মুশফিকুর রহমান তুষার
সূত্র
সূত্র
শিরোনামের বাক্যটা আমার এক বন্ধুর বাবা’র কাছ থেকে শোনা। একটি আর্থিক লেনদেনের ব্যাপারে আরেক আংকেলের “ডিসকোয়ালিফিকেশন” এর কারন তিনি হিন্দু। এইদেশে হিন্দুদের বিরুদ্ধে এমন বিষেদগার করেনা কিংবা মনে মনে এমন ভাবেনা, লোকের সংখ্যা অনেক কম। কিন্তু এমন কথা শুনেনাই এরকম লোকের সংখ্যা শূন্য। কেন এই বিদ্বেষ? এই বিদ্বেষের দুইটি কারন পাওয়া যায়।
একনম্বর বা প্রধাণ কারন আমাদের দেশের অধিকাংশ (প্রায় ৮৯%) মানুষ মুসলিম। হিন্দুরা আমাদের দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। আমাদের দেশের মুসলিমদের মধ্যে হিন্দুদের নীচু ভাবার একটা প্রবণতা আছে। আবার হিন্দু অধ্যুষিত দেশে মুসলিমদের বিরুদ্ধেও এমন মনোভাব দেখা যায়। ধর্ম আমাদের নানাভাবে এই মনোভাবের শিক্ষা দেয়। পৃথিবীর অনেক স্থানেই ধর্মের কারনে এমন “বর্ণপ্রথা” চালু আছে। আমি আমাদের দেশের পরিস্থিতিই বলি। বাংলাদেশে যারা মাদ্রাসা কিংবা পারিবাহিক সংস্কৃতির কারনে কোরআন-সুন্নাহ ভালোভাবে আয়ত্ব করেছেন তাদের মাধ্যমেই মূলত এই ধ্যান-ধারনার উদ্ভব। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয়ে আজকের এই “বিষবৃক্ষ” ডালপালা মেলেছে। ভাসা-ভাসা জ্ঞান নিয়ে, বিশেষত “বিদায় হজ্বের ভাষণ” পড়ে আমরা অনেকে ভাবি ইসলাম হয়তো অন্য ধর্মের প্রতি অত্যন্ত সহনশীল। আসলে ব্যপারটা মোটেও তা নয়। যেমনঃ পবিত্র কোরআনের দীর্ঘতম সুরা বাকারা’র ১৯১ ও ১৯৩ নং আয়াতে বলা হয়;
আর তাদেরকে হত্যা করো যেখানে পাও সেখানেই এবং তাদেরকে বের করে দাও সেখান থেকে… (আল কোরআন, ২ : ১৯১)
আর তোমরা তাদের সাথে লড়াই করো, যে পর্যন্ত না ফেতনার অবসান হয় এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়। (আল কোরআন, ২ : ১৯৩)
যেখানে হত্যার কথা বলা হয়েছে সেখানে বিরুপ মনোভাব পোষণ করা তো খুব সাধারণ অপরাধ। তবে ১৯১ নং আয়াতের সম্পর্কে অনেকে বলে থাকেন এখানে “যেখানে পাও” বলতে “যুদ্ধের ময়দানে যেখানে পাও” বোঝানো হয়েছে। সেই ব্যাখ্যাও যদি মেনে নিই তবেও প্রশ্ন থাকে, শুধু ধর্ম আলাদা এই জন্য কেন যুদ্ধ করতে হবে? রক্ত-মাংসের মানুষ মহাত্মা গান্ধী যেখানে অহিংসা’র কথা বলেছেন, “রাহমানির রাহীম” কেন এই ধ্বংসাত্মক পদ্ধতি’র কথা বলছেন? ১৯৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যা অনেক মাওলানা এভাবে দেন যে এখানে লড়াই বলতে অমুসলিমদের মুসলিমে রূপান্তরের চেস্টা বোঝানো হয়েছে। কিন্তু এই ব্যাখ্যা মেনে নিলেও তা কিন্তু বিদায় হজ্বের “ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করবেনা। যার যার ধর্ম সে সে পালণ করবে। অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর তোমার ধর্ম চাপিয়ে দেবেনা ” ধারনাকে সমর্থন করেনা।
