব্রহ্মান্ড, তাহার অভ্যন্তর পঞ্চাশ কোটি যোজন বিস্তৃত এবং নিম্নলিখিত আবরণের দ্বারা আবৃত ।
এইখানে ব্রহ্মান্ডের আবরণের কথা বলা হয়েছে এবং ব্রহ্মান্ডের ব্যাস ৫০(পঞ্চাশ) কোটি যোজন তাহা উল্লেখ করা হয়েছে । এখানে ব্রহ্মান্ডের আবরণের যে উপাদান সেইগুলিকে বিকার গ্রস্ত বলা হয়েছে অর্থাৎ গ্যাসীয় অবস্থায় বিদ্যমান । যেমন – জলের আবরণ ইহা H2 ও O2 গ্যাস দ্বারা গঠিত, ব্রহ্মান্ডের আবরণগুলি বিকার গ্রস্ত হওয়ার জন্য একটি ব্রহ্মান্ড থেকে অন্য ব্রহ্মান্ডে আলোক রশ্মি গমন করতে পারে ।
ব্রহ্মান্ডের আবরণ
দশোত্তরাধিকৈর্যত্র প্রবিষ্টঃ পরমাণুবৎ ।
লক্ষ্যতেহন্তর্গতাশ্চান্যে কোটিশো হ্যন্ডরাশয়ঃ ।। (ভাগবত ৩/১১/৪১)
অনুবাদ
ব্রহ্মান্ডকে আবৃত করে যে সমস্ত তত্ত্ব, তাহা উত্তরোত্তর দশগুন অধিক বিস্তৃত এবং সমস্ত ব্রহ্মান্ডগুলি এক বিশাল সমন্বয়ের পরমাণু মতো প্রতিভাত হয় ।
এই শ্লোকে বর্ণনা করা হইয়াছে ব্রহ্মান্ডের প্রথম আবরন থেকে দ্বিতীয় আবরণ দশ গুন বড়, তৃতীয় আবরণ আবার দ্বিতীয় থেকে দশ গুন বড় এভাবে ক্রমান্বয়ে আবরণগুলির বিস্তৃতি বাড়িতে থাকে ।
শ্লোকের দ্বিতীয় অংশে আরো বর্ণনা করা হয়েছে আবরণগুলি বৃত্তাকারে ব্রহ্মান্ডকে ঘিরিয়া রাখিয়াছে এই জন্য ইহা দেখতে একটি পরমাণুর মত গোল । এখানে ব্রহ্মান্ডের আবরণকে পরমাণুর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে যাহা অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে । একটি পরমাণুতে প্রোটন ও নিউট্রনকে কেন্দ্র করে ইলেকট্রন গুলি এমনভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে যাহাতে কেন্দ্রকে বাহির হইতে দেখ যায় ঠিক সেরকম ব্রহ্মান্ডের ৭(সাত) টি আবরণ থাকা সত্ত্বেও ব্রহ্মান্ডকে বাহির হইতে দেখ যায় এবং ব্রহ্মান্ড থেকে আলোক নির্গত হইতে পারে । প্রত্যেকটি ব্রহ্মান্ড গোলাকার বল বা পরমাণু মত সেই বিষয়টিও এখানে উল্লেখ করা হয়েছে । প্রতিটি ব্রহ্মান্ডের ভিতরে নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা রয়েছে যাহা গোলাকার ।
প্রতিটি ব্রহ্মান্ড ৭(সাত) টি আবরণ দ্বারা আবৃত সেই আবরণগুলি বিভিন্ন পদার্থ দ্বারা গঠিত ।
ব্রহ্মান্ডের আবরণের বিস্তৃতি
এতদন্ডং বিশেষাখ্যং ক্রমবৃদ্ধৈর্দশোত্তরৈঃ ।
তোয়াদিভিঃ পরিবৃতং প্রধানেনাবৃতৈর্বহিঃ ।
যত্র্রলোকবিতানোহয়ং রূপং ভগবতো হরেঃ ।। (ভাগবত ৩/২৬/৫২)
অনুবাদ
