সমদর্শী - শ্রীশ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী
- গৌরমোহন দাস
পরমপুরুষ শ্রীশ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী করুণার শিরোমণি। গ্রামে-গঞ্জে বাবার করুণাধারা নিয়ে অনেকেই পথ চলছেন। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (১০/৪১) স্পষ্ট করে বলেছেন Ñ
যদ্ যদ্ বিভূতিমৎ সত্ত্বং শ্রীমদূর্জিতমেব বা ।
তত্তদেবাবগচ্ছ ত্বং মম তেজোহংশসম্ভবম ॥
অর্থাৎ যে মানুষের মধ্যে অদ্ভুত আধ্যাত্মিক শক্তির প্রকাশ হয় জানিও সেখানে আমি বর্তমান; আমা হতেই এই আধ্যাত্মিক শক্তির প্রকাশ হয়ে থাকে। তেমনি ধারায় রামকানাই ঘোষাল ও কমলাময়ীর কোল আলো করে জন্ম নিলেন শ্রীশ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী। ধ্যান-তপস্যা-আরাধনায় সিদ্ধি লাভ করে মানব কল্যাণে নিয়োজিত হয়ে তিনি হলেন পরমপুরুষ। হৃদয়ের সবটুকু ভালবাসায় আন্তরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করি Ñ মহাশক্তিধর ত্রিকালদর্শী শ্রীশ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবার রাতুল চরণে।
মানুষ অভ্যাসের দাস। অভ্যাস ছাড়া ভাল কিছু অর্জন করা যায় না। ঈশ্বরের নাম নিতে হলেও অভ্যাস প্রয়োজন। প্রয়োজন বিশ্বাস, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার। কারো কারো মনে বদ্ধ ধারণা মৃত্যুকালে ঈশ্বরের নাম নিলেই ধর্ম-কর্ম হয়ে যায়। কিন্তু সে ধারণা মোটেও ঠিক নয়। নাম নিতে হলে পূর্ব থেকে ঐ নামের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসায় অভ্যাস করতে হবে। সচরাচর আমরা ঈশ্বরের নাম মুখে না নিলেও বিপদে পড়লে ইষ্ট দেবতা বা কল্যাণকারী দেবতার জপ বা স্মরণ করে থাকি। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই আছেন যারা ঈশ্বরের নাম নিতে মনে মনে বা মুখে উচ্চারিত করেন Ñ জয় বাবা লোকনাথ, জয় বাবা লোকনাথ, আমাকে রা কর। প্রিয় পাঠক কথাটার যুৎসই উত্তর দিবে আপনার অন্তর আত্মাই। আর বাবার পবিত্র নাম মুখে আসবেই না কেন! তিনি যে লোকের নাথ (রক) লোকনাথ। বাবার বাল্যনাম ছিল লোকনাথ ঘোষাল। পরবর্তীতে তিনি ব্রহ্মাকে জানার আচরণ ও বীর্য রা করেছেন বলে তাঁর নামের সাথে ‘ব্রহ্মচারী’ যুক্ত হয়। বাবার জীবনাচরণ থেকে নামের সার্থকতা জানা যায়।
বাবা লোকনাথ, ‘রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে যখনই বিপদে পড়িবে আমাকে স্মরণ করিও- আমিই রা করিব।’ মহাঅভয়বাণী দিয়েছেন। ধর্মমতাবলম্বী অনেকেই আছেন যারা বাবার ঐ বাণীকে যথাযথ মনে করছেন না। সে বিষয়ে আমি সবিনয়ে জানাতে চাই, মানব জীবনের স্বার্থকতা মনুষ্যত্ব অর্জন ও ঈশ্বরত্ব লাভ করা। লোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবা নক্তব্রত, একান্তরা, ত্রিরাত্রি, পঞ্চাহ, নবরাত্রি, দ্বাদশাহ, পাহ ও মাসাহব্রত পালনসহ দীর্ঘ ৯০ বছর বরফের ওপর কঠোর তপস্যা করে ঐশ্বরিক শক্তি লাভ করেছিলেন। সাধনকালে বাবা লোকনাথ বলেছিলেন Ñ ‘আমি বহু পাহাড়, পর্বত ঘুরেছি কিন্তু ব্রাহ্মণ দেখলাম তিনজন। মক্কায় আব্দুল গফুর, ভারতে ত্রৈলঙ্গস্বামী এবং আমি নিজেকে।’ কথাটি খুবই অর্থবহ। আমাদের ধর্মগ্রন্থে আছে ‘আত্মানাং বিদ্ধি’। গ্রীস ঋষিদের উক্তি কঘঙড ঞঐণঝঊখঋ. পরবর্তীকালে লালন ফকিরও বলেগেছেন ‘আপনারে চিনতে পারলে যাবে অচেনারে চেনা।’ বাবা লোকনাথ চিনেছেন নিজেকে। আর কেউ যদি তার নিজেকে চিনতে পারে তা হলেই সব চেনা হয়ে যায়। অন্যের দোষ ত্র“টি দেখে না বা দেখতে পারে না। আমরা (সাধারণ মানুষ) নিজেকে চিনতে পারি না বলেই অপরের দোষ ত্র“টি ধরতে ওস্তাদ। বিপত্তি এ কারণেই। সারদা দেবী বলেছেন ‘অন্যের দোষ দেখো না, দোষ দেখ নিজের’। এমন হলেই মঙ্গল হতো। বাবা লোকনাথ চিনেছেন নিজেকে। বাবা লোকনাথ নিজেকে চিনেছেন বলেই সাধনাও সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। শ্রীগীতায় শ্রীকৃষ্ণ দিব্যদৃষ্টি দিয়ে তাঁর নিজ অঙ্গে অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন। আর বাবা লোকনাথও তাঁর লীলা মাধুরীতে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী দেখিয়েছিলেন অপরূপ লীলা। যাতে করে বাবার সারা শরীরে, প্রতি লোমকূপে, ঘরের সর্বত্র এমনকি গায়ের কাপড়েও দেব দেবীকে দেখতে পেয়েছিলেন শ্রী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী। ঈশ্বরের আবির্ভাব বিষয়ে উপরে বর্ণিত শ্রীগীতার কথাও প্রমাণ করে বা চিনতে সহায়ক শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে এ-ই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। সুতরাং বাবা নিশ্চয়ই ‘রণে বনে জলে জঙ্গলে . . . . ’ মহাবাণী বলতে পারেন বা বলেছেন।
আমি প্রথমে বাবাকে করুণার শিরোমণি বলেছি। কথাটির যথার্থ প্রমাণ বাবার জীবনীতে রয়েছে। বাবার করুণা পেয়েছেন শ্রী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, রাধাকান্ত নাগ, ডেঙ্গু কর্মকার, ভাওয়াল রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ রায়, গোয়ালিনী মা, ব্রহ্মানন্দ ভারতী, রজনী ব্রহ্মচারী, জানকীনাথ ব্রহ্মচারী, ডা. নিশিকান্ত বসু, রাধিকামোহন রায়, মথুরামোহন মুখোপাধ্যায়, সুরথনাথ ব্রহ্মচারী প্রমুখসহ বহু রোগাগ্রস্থকে রা করেছেন তাঁর করুণা দিয়ে। শুধু তাই নয় পশুপাখিদের প্রতিও সমদর্শী ছিলেন। তাদের ভাষাও তিনি বুঝতেন। হিংসাবৃত্তি স্থির থাকার জন্য বাবা লোকনাথ বাঘ, সাপ প্রভৃতি হিংস্র প্রাণিদের সাথেও অদ্ভুত বন্ধুত্ব হয়। ষাঁড়, শুয়োর, কুকুর এমন কি পিঁপড়ার প্রতিও ছিল বাবার অসীম করুণা। প্রাণিকুলের প্রতি বাবার মমতায় পবিত্র গীতার ( ৫/১৮) কথাটি বারবার মনে পড়ে Ñ
বিদ্যাবিনয় সম্পন্নে ব্রাহ্মণে গবি হস্তিনী।
শুনি চৈব শ্বপাকে চ পণ্ডিতা সমদর্শিন ॥
অর্থাৎ জ্ঞানী, পণ্ডিতেরা বিদ্যাবিনয় সম্পন্ন ব্রাহ্মণ, গাভী, হাতি, কুকুর ও চণ্ডাল সকলের প্রতি সমদর্শী হন।
উপনিষদে আছে Ñ ‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’ অর্থাৎ সবকিছু ব্রহ্মময়। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার মর্মবাণী Ñ ‘জ্ঞানে, প্রেমে ও কর্মে সকল প্রাণির প্রতি সমদর্শী ও প্রীতিমান হওয়া। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন Ñ ‘ঈশ্বর সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জুন তিষ্ঠতি। অর্থাৎ ঈশ্বর সকল প্রাণির হৃদয়ে অবস্থান করেন (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-১৮/৬১)।’ শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলেছেন Ñ ‘ঈশ্বর সব মানুষে আছেন কিন্তু সব মানুষে ঈশ্বর নেই।’ মানুষের মাঝে ঈশ্বর আছেন কিন্তু কোন মানুষই সেই ঈশ্বরের সন্ধান করেন না বা ঈশ্বর যে তার মধ্যে আছেন সে কথাও বিশ্বাস করেন না। এই অজ্ঞতার কারণেই এত হিংসা-বিবাদ, দলাদলি, চুরি-ডাকাতি আর নির্যাতন। উপর্যুক্ত কথা ভালভাবে উপলব্ধি করলে হিংসা-বিদ্বেষ, খুনাখুনি থাকতো না। ভালোবাসায় পূর্ণ হতো এ সুন্দর ধরা।