আজকাল একটি নতুন “ইসলামী কর্পোরেট কালচার” বা “অর্ধ ইসলাম ব্যবস্থা” চালু হয়েছে। এই কালচারে অভ্যস্ত মুসলিমরা ইসলাম কে একটু সরলায়ন করেছেন। যেমনঃ মেয়েদের আগাগোড়া পর্দা করার দরকার নাই। তবে শালীনভাবে শাড়ী বা সালোয়ার কামিজ পড়তে হবে। এরা অন্য ধর্মের বন্ধুদের সাথে তাদের আচার-অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। তারা ধর্মের চেয়ে মানবতা বড় টাইপ বুলি আওড়ান। এরা সাধারণত দিনে এক ওয়াক্ত (তাও খুব সকালের ফযর বা লম্বা এশা’র নামজ নয়) নামাজ পড়েন, শুক্রবার দুপুরে-শবে বরাত-শবে মেরাজের রাতে খুব গম্ভীরমুখে নামাজ পড়তে যান। জাকির নায়েক-হারুন ইয়াহিয়া’দের সম্পর্কে বিরুপ মনোভাব পোষণ করেন।তাদের সবকথার এক কথা ইসলাম আসলে খুবই শান্তির ধর্ম। কিন্তু আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে মেনে চলতে হবে। “আধুনিক” মানে কিছু আইন কেটে ফেলতে হবে। সবশেষে “ধর্মীয় মৌলবাদ”কে ইসলামের মূল শত্রু হিসাবে আখ্যা দিয়ে থাকেন। তবে তাদের আমি একটা কারনে ধন্যবাদ দিতে চাই কারন তারা সাধারণত অন্য ধর্মাবলম্বীদের ঘৃণা করেন না। কিন্ত অর্ধেক ইসলাম মেনে চললে কি মুসলিম বলা যায়?? এরা কোনো “সাচ্চা মুসলমান” ইসলামের আইন মেনে সমাজের চোখে কোনো ঘৃন্য কাজ (যেমনঃ হিন্দুদের মালাউন বলা, তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে বিদ্রূপ করা, হিন্দু মেয়েদের “গণিমতের মাল” আখ্যা দেয়া) করলে তাদের “মৌলবাদী” আখ্যা দেয়। বলে গুটিকয় পথভ্রষ্ট “কট্টর” মুসলিমের জন্য পুরো ইসলামকে দোষারোপ করা ঠিক না।
কিন্তু ব্যাপারটা আসলে তা নয়। একদিন এক লোকের ফেসবুক স্ট্যাটাস (আমার পরিচিত নয়; কিন্তু আমার এক বন্ধুর ফেসবুক বন্ধু) এ দেখলাম তিনি তার সকল “মুসলিম” বন্ধুকে “শুভ সকাল” জানিয়েছেন। অনেক কর্পোরেট মুসলিমরা নিচে কমেন্ট করলো……“শুধু মুসলিম কেন? সবাইকে জানান” বা “এমন কথা তো ইসলামে নাই যে অমুসলিমরা বন্ধু হতে পারবেনা।”, এছাড়াও “আপনাদের জন্যই মানুষ ইসলামকে খারাপ বলে”। এরপর আমি এই বিষয়ে একটু পড়াশোনা করে দেখলাম ঐ “মুসলিম শুভাকাঙ্খী”কে দোষ দেয়া যায়না। পবিত্র কোরআনে আছে,