এই ব্রহ্মান্ডকে বলা হয় জড়া প্রকৃতির প্রকাশ । তাহাতে জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ, অহংকার এবং মহত্তত্ত্বের যে আবরণ রহিয়াছে, তাহা ক্রমান্বয়ে পূর্বটির থেকে পরবর্তী আবরণটি দশ গুণ অধিক এবং তাহার শেষ আবরনটি হইতেছে প্রধানের আবরণ । এই ব্রহ্মান্ডে ভগবানের বিরাটরূপ বিরাজ করিতেছে, যাহার দেহের একটি অংশ হচ্ছে চতুর্দশ ভুবন ।
এই শ্লোকে ব্রহ্মান্ডের ৭(সাত) টি আবরণের পদার্থের নাম উল্লেখ করা হয়েছে । প্রতিটি আবরণ পূবটির থেকে ১০ গুণ চওড়া । যেমন ব্রহ্মান্ডের প্রথম আবরণটি জলের তৈরী এখানে জল মানে জলের বিকার অবস্থা যা আগের শ্লোকে দেখানো হয়েছে অর্থাৎ জলের বায়বীয় অবস্থায় অবস্থান করে । ব্রহ্মান্ডের ব্যাস ৫০ কোটি যোজন অর্থাৎ জলের আবরণ ৫০ × ১০ = ৫০০ কোটি যোজন পুরু । এইভাবে পরবর্তী আবরণগুলি বৃদ্ধি পেতে থাকে ।
যদি ব্রহ্মান্ডের ব্যাস X ধরা হয় তা হলে ব্রহ্মান্ডের আবরণকে নিম্নলিখিত ভাবে প্রকাশ করা যায় ।
ব্রহ্মান্ডের আবরণগুলির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা
১ম আবরণ ১০ × X = ১০X বিস্তৃতি/চওড়া জল(বিকার অবস্থা)দিয়ে তৈরী
২য় আবরণ ১০X × ১০ = ১০০X বিস্তৃতি/চওড়া আগুন দিয়ে তৈরী
৩য় আবরণ ১০০X × ১০ = ১০০০X বিস্তৃতি/চওড়া বায়ু দিয়ে তৈরী
৪র্থ আবরণ ১০০০X × ১০ = ১০০০০X বিস্তৃতি/চওড়া আকাশ(ইথার)
৫ম আবরণ ১০০০০X × ১০ = ১০০০০০X বিস্তৃতি/চওড়া অহংকার(সূক্ষ্ম পদার্থ যা সাধারণভাবে অনুভব করা যায় না কিন্তু ইহা জড় পদার্থ)
৬ষ্ঠ আবরণ ১০০০০০X × ১০ = ১০০০০০০X বিস্তৃতি/চওড়া মহতত্ত্ব(বিশ্বব্রহ্মান্ড তৈরীর প্রাথমিক পদার্থ যা দ্বারা ব্রহ্মান্ড তৈরী হয়)
৭ম আবরণ ১০০০০০০X × ১০ = ১০০০০০০০০X বিস্তৃতি/চওড়া প্রধান(সূক্ষ্ম অব্যক্ত বস্তু, যা অনুভব করা যায় না, ইহাকে সাধারণভাবে শূন্যস্থান বলা যাইতে পারে)
মোট – ১১১১১১১০X বিস্তৃতি/চওড়া
উপরের হিসাব থেকে দেখা যায় ব্রহ্মান্ডের মোট আবরণের বিস্তৃতি ব্রহ্মান্ডের ব্যাসের ১ কোটি ১১ লক্ষ গুণ বড়, এভাবে হিসাব করলে দেখা যায় আমাদের পার্শ্ববর্তী ব্রহ্মান্ডের আবরণের বিস্তৃতি আমাদের চেয়ে একটু বেশী কারণ আমাদের নিকটতম ব্রহ্মান্ডটি ৫ গুণ আর আমাদের ব্রহ্মান্ডটি ৪ গুণ সুতরাং আমাদের চেয়ে কিছুটা বড় সেজন্য সেটির আবরণ আমাদের চেয়ে আরো একটু পুরু হইবে ।
আমাদের ব্রহ্মান্ডের আবরণের বিস্তৃতি
= ৫০ কোটি যোজন × ১১১০০০০০
= ৫৫৫০০০ ০০০ কোটি যোজন × ৮ [১ যোজন = ৮ মাইল]
= ৪৪৪ ০০০ ০০০ কোটি মাইল × ১০০০০০০০
= ৪৪৪০ ০০০ ০০০ ০০০ ০০০ মাইল
৫৮৬৫৬৯৬৬০০০ ০০০ মাইল = ১ আলোক বর্ষ
সুতরাং ৪৪৪০ ০০০ ০০০ ০০০ ০০০ মাইল
