ভারতের অভ্যন্তরের বাংলাদেশের ছিটমহলের বাসিন্দারা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই ভারতের নাগরিক হতে মনস্থির করেছে। কেউ বাংলাদেশে আসতে চাচ্ছেনা। হিন্দুরা ভারত যেতে চাইবে সেটা স্বাভাবিক, কিন্তু মুসলমানেরা কেন যাচ্ছেন? কারন ওরাও জানে ভারত মুসলমানদের জন্য যে কোন মুসলিম দেশের চেয়ে অধিক নিরাপদ রাষ্ট্র।
পুয়াতুরকঠির প্রায় শত বছরের প্রবীন রহমান মিয়া। আজ মঙ্গলবার দুপুর ২টায় ক্যাম্পে পৌঁছান। তিনি কোন দেশে যেতে চান- এই প্রশ্ন করেন ভারত-বাংলাদেশের যৌথ গণনাকারি সুপারভাইজার। প্রশ্ন শুনেই ফ্যাল ফ্যাল করে কেদে দেন তিনি। তিনি বলেন, আমি এই দেশেই মরতে চাই। যে দেশে জন্মেছি সেই দেশই আমার দেশ। শুধু প্রবীণ এই রহমান আলি নন, পুয়াতুরকঠির সজল বিশ্বাস, শিবপ্রসাদ-মোস্তাফিজের আব্দুল রহমান, মশালডাঙার আব্বাস উদ্দিন মিয়াও মতো এমন বহু বাংলাদেশি ছিটমহলের বাসিন্দা আজ যৌথ গণনাকারিদের সাফ জানিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশি ছিটমহলের নাগরিক হলেও তারা বাংলাদেশের মূল ভুখণ্ডে বাংলাদেশি হয়ে থাকতে রাজি নন।
ভারত বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির দাবি, ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশি ছিটমহলের ১৪ হাজার ২১৫ জনের (সর্বশেষ জনগণনা অনুসারে) মধ্যে একজনও বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে 'বাংলাদেশি' হয়ে ফিরতে রাজি হবেন না। যদিও বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে ভারতীয় ছিটমহলের মধ্যে ২২৩টি পরিবারের এক হাজার ৫৭ জন ভারতের মূল ভূখণ্ডে আসতে চেয়েছেন। বাংলাদেশে ভারতের ছিমহলে ৩৭ হাজার ৩৬৯ জন বাসিন্দা রয়েছেন। ২০১৪-১৫ এই দুই বছর সমীক্ষা চালিয়ে এমন তথ্যই পেয়েছে বলে জানিয়েছেন সমন্বয় কমিটির নেতারা।
আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সমন্বয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক দীপ্তমান সেনগুপ্ত কালের কন্ঠকে এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন। শুধু তাই নয়, গত দিনে এমন একজনও বাংলাদেশে যাবেন- এই তথ্য দিয়ে নাম নথিভুক্ত করেননি বলেও কোচবিহারের জেলা শাসক পি উলাঙ্গানাথক স্বীকার করেন।
২০১১ সালে সর্বশেষ ছিটমহলের জনগণনার পর আবার গত ৬ জুলাই থেকে নতুন গণনা শুরু হয়েছে। প্রথম দিনে গতকাল সোমবার ১৭ শতাংশ এবং দ্বিতীয় দিনে আজ মঙ্গলবার ১৫ শতাংশ মানুষ তাদের নাম নথিভুক্ত করেছে। সেই সঙ্গে তারা সবাই ভারতেই থাকতে চাইছেন, সেটি তারা দুই দেশের কর্মকর্তাদের সাক্ষাতকারে নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে ২০১১ সালে জুলাই মাসের পরিচালিত জনগণনার চেয়ে এইবার ১৪ শতাংশ জনগোষ্ঠী বৃদ্ধি পাবে বলে দাবি করেছেন ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত। তিনি বলেন, সম্প্রতি তারা একটি জরিপ জালিয়ে দেখেছে নতুন শিশু জন্ম হওয়া এবং বিয়ে করে ছিটের মানুষ হিসাবে অন্তর্ভক্ত হওয়া মানুষের সংখ্যা ১৪ শতাংশের বেশি নয়।