হে মুমিনগণ! তোমরা ইহুদি ও খ্রীষ্টানদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদের (ইহুদি ও খ্রীষ্টানদের) অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ যালিমদের পথ দেখান না। (আল কোরআন, ৫ : ৫১)
এই আয়াতে তাও দুই ধর্মের কথা আছে। সুরা আল-ইমরান’এর ২৮ নং আয়াতে একবারে সকল ধর্মকেই বন্ধুত্বের জন্য বাতিল ঘোষণা করা হয় এই বলে…
মুমিনগণ যেন মুমিন ব্যাতিরেকে অন্য কোনো অমুসলিমকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যারা এমন করবে আল্লাহর সাথে তাদের কোন সম্পর্ক থাকবেনা। (আল কোরআন, ৩ : ২৮)
এখন পাঠকদের কাছে প্রশ্ন যে, ঐ লোক কি ভুল কিছু করেছেন? অমুসলিমদের কে “শুভ সকাল” জানালে তো ব্যাটা’র ধর্মই চলে যাবে!! এইসব আয়াত কোথাও লেখা হলে কর্পোরেট মুসলিমরা প্রথমে যে কথাটি বলে তা হলো “তাফসীর পড়ে দেখ” অথবা “কোরআনে সবকথা সরাসরি বলা হয়নি, এর ব্যাখ্যা হবে……(একটি মনগড়া; অনেক সময় আজগুবি, কিন্তু ইতিবাচক ব্যাখ্যা)…”। এই কমেন্ট করতে ইচ্ছুকদের অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলতে চাই মানুষের মুখে ঝাল না খেয়ে নিজের মুখে খান। নিজেই তাফসীর বা নিজের বিচার-বুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করে দেখুন ইসলাম আসলেই কি অমুসলিমদের ব্যাপারে সহনশীল?
দ্বিতীয় কারনটা হলো আমাদের সমাজে অনেকদিন আগে থেকেই বিধর্মীদের বিরুদ্ধে মনের মধ্যে “বিষ” পোষণ। আমি এমন বলবোনা যে সব হিন্দুরা মুসলিমদের সম্পর্কে মনে খুব ভালো ধারণা পোষণ করেন। এর পিছনেও সেই শতাব্দী প্রাচীণ ধর্ম থেকে পাওয়া “জ্ঞান”। আমাদের দেশের হিন্দুদের বিরুদ্ধে কিছু সাধারণ অভিযোগ উল্লেখ করা যাক।
যেমনঃ হিন্দুরা খুব খারাপ কারন তারা বাংলাদেশকে নয় বরং ভারতকে কে নিজের দেশ ভাবেন।…ভারতকে নিজেদের দেশ ভাবার ব্যাপারটি সবসময় সত্য নয়। আর যদি ভেবেও থাকে তার পিছনে আছে অনেকগুলো কারন। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র দ্বি-জাতি তত্ত্বের (Two-nation Theory) অনু্যায়ী বাংলাদেশ তো আসলেই হিন্দুদের দেশ না। হয়তো এই ধারণা থেকে বাংলাদেশ তৈরী হয়নি, তবে “আদিরূপ” পাকিস্তান কিন্তু এই তত্ত্বেরই ফসল। এছাড়া এমন কিছু নিয়ম আছে যার মাধ্যমে এদেশের হিন্দুরা সবসময় মানসিক কষ্টে থাকতে থাকতে বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসা হারিয়ে ফেলে। ধর্মনিরপেক্ষ এইদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম!! তার মানে কি হিন্দুরা এদেশের মুসলিমদের সমান না? সংবিধানের শুরুতে আছে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম”। একজন হিন্দু বা ভিন্নধর্মী কেন এই সংবিধানকে মেনে নেবে? সরকারী টিভি’তে অধিবেশনের শুরুতে আল কোরআন’এর তেলাওয়াত-তর্জমা হয়; অথচ বাকি ধর্মের ধর্মগ্রন্থের আলোচনা হয় তিনদিনে একবার। আমাদের দেশে বাংলা-ইংরেজী বিষয়গুলো দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত অবশ্যপাঠ্য। এই সরকারী বাংলা বইয়ে কেন “মরূ ভাস্কর” বা হযরত মুহাম্মদ (সা)’এর জীবনীসহ অন্যান্য ইসলামী কাহিনী থাকবে? একটা ক্লাস ফোর’র হিন্দু শিশু তার বাংলা পরীক্ষায় কেন “পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ কে?” প্রশ্নের উত্তরে “হযরত মুহাম্মদ (সা)” উত্তর করবে??? মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রতি সরকারই তাদের মনমত পরিবর্তন করে, কিন্তু “ধর্মনিরপেক্ষ” কোন সরকারই এই গদ্য বা কবিতা গুলো পরিবর্তন করেনা। ঢাকায় আমি এমন কমপক্ষে দশটি স্কুল দেখেছি যেখানে স্কুল পোষাকের একটি জরুরী অংশ টুপি। যদিও হিন্দু ছাত্ররা মাথায় টুপি দেয়না কিন্তু সবসময় তাকে ভাবতে বাধ্য করা হয় সে আলাদা। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলি, স্কুলজীবনে আমিও এমন স্কুলে পড়তাম(আইডিয়াল স্কুল)। সমাবেশে’র জন্য যখন আমরা মাঠে একসাথে দাড়াতাম গুটিকয় হিন্দু ছাত্রদের খুব সহজেই আলাদা করা যেত। কিছু শিক্ষক নামে কলংক (৯০% ক্ষেত্রে হুজুরটাইপ) প্রতিদিনই তাদের অপমান করতো। যেমনঃ “কিরে তুই হিন্দু নাকি? টুপি কই?” বা “তোদের জন্য আলাদা লাইন লাগবে”। ছোটবেলা থেকে এরকম ব্যাবহার পেলে কিভাবে একটি শিশু নিজেকে এদেশের মানুষ ভাববে? কোন ক্ষেত্র আছে যেখানে হিন্দুদের চাপে রাখা হয়না! আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি বরিশালে আমাদের গ্রামে এখনও হিন্দুদের গাছ থেকে ডাব-খেজুর রস চুরি করাটাকে সহজ ও নিরাপদ মনে করা হয় কারন ধরা পড়লে মালিক বেশীকিছু করতে পারবেনা। এমনকি খেলার মাঠেও কোনো হিন্দু কোন দোষ করলে গালি দেওয়া হয় এই বলে যে “যা মালাউনের বাচ্চা…এই দেশ থেকে ভাগ!!”
হিন্দুরা ব্যবসা-বানিজ্য করে এদেশে কিন্তু বাড়ি-ঘর করে ভারতে। টাকা পয়সা জমায় ভারতে।…