(৪৪৪০ ০০০ ০০০ ০০০ ০০০ ÷ ৫৮৬৫৬৯৬৬০০০ ০০০) আলোক বর্ষ
= ৭৫৭৬.৭৯ আলোক বর্ষ
এই হিসাব থেকে বুঝা যায় আমাদের ব্রহ্মান্ডের আবরণের ভিতর দিয়ে আলো যেতে ৭৫৭৬.৭৯ বছর সময় লাগবে ।
আমাদের নিকটবর্তী ব্রহ্মান্ড আমাদের চেয়ে একটু বড় সেইজন্য সেটির আবরণের বিস্তৃতি আমাদের চেয়ে একটু বেশি । আনুমানিক ধরা যেতে পারে ৭৯২৩.২১ আলোক বর্ষ ।
আমাদের ব্রহ্মান্ড থেকে আমাদের নিকটবর্তী ব্রহ্মান্ডের দূরত্ব হবে
(৭৫৭৬.৭৯ + ৭৯২৩.২১) আলোক বর্ষ
= ১৫৫০০ আলোক বর্ষ
সুতরাং দেখা যাচ্ছে আমাদের নিকটতম ব্রহ্মান্ডের দূরত্ব ১৫৫০০ আলোক বর্ষ । এভাবে আমরা যদি পাশাপাশি দুইটি ব্রহ্মান্ডের কথা বিবেচনা করি তাহা হলে দেখা যায় ১৫৫০০ আলোক বর্ষ দূরত্বের মধ্যে দুটি আগুনের স্তর বা আবরণ রহিয়াছে যাহার প্রতিটি ৪০,০০০ কোটি মাইল করে বিস্তূত, ব্রহ্মান্ডের এই সকল জ্বলন্ত আবরণকে বিজ্ঞানীরা জ্বলন্ত নক্ষত্র বলে মনে করছে । ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে প্রত্যেকটি ব্রহ্মান্ডে ১(এক) টি করে সূর্য রয়েছে, সেজন্য দুইটি ব্রহ্মান্ডে ২(দুই) টি সূর্য আছে কিন্তু বিজ্ঞানীরা ব্রহ্মান্ডের এই আগুনের আবরণকে জ্বলন্ত নক্ষত্র বা সূর্যের মত পদার্থ বলে ভুল করছে । বিজ্ঞানীদের হিসাবে দুইটি ব্রহ্মান্ডে ৪(চার) টি সূর্য হয়ে যায় । আমাদের ব্রহ্মান্ডের চেয়ে কোটি কোটি গুণ বড় ব্রহ্মান্ড রয়েছে সে সকল ব্রহ্মান্ডের আগুনের আবরণ কোটি কোটি গুণ বড় হইবে । সেগুলিকে কোটি কোটি গুণ বড় নক্ষত্র বলে মনে হবে ।
চার।
আন্তঃনাক্ষত্রিক মহাজাগতিক পদার্থ (Interstellar Galactic Material) ----
দুইটি নক্ষত্র বা ছায়াপথের (Milky Way) মাঝে বিজ্ঞানীরা বিশাল বিশাল জায়গা শূন্যস্থান দেখতে পাইতেছেন । এ জায়গাগুলি ধূলিবালিসহ বিভিন্ন তরল ও গ্যাসীয় পদার্থ দ্বারা ভর্তি, বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, দুইটি ছায়াপথের মাঝের আয়তন এত বেশী যাহা ছায়াপথ বা নক্ষত্রের নিজের আয়তন থেকে অনেক বেশী । এই জন্য Interstellar Galactic Material কে তাহারা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছেন ।