দীপ্তিমান সেনগুপ্ত জানান, আমরা গত দুই বছর ধরে ১৬২ টি ছিটমহলে সার্ভে করেছি। ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ছিটমহলের কোনও বাসিন্দাই বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে ফিরতে রাজি হননি। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের মূলভূখণ্ডে ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দাদের মধ্যে সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী ২২৩ টি পরিবারের ৫৭৩ জন পুরুষ এবং ৪৮৪ জন মহিলা সহ মোট ১০৫৭ জন ভারতের মূলভূখণ্ডে ফিরতে চাইছেন। যদিও তিনি এও যোগ করেন, এই পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের পঞ্চগড়, লালমণিরহাট এবং নীলফামারি জেলা যোগ হলেও কুড়িগ্রামের ছিটমহল গুলোর পরিসংখ্যানটি এখানে সংযোগ করা হয়নি। সেটির কাজ চলছে। চুড়ান্ত হলে সরকারের কাছে তাদের এই পরিসংখ্যান তুলে দেওয়া হবে বলেও জানান দীর্ঘ দিন ধরে ছিটমহল বিনিময় আন্দোলনে যুক্ত ওই শীর্ষ নেতা।
কেন ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশি ছিটমহল গুলোর বাসিন্দারা বাংলাদেশের মূলভূখণ্ডে ফিরতে চান না সেই প্রশ্নের উত্তরে পুয়াতুরকুঁটি, মশালডাঙা বাংলাদেশি ছিটের বাসিন্দা আইনুল শেখ, সামসুল হক মিয়া, করিম শেখ যুক্তিদিয়ে বোঝান ভারত একটি অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সব এই দেশটির প্রায় সব খাত বাংলাদেশ থেকে উন্নত। আগামী প্রজন্মের কথা চিন্তা করেই তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলেও জানান। পুয়াতুরকঠির পরেশ চন্দ্র বর্মণ কিংবা শতবছরের প্রবীণ রহমান আলি মিয়ার ভাষায়, আমাদের ছেলে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে আত্মীয়তার বন্ধনে বহু ভারতীয় বাসিন্দার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি। বসত ভিটে ছেড়ে যাওয়ার কোনও ইচ্ছাই নেই আমাদের।
ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত এই প্রসঙ্গে প্রতিবেদককে জানান, ভারতের বাংলাদেশের ছিটমহলের বাসিন্দারা বরাবরই ভারতীয় হওয়ার দাবি তুলে আসছিল। এবার সেই সুযোগ তারা পেয়েছেন। ফলে তারা সবাই ভারতে থেকে যেতে চাইছেন।
তবে, ৬ জুলাই থেকে ১৬ জুলাই ১০ দিন ব্যাপী ভারতের অভ্যন্তরে ৫১ টি বাংলাদেশি এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১১১ টি ছিটমহলে চুড়ান্ত জনগণনা চলবে। ভারত-বাংলাদেশ সরকারের যৌথ প্রতিনিধি দল জনগণনা চুড়ান্ত করার পাশাপাশি কে কোন দেশের নাগরিক হিসাবে থাকতে চাইছেন সেটির সিদ্ধান্তও গ্রহণ করবে।
১০ দিন পর চুড়ান্তভাবে জানা যাবে ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ১৪ হাজার ২১৫ জন বাংলাদেশি ছিটমহলের এবং বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ৩৭ হাজার ৩৬৯ জন ভারতীয় ছিটের বাসিন্দার মধ্যে কে কোন দেশে আসতে-যেতে চাইছেন। সেই তালিকা চুড়ান্ত করে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে স্ব-স্ব স্থানে পূর্ণবাসনের ব্যবস্থা করবে ভারত ও বাংলাদেশ সরকার।
কোচবিহার জেলার দিনহাটা, মাথাভাঙা এবং মেখলিগঞ্জের তিনটি অস্থায়ী ক্যাম্পে বাংলাদেশ থেকে আসা ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দাদের রাখা হবে। প্রত্যেক পরিবার দুই বছরের জন্য ২শ বর্গফুটের জায়গায় টিনের চালার বাড়ি পাবেন। তিনটি সীমান্ত দিয়ে এদের ভারতে আনা হবে। সীমান্ত গুলোতে তাদের বায়োমেট্রিক ব্যবস্থায় ছবি, আঙুলের ছাপ রাখা হবে। একই সঙ্গে তাদের টিকাকরণের কাজটিও সীমান্তেই সম্পন্ন করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কোচবিহারের জেলাশাসক পি উলগানাথন জানিয়েছেন, ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়ে ইচ্ছুকদের পাকাপাকি চলে আসতে হবে। ৩১ জুলাই মধ্যরাত থেকেই ভারতের আর বাংলাদেশের কোনও ছিটের অস্তিত্ব থাকবে না। অন্যদিকে বাংলাদেশেও একইভাবে ভারতের আর কোনও জায়গা থাকবে না।
No comments:
Post a Comment