এই ব্যাপারটি অনেক ক্ষেত্রে সত্য। আবার এটাও সত্য যে আমদের দেশে বাস করা অনেক হিন্দুদের আত্নীয়-স্বজন দেশভাগ বা একাত্তরে ভারতে চলে গেছেন। ফলে জীবনের শেষদিকে নিজের আপনজনদের কাছে পেতে ভারতে চলে যাবার অনেক ঘটনাও ঘটে থাকে। বাংলাদেশে বসবাস করায় ঝামেলা মনে করে বলেই তারা ভারতে যেতে চায়। এদেশে মুসলিম কেউ কিছু করলে আমরা প্রথমে দেখি তার বাড়ি কোথায়? যদি বরিশাল-নোয়াখালী-চাদপুর-কুমিল্লা হয় তাহলে বলি “বি এন সি সি’র মানুষ খুব খারাপ”। যদি না হয় অন্য কোনো খারাপ গ্রূপে ফেলার চেষ্টা করি। আবার উত্তরবঙ্গের হলে অবাক হয়ে বলি “নর্থবেঙ্গলের লোক তো ভাল হয়, এইটা এরকম ক্যান??”। কিন্তু হিন্দু কেউ অপরাধ করলে আর কোন বাছ-বিচার নেই। সাথে সাথে “মালাউন কা বাচ্চা, কাভি নেহি আচ্ছা”। এরকম মনোভাবের মধ্যে কয়দিন আপনার থাকতে ভাল লাগবে। আদমশুমারী অনুযায়ী ১৯৪১ সালে এদেশের মোট জনসংখ্যার ২৮ ভাগ ছিলো হিন্দু। ভারতভাগ নামক অদ্ভুত ঘটনার পর তা নেমে আসে ২২ ভাগে। পাকিস্তান শাসনামলে ২৩ বছর অত্যাচারের পর তা নেমে আসে ১৩.৫ ভাগে। বিগত বিএনপি-জামাত জোট সরকারের অসহয়নীয় অত্যাচারে তা নেমে আসে ৮ ভাগের কাছাকাছিতে।এমন অনেক মেধাবী ভারতীয় হিন্দু আছেন যারা বর্তমানে সারা বিশ্বে সম্মানিত । অথচ তারা বা তাদের পূর্বপুরুষরা এদেশের অধিবাসী ছিলো। ১৯৭১ এর কথায় এমন অনেক মুসলিম আছে যারা বলে “যুদ্ধের সময় হিন্দুরা ভারতে ভাগছে”। যুদ্ধের সময় প্রায় ৮০ লাখ বা তারও বেশী মুসলিমও “ভারতে ভাগছে”। আর দেশত্যাগ না করার মত অবস্থা কি তখনকার দুই পাকিস্তানের “সাচ্চা মুসলিম”রা রেখেছিলো? এমনকি যুদ্ধের পরও অত্যাচার কিন্তু থামেনি। গুজরাটে’র দাঙ্গায় হিন্দুরা মুসলিম হত্যা করেছে আর এদেশের হিন্দুরা কিছু না করলেও তাদের উপর অত্যাচার চলেছে। আর ২০০১-০২ সালে জামায়াতে ইসলামী নামক নর্দমার কীট-জঘন্য পশুদের নারকীয় তাণ্ডব তো সবকিছুকে হার মানায়। শুধুমাত্র হিন্দু হবার অপরাধে দক্ষিনবঙ্গের জেলাগুলোয় কি হয়নি? খুন-লুন্ঠণ এবং সেইসাথে “খোদাভীরু জেহাদরত মুসলিম”দের সবচেয়ে প্রিয়কর্ম ধর্ষণ, সব মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ওই সময়ের পরিস্থিতি যে কি জঘন্য ছিলো তা বলবার ভাষা নেই। এক হাজারের বেশী ধর্ষ্ণ হয়েছিলো যার মধ্যে শিশু ধর্ষণ বা মা-মেয়ে-পুত্রবধূ কে এক বিছানায় গণধর্ষণের ঘটনাও ছিলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীতে সেই নষ্টসময়ের কিছু পত্রিকা