বিজ্ঞানীরা যাহাকে আন্তঃনাক্ষত্র্রিক মহাজাগতিক পদার্থ বলছে ভাগবতের বর্ণনা অনুসারে সেটা হল ব্রহ্মান্ডের আবরণ এই আবরণ জল, আগুন, বায়ু, আকাশ (ইথার), মহতত্ত্ব ইত্যাদি দ্বারা গঠিত । সেজন্য ইহাকে ধূলাবালি পূর্ণ অসম বলিয়া মনে হয় । ব্রহ্মান্ডের আবরণের দৈর্ঘ্য উক্ত ব্রহ্মান্ডের ব্যাসের ১ কোটি ১১ লক্ষ গুণ বড় । সুতরাং ব্রহ্মান্ডের নিজস্ব আয়তন থেকে আবরন অনেক বড়, সেটাই বিজ্ঞানীরা প্রতিপন্ন করেছেন । তারা বলছেন আন্তঃনক্ষত্রিক জাগতিক পদার্থের পরিমান অনেক বেশি ।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আদিম মহাবিশ্ব সম্ভবত অত্যন্ত বিশৃংঙ্খলা এবং নিয়ম বিহীন অবস্থায় ছিল । বিজ্ঞানী সমাজের ধারনা মহাবিশ্ব যদি সত্যিই স্থানিকভাবে অসীম হয় কিংবা মহাবিশ্বগুলির সংখ্যা যদি অনন্ত হয় তা হলে সম্ভবত কোন স্থানে এমন কতগুলি বৃহৎ অঞ্চল থাকবে যেগুলো হয়েছিল মসৃণ-সমরূপভাবে ।
ব্যাপারটা অনেকটা সেই বহূ পরিচিত বাঁদরের বিরাট দলের মত । তাহারা টাইপরাইটারের আঙ্গুল ঠুকিয়ে চলিয়াছে – যাহা ছাপা হচ্ছে তাহার বেশির ভাগটাই ভূষিমাল কিন্তু দৈবাৎ তারা শেক্সপিয়ারের একটি সনেটও টাইপ করিয়া ফেলিতে পারে । তেমনিভাবে মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে এমন কি হতে পারে যে আমরা এমন একটি অঞ্চলে রয়েছি যেটা ঘটনাচক্রে মসৃন এবং নিয়মবদ্ধ ? আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপারটি খুবই অসম্ভব মনে হতে পারে কারণ ওই রকম মসৃণ অঞ্চলের চাইতে বিশৃঙ্খল এবং নিয়মবিহীন অঞ্চলের সংখ্যা অনেক বেশি । কিন্তু যদি অনুমান করা যায় মসৃন অঞ্চলগুলিতেই নীহারিকা এবং তাঁরকা গঠিত হয়েছে এবং এই সমস্ত অঞ্চলেই আমাদের মত আত্মজ (self replicating) সৃষ্টি করিতে সক্ষম জটিল জীব বিকাশের মতো সঠিক পরিস্থিতি রয়েছে এবং এই জীবরাই প্রশ্ন করতে সক্ষম মহাবিশ্ব এরকম মসৃণ কেন ? এটা হইল যাহাকে নরত্বীয় নীতি (anthropic princple) বা মানবতত্ত্ব নীতি বলে ।
বিজ্ঞানীরা এই আলোচনা থেকে প্রতিপন্ন করা যায় মহাবিশ্ব যদি অসীম হয় এবং ব্রহ্মান্ডের সংখ্যা অনন্ত হয় তা হলে বৃহৎ বৃহৎ মসৃণ সমরূপ অঞ্চল থাকবে । বিজ্ঞানীদের এই মতবাদের সাথে ভাগবত একমত । কারণ ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে ব্রহ্মান্ডের সংখ্যা অনন্ত কোটি এবং প্র্রত্যেকটি ব্রহ্মান্ডে গ্রহ নক্ষত্র সজ্জিত সুশৃঙ্খল সৌর পরিবার রয়েছে । প্রতিটি ব্রহ্মান্ডে একটি সূর্য ব্রহ্মান্ডের মাঝখানে অবস্থান করিয়া সম্পূর্ণ ব্রহ্মান্ডকে তাপ ও আলোক প্রদানের মাধ্যমে জীবিত রেখেছে এবং প্রতি ব্রহ্মান্ডে আমাদের চেয়ে অধিক বুদ্ধিমান মানুষসহ ৮৪ লক্ষ প্রজাতির জীব রয়েছে । সুতরাং দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞানীদের এই ধারনার সাথে ভাগবতের মিল আছে ।