শ্রীশ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবার কাছে উঁচু-নীচু, ছোট-বড় বলে কোনো ভেদাভেদ ছিল না, ছিল অপার করুণা। ভালোবেসেছেন সবাইকে। তাঁর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ‘দীন-দরিদ্র অসহায় মানুষের হাতে যখন যা দিবি তা আমিই পাব; আমিই গ্রহণ করব’ কথায় সুস্পষ্ট। একবার কয়েকজন ব্রাহ্মণ পৈতার পাঁক খুলতে পারছিল না। এমনি সময় ব্রাহ্মণদের পাশে শ্রীশ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবা যখন গেলেন তখন তারা তাঁকে অস্পৃৃশ্য, উন্মাদ মনে করে বলেছিল Ñ ‘আমরা পৈতায় গ্রন্থি’ দিতেছি। আমাদেরকে স্পর্শ করবি না।’ বাবা লোকনাথ হেসে বললেন Ñ ‘কেন? স্পর্শ করলে কি তোমাদের জাত যাইবে?’ অবশ্য শেষে বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীই ব্রহ্মগায়ত্রী মন্ত্র জপ করে দুই হাতে তালি দিয়ে পৈতার পাঁক খুলে দিয়েছিলেন। কথাটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আজকের বৈজ্ঞানিক যুগেও অনেকে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন! জাত যাবার ভয়ে মগ্ন !! কেউবা উঁচু-নীচু ভাবনায় নিমগ্ন!!! বাবার কাছে জাত-পাত কিছুই ছিল না। কিন্তু আমরা কি বাবার আদর্শের শিা নিয়েছি? তিনি বলেছিলেন Ñ ‘‘মুসলমান কথাটি এসেছে ‘মুছল্লাম ঈমান’ কথা থেকে। এর অর্থ হলো ষোল আনা ধর্ম আছে যার মধ্যে সেই মুসলমান। আমাতে ষোল আনা ধর্ম প্রতিষ্ঠিত। তাই আমি মুসলমান।” বাবা লোকনাথ পদব্রজে এবং যোগবলে বিশ্ব পরিভ্রমণে ইসলাম ধর্মের পীঠস্থান মক্কা, মদীনা প্রভৃতি স্থান ভ্রমণ ও পবিত্র কোরআন অধ্যয়ন করে তিনি ঐ কথা বলেছিলেন। উল্লেখ্য যে, বাবার পদব্রজে ভ্রমণের কথা স্মরণে রেখেই শ্রীশ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রম ও মন্দির, ঢাকার ভক্তগণ নামকীর্তন ও বাবার জয়ধ্বনিযোগে পদব্রজে বাবার বারদী মন্দিরে যায়।
মোট কথা Ñ আপনি যত উঁচু স্তরে ওঠবেন নিচে তাকালে আপনার উঁচু-নিচু দৃষ্টি কমতে থাকবে। যখন বেশি উঁচুতে ওঠে নিচে তাকাবেন Ñ দেখবেন সব সমান লাগে। বাবা লোকনাথ সে উঁচু স্তরের ছিলেন বলে কোথাও উঁচু-নিচু ভেদাভেদ ছিল না। ছিল সমদর্শী ভাব। তাই আসুন বাবার তিরোধান মহোৎসবে (১৯ জ্যৈষ্ঠ) আমরাও নিচের পবিত্র বেদমন্ত্র পড়ে হিংসা-বিবাদ, দলাদলি ভুলে একত্রিত হই এবং সকলের দুঃখে হই সমবেত।
সংগচ্ছধ্বং সংবদধ্বং সং বো মনাংসি জানতাম্।
দেবা ভাগং যথা পূর্বে সং জানানা উপাসতে ॥
সমানো মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী সমানাং মন সহ চিত্তমেষাম্।
সমানাং মন্ত্রমভিমন্ত্রয়ে বঃ সমানেন বো হবিষা জুহোসি ॥
(ঋগে¦দ ১০/১৯১-২-৩)
অর্থাৎ তোমরা সকলে একসঙ্গে চল। এক চিন্তুাধারায় সèাত হয়ে সবে এক সঙ্গে বল। সকলে জান সবার মনকে। ভালবাস সবাইকে। সকলের মন্ত্র, সংকল্প ও মন এক হোক, এক হোক, এক হোক। জয় বাবা লোকনাথ।
(লেখক : ধর্মীয় গবেষক ও চিন্তাবিধ এবং দফতর সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু সমাজ সংস্কার সমিতি, ঢাকা)।
No comments:
Post a Comment