আছে। কেউ চাইলে পড়তে পারে। ওয়াজ-মাহফিলে অনেক হুজুর একটা কথা খুব বলে। কোন সাহাবীদের উদাহরন দিয়ে তারা সুর করে বলেন “দোজখের বর্ণণা শুনে তিনি দুই চোখের পানি ছাইড়া দেন”। লাইব্রেরীতে পত্রিকা পড়বার সময় সেই “দোজখ”এর বর্ণণা শুনেও যে কেউ দুই চোখের পানি ছেড়ে দেবেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) ও কাফেরদের অত্যাচারে হিযরত করছিলেন, আর হিন্দুরা মুসলিমদের অত্যাচারে দেশ ছাড়লে হয় দোষ। ভারতে কেউ শখে যায়না (কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদে)। আর এমনও না যে ভারত সরকার এদেশের হিন্দুদের খুব সাদরে আপ্যায়ন করে নেয়।
ব্যাক্তিগত ও ধর্মগত আক্রমনঃ
আরো কিছু খারাপ অভ্যাস শোনা যায়। যেমনঃ হিন্দুরা শুধু নিজেদের ভালো করে। হিন্দুরা কখনও মুসলিমকে সাহায্য করেনা। এই কিছুদিন আগে সুরঞ্জিত সেন দুর্নীতির দায়ে ধরা পড়ার পর দেখা গেলো তার মন্ত্রনালয়ে মন্ত্রী কতৃক সরাসরি নিয়োগ পাওয়া সকলেই হিন্দু। এরপর অনেকে বলতে শুরু করলো “দেখলা তো, হিন্দুরা খালি নিজেদের ভালো বোঝে”। প্রশ্ন হলো একজন মন্ত্রী তার এপিএস-ড্রাইভার-কেরাণী সহ কিছু পদে সরাসরি নিজ ইচ্ছায় নিয়োগ দিতে পারেন। সব মন্ত্রী সাধারণত তাদের আত্মীয় বা চেনাজানাদের ভেতর থেকেই নিয়োগ দেন। সুরঞ্জিত সেনও তাই করেছেন। ধর্ম আমাদের যেভাবে আলাদা করে রেখেছে তাতে একজন হিন্দুর কাছের মানুষ হিন্দুই হবার কথা।
আরেকটা কথা শোনা যায় সব হিন্দুরা ক্রিকেটে ভারত সাপোর্ট করে কিন্তু সব মুসলিম পাকিস্তান করেনা। এই কথাটা অনেক ক্ষেত্রে সত্য। ১৯৭১ এর কারনে হিন্দুদের মনে পাকিস্তান সংক্রান্ত যে অপরিমেয় ঘৃনার সৃস্টি হয়েছে তারই প্রতিফলন এটা। যদিও আমার নিজের এমন হিন্দু বন্ধু আছে যে ভারত সাপোর্ট করেনা। আর এই কথাটা বলাই একটা বড় নোংরামি। রাজনৈতিক কারনে ক্রিকেটে পাকিস্তান সাপোর্ট না করা যত বড় নোংরামি তার চেয়ে বড় নোংরামি ধর্মীয় কারনে ক্রিকেটে ভারত সাপোর্ট করা বা না করা।
বিগত বিএনপি আমলে “মোহাম্মদ বিড়াল” এর কার্টুন নিয়ে কতকিছুই না হলো। এদেশের আইন-আদালত বাদ দিয়ে ক্ষমা করার দায়িত্ব পেলেন বাইতুল মোকাররমের খতিব। এতটুকু অপমান(!!!) যদি ইসলাম সইতে না পারে তাহলে অলি-গলিতে, মসজিদে-ময়দানে ওয়াজ মাহফিলে উচ্চস্বরে মাইক বাজিয়ে হিন্দু ধর্ম নিয়ে, এমনকি দেব-দেবীদের কাপড়-যৌনতা নিয়ে যে অসুস্থ আলোচনা হয় তা হিন্দুরা কিভাবে মেনে নেবে??