এই আলোচনার অন্য অংশে বর্ণনা করা হয়েছে কতগুলি বানর টাইপ করতে করতে ঘটনাচক্রে যেমন শেক্সপিয়ারের একটি সনেট কবিতা টাইপ করতে পারে ঠিক সেইরকম কোন ঘটনা চক্রে এই মহাবিশ্বে মসৃণ অঞ্চলের সৃষ্টি হয়েছে ফলে মানুষের মত বুদ্ধিমান জীবের সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে । ভাগবত এই অংশের তীব্র প্রতিবাদ করয়া বলেছে এই মহাবিশ্বে কোন কিছু ঘটনা চক্রে হঠাৎ ঘটে নাই সকল সৃষ্টির পিছনে সৃষ্টিকর্তার সুনির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রন রহিয়াছে ।
অনন্ত কোটি ব্রহ্মান্ডে সুশৃংঙ্খল সাজানো পরিবেশ রয়েছে
যস্য প্রভা প্রভবতো জগদন্ডকোটিকোটিষবশেষবসুধাদি
তদ্ ব্রহ্ম নিষ্কলমনন্তমেষভূতং গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।।(ব্রহ্ম-সংহিতা ৫/৪০)
অনুবাদ
অনন্তকোটি ব্রহ্মান্ডে অনন্ত বসূধাদি বিভূতির দ্বারা যিনি ভেদপ্রাপ্ত হইয়াছেন, সেই পূর্ণ, নিরবিচ্ছিন্ন এবং অশেষভূত ব্রহ্ম যাঁহার প্রভা, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি ।
অনন্তকোটি ব্রহ্মান্ডের প্রতিটি ব্রহ্মান্ডই বিভিন্ন আকৃতি এবং পরিবেশ সমন্বিত অসংখ্য গ্রহ নক্ষত্রে পূর্ণ । সে সমস্ত প্রকাশিত হয়েছে অনন্ত অদ্বয়-ব্রহ্ম থেকে, যাহা পূর্ণ জ্ঞানে বিরাজমান । সেই অন্তহীন ব্রহ্মজ্যোতির উৎস হচ্ছে, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীগোবিন্দের চিন্ময় দেহ এবং সেই গোবিন্দই আদি পুরুষরূপে বন্দিত হয়েছেন ।
এখানে বর্ণনা করা হয়েছে ব্রহ্মান্ডের সংখ্যা অনন্তকোটি এবং প্রতিটি ব্রহ্মান্ডের সুনির্দিষ্ট সজানো গোছানো সুন্দর পরিবেশ রয়েছে যা জীব বসবাসের উপযুক্ত এবং ব্রহ্মান্ডগুলি ভগবাণের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে । সুতরাং বিজ্ঞানীদের যে ধারনা মহাবিশ্বের মসৃণ অঞ্চল ঘটনাচক্রে সৃষ্টি হয়েছে ভাগবত সেটা সমরর্থন করে না ।। আসলে যে বিষয়টি ঘটছে তা হল একটি ব্রহ্মান্ডের আবরণগুলির দৈর্ঘ্য ইহর ব্যাসের ১ কোটি ১১ লক্ষ গুণ বড় এবং আবরণ আগুন, পানি, বায়ু ইত্যাদি দ্বারা গঠিত । সেজজন্য ইহা অসম, অস্থির, বিশৃংঙ্খল বলিয়া মনে হয় । আমরা যদি বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের কথা বিবেচনা করি তা হলে দেখা যাবে মসৃণ ব্রহ্মান্ডের তুলনায় অমসৃণ জায়গা ১ কোটি ১১ লক্ষ গুণ বেশী । এজন্য বিজ্ঞানীরা এই মহাবিশ্বকে অমসৃন বিশৃংঙ্খল বলিয়া ভাবিতেছেন ।
বিজ্ঞানীরা এ বিশাল পরিমাণ আন্তঃনক্ষত্রিক বস্তু লয়ে গুরুত্ব সহকারে গবেষনা করছেন ।