আজকাল এই আক্রমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’কেও বাদ রাখছেনা। ATN Bangla চ্যানেলের শুক্রবার দুপুরের ইসলামী অনুষ্ঠানের আলোচক মাওলানা তারেক মুনাওয়ারের এক ওয়াজের ভিডিওতে দেখলাম বলছেন “এই বাংলাদেশ শাহজালাল-শাহপরানের দেশ, কাজী নজরুলের দেশ কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুইর্যা’র দেশ না”। কাজী নজরুলকে এভাবে “ইসলামীকরণে”র কারন তিনি গজল লিখেছেন। (তারেক সাহেব হয়তো জানেননা তিনি শ্যামাসঙ্গীতও লিখেছেন) একবার ভাবুন যে ব্যাক্তি বাংলা সাহিত্যকে ১০০ বছর এগিয়ে দিয়েছেন তিনিও ধর্মের কাছে রেহাই পাচ্ছেন না।
লেখাটা এমনিতেই বেশ বড় হয়ে গেছে। চাইলে আরো বড় করা যায়। কিন্তু আমি শুধু আর কয়েকটা কথা বলতে চাই। এই লেখার পেছনে আমার উদ্দেশ্য এই না যে আমি হিন্দুদের পক্ষে সাফাই গাইবো কিংবা ইসলামকে ঢালাওভাবে দোষ দেবো। আমি শুধু দেখাতে চেষ্টা করেছি যে বাংলাদেশে যুগ যুগ ধরে ধর্ম কিভাবে মানুষকে, পশুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ধর্মের কারনে এই হানাহানি নতুন কিছু নয় কিংবা শুধু এদেশের কোন ঘটনা নয়। সারা পৃথিবীতে এই অনাচার হাজার বছর ধরেই চালু আছে। আমার লেখায় হিন্দুদের প্রতি সহমর্মিতা’র কারন এদেশের খ্রীষ্টান বা বৌদ্ধদের চেয়ে হিন্দুরা অনেক বেশী নির্যাতিত। আবার পৃথিবীতে এমন দেশও আছে যেখানে মুসলিমরা এর চেয়ে আরো অনেক বেশী নির্যাতিত। এর পিছনে একটাই কারন ধর্ম। যা কোনদিন সকল মানুষের মাঝে সম্প্রীতি আনতে পারেনি, পারবেওনা। এই পৃথিবীতে ধর্মের কারনে যত যুদ্ধ-হত্যা-লুন্ঠন-ধর্ষণ হয়েছে আর কোন কারনে তার সিকিভাগও হয়নি। দেশে দেশে ভাগাভাগি কিংবা যুদ্ধ প্রায় ৮০% ক্ষেত্রেই ধর্মের কারনে হয়। সব ধর্মই শান্তির কথা বলে তবে কেন আজ পৃথিবীর মোটামুটি সবদেশেই যুদ্ধ চলছে বা অশান্তি বিরাজ করছে? কারন মুখে শান্তির কথা বললেও ধর্মই মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরী করে দিয়েছে। ধর্মই আমাদের “রক্তের বদলে রক্ত” শিক্ষা দেয়। যেকারনে গুজরাটে মুসলিম মরলে এদেশে হিন্দু মরে। শুধুমাত্র দক্ষিন আমেরিকা ও ইউরোপের কিছু ধর্মছাড়া (ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা খুউউবই কম)দেশ আছে যেখানে কোন যুদ্ধ-অশান্তি নেই। সেসব দেশে মাসে দুয়েক’টা খুন হয়। দাঙ্গা-মারামারি তো একেবারেই হয়না। এর দ্বারাই বোঝা যায় শান্তির জন্য মানবতা দরকার; ধর্ম কোনভাবেই নয়। মানবতাই আমাদের শিক্ষা দেয় মহানুভবতার। মানুষের মধ্য বিভেদকারী ধর্মকে ভুলে আসুন মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষকে ভালোবাসি। মহাত্মা গান্ধীর একটি অসাধারন কথা দিয়ে এই সাধারন লেখাটা শেষ করি। “যদি সবাই চোখের বদলে চোখ নীতি মেনে চলে, তাহলে একদিন এই পৃথিবীর সব মানুষ অন্ধ হয়ে যাবে”।
মৎসপুরানে লেখা আছে ব্রক্ষ্মা নাকি একদিন তার নিজের মেয়ে শতরূপাকে দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারেন নি। হিন্দুদের আদি মানব মনুর জন্ম হয় ব্রহ্মা আর শতরূপার মিলন থেকেই। শুধু ব্রক্ষ্মা ই নয়, নিজ মেয়ের সাথে মিলনের কান্ড ঘটিয়েছে দেবতা প্রজাপতিও। উষা ছিলেন প্রজাপতি কন্যা। প্রজাপতি উষার রূপে কামাসক্ত হন, এবং মিলিত হতে চান। তখন উষা মৃগীরূপ ধারণ করেন। প্রজাপতি মৃগরূপ ধারণ করে তার সাথে মিলিত হন (মৈত্রায়ন সংহিতা ৪/২/২২)।
ReplyDelete