এ বিষয়ে বিজ্ঞানী বয়চটের অভিমত আন্তঃছায়াপথ বা আন্তঃনাক্ষত্রিক (Interstellar Galactic Material) সংযোগকারী এ সব গ্যাস পিন্ডের বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব অত্যাধিক । কেননা “বিশ্ব সৃষ্টির বিবর্তন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে যে ধারণা এখন চালু রয়েছে” – এসব সংযোগকারী গ্যাসপিন্ড সেই ধারণা বহুলাংশে বদলে দিতে পারে ।
বিজ্ঞানীদের ধারনা বিশ্বসৃষ্টির বিবর্তনে হয়ত এই আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তুর ভূমিকা রয়েছে, সেজন্য তারা এই বস্তুগুলিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছেন । আমি আলোচনার মাধ্যমে প্রমাণ করেছি ভাগবত যাকে ব্রহ্মান্ডের আবরণ বলিতেছে বিজ্ঞানীরা সেটাকে আন্তঃনাক্ষত্রিক পদার্থ বলিতেছেন ।
ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে, ব্রহ্মান্ড কারণ সমুদ্র থেকে বুদবুদের মত সৃষ্টি হয় । প্রতিটি বুদবুদের যে আবরণ সেটাই উক্ত ব্রহ্মান্ডের আবরণ এবং উক্ত বুদবুদের মধ্যে ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি হয় । ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির যাবতীয় উপাদান বুদবুদের আবরণ থেকে আসে অর্থাৎ ব্রহ্মান্ডগুলি ইহার আবরণ থেকে সৃষ্টি হয়েছে । এ জন্য বিজ্ঞানীরা ব্রহ্মান্ডের এই আবরণকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা কররছে । এ বিষয়ে ভাগবতের বক্তব্য
কারণ সমুদ্রে বুদবুদ আকারে ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি
যঃ কারণার্ণবজলে ভজতি স্ম যোগনিদ্রামনন্তজগদন্ডসরোমকূ
আধারশক্তিমবলম্ব্য পরাংস্বমূর্তিং গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।।(ব্রহ্ম-সংহিতা ৫/৪৭)
অনুবাদ
এখানে ব্রহ্মাজি বলেছেন, আমি সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি, যিনি তাঁহার অংশাবতার মহাবিষ্ণুরূপে কারণ-সমুদ্রে যোগনিদ্রায় শায়িত এবং তাঁহার দিব্য শরীরের রোমকূপ থেকে অসংখ্য ব্রহ্মান্ড বুদবুদ আকারে প্রকাশিত হইতেছে ।
এ খানে বর্ণনা করা হয়েছে মহাবিষ্ণু কারণ সমুদ্রে (Causal Ocean) যোগনিদ্রায় শায়িত আছেন । তাঁহার রোমকূপ থেকে অসংখ্য ব্রহ্মান্ড বুদবুদ আকারে প্রকাশিত হইতেছে । এই বুদবুদগুলি পরবর্তীতে এক একটি ব্রহ্মান্ডে পরিণত হয় ।
সুতরাং বিজ্ঞানীরা যদি মনে করেন আন্তঃনাক্ষত্রিক পদার্থ থেকে ব্রহ্মান্ডের বিবর্তন বা সৃষ্টি হয়েছে তহা হলে তাহাদের ধরণা ভাগবতের আলোকে সঠিক ।
No comments:
Post a Comment