ধামরাই রথ |
¤¤ রথযাত্রা ¤¤
শুভ চৌধুরী
* রথযাত্রা কি ?
# রথযাত্রা সনাতন ধর্মের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উত্সব এবং বাঙালি সংস্কৃতি ও সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ যেখানে আষাঢ় মাসের পূণ্য তিথিতে কাঠের তৈরি রথে করে বিগ্রহকে পরিভ্রমন করানো হয় ।কালক্রমে ইহা হয়ে উঠেছে ধর্ম বর্ণ গোত্র নির্বিশেষের মিলনতীর্থ।
*রথযাত্রার আরোধ্য কে?
#ভগবান শ্রীজগন্নাথদেব ,বলরাম ও দেবী সুভদ্রা ।
* জগন্নাথদেবের রথযাত্রা পালন করলে কি হয়?
#শ্রীমদ্ভাগবতে আছে ,যে ব্যক্তি রথে চড়ে জগন্নাথদেবকে বিশ্বব্রহ্মান্ড দর্শন করাবেন অথবা শ্রী ভগবানের রূপ দর্শন করাবেন ভগবান তাদের প্রতি অশেষ কৃপা বর্ষণ করেন।
বৃহন্নারদীয় পুরাণে আছে,ভগবান নারায়ন লক্ষ্মী দেবীকে বলেছেন, " পুরুষোত্তম ক্ষেত্র নামক ধামে আমার কেশব-মূর্তি বিরাজমান । মানুষ যদি কেবল সেই শ্রীবিগৃহ দর্শন করে তবে অনায়াসে আমার ধামে আমার কাছে ফিরে আসতে পারেন। "
এছাড়া বিষ্ণুপুরাণেও এর মহিমা ও পুণ্যফলের কথা বিধৃত হয়েছে।
*জগন্নাথ দেবকে কেন ঠুঁটো জগন্নাথ বলা হয় কেন?এ সম্পর্কে কি কোন পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে?
# মহারজা ইন্দ্রদ্যুম্ন একদিন নদীতে কাঠ ভেসে আসতে দেখেন এবং তিনি দৈব নির্দেশে মন্দির নির্মাণ করে সেখানে শ্রীবিগৃহ নির্মাণের দায়িত্ব দিলেন এক কারুশিল্পীর হাতে ;এই কারুশিল্পী ছিলেন বিশ্বকর্মা যা মহারাজের কাছে জানা ছিল না এবং কারুশিল্পীর শর্ত ছিল যে নির্মাণ কাছ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত মন্দিরের দরজা যেন না খোলে কিন্তু কয়েক দিন পর মহারাজ শর্ত উপেক্ষা করে কৌতহূল বশত তিনি জীবিত আছেন কিনা তা জানতে চাইলে দরজা খুলেন কিন্তু তখনও বিগৃহের হাত তৈরি না হ ওয়ায় জগন্নাথদেবের এই হস্তহীন রূপে প্রকটিত হয় ।
*ইতিহাসবেত্তারা এ সম্পর্কে কি বলেন?
# জগন্নাথ দেবের মুর্তির সাখে গ্রীক দেবতার সাদৃশ্য বিদ্যমান যা বহুপ্রাচীন।
*জগন্নাথ দেবের মুল মন্দির কোথায়?
# হিন্দুদের চার ধামের মধ্যে অন্যতম পূরীতে বিদ্যমান যেখানে চৈতন্যদেব লীন হয়ে যান।
*রথযাত্রা কোথায় কোথায় মুলত পালিত হয়?
#পুরী,ভারতের প্রধান প্রধান প্রদেশ,বাংলাদেশের প্রায় সব জেলা (ধামরাই যশোমাধব মন্দির সর্ববৃহত্,স্বামীবাগ মন্দির,জগন্নাথ মন্দির-দিনাজপুর ,ইসকন মন্দির -বগুড়া-যশোর-চট্টগ্রাম-খুলনা -সিলেট,গোপীনাথ জিউর মন্দির -কুষ্টিয়া,মদনমোহন মন্দির-ঝিনাইদহ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য);লূধিয়ানা ,টরেন্টো
,শিকাগো,নেপাল,বালি,মরিশাস,ফিজি
ধামরাইয়ের রথযাত্রা
মিঠুন সরকার
অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব রথ উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। এ উপলক্ষে প্রতিবারের মত এবারো উৎসবের আয়োজন ব্যাপক। বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে ও লাখো মানুষের মিলন মেলায় পরিনত হয়ে উঠবে এ উৎসব। আগামী ২১ শে জুন থেকে শুরু হতে যাচ্ছে ৪০০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় উৎসব শ্রীশ্রী যশোমাধব দেবের রথযাত্রা উৎসব ও মাসব্যাপী মেলা। রথ উৎসব পালনে রথের সংস্কার কাজ ও তার মাসব্যাপী মেলার আয়োজন ও সংস্কার এবং রং তুলির কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। এই ঐতিহ্যবাহী রথ উৎসবকে কেন্দ্র করে গোটা ধামরাইয়ে এখন সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। পল্ল¬ী কবি জসিম উদ্দীনের সাহিত্য কর্মে ‘ধামরাইয়ের রথ’ কবিতার চয়ন গুলিতে স্থান পাওয়া এ রথটি এখন আর নেই।
কতিাটি হলো,
ধামরাই রথ
ধামরাই রথ, কোন অতীতের বৃদ্ধ সূত্রধর,
কতকাল ধরে গড়েছিলো এরে করি অতি মনোহর।
সূক্ষ হাতের বাটালি ধরিয়া কঠিন কাঠেরে কাটি,
কত পরী আর লতাপাতা ফুল গড়েছিলো পরিপাটি।
রথের সামনে যুগল অশ্ব, সেই কত কাল হতে,
ছুটিয়া চলেছে আজিও তাহারা আসে নাই কোন মতে।
সাধারন মানুষের মাঝে রথ উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। ব্যবসায়ীরাও প্রস্তুতি নিচ্ছে রথ মেলা কে কেন্দ্র করে। ইতিমধ্যেই মেলার ইজারা পত্তনের কাজও শেষ হয়েছে। প্রতি বছরের মতো এবারো রথের মেলাকে কেন্দ্র করে মেলাঙ্গন জুড়ে বসবে সহ¯্রাধিক বিভিন্ন শ্রেণীর ষ্টল। বসবে দেশ খ্যাত সার্কাস দল। গ্রাম বাংলার লোকজ ঐতিহ্যের ধারক ও ইতিহাসের আবর্তে ঘেরা ঢাকার অদূরে ধামরাই উপজেলা এক অতি প্রাচীন ঐতিহ্যময় জনপথ। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অপূর্ব ঐতিহ্য রয়েছে এই ধামরাইয়ে। ১৬টি ইউনিয়নের ৪০৮টি গ্রাম নিয়ে ধামরাই এর পরিধি বিস্তৃত রয়েছে। ধামরাই এর চারপাশ ঘেরা বংশী ও কাকিলাজানি নদী বেষ্টিত সবুজের সমাহার ও জনপথ। এক সময় ধামরাই এর যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল নৌকা ও নৌ-পথ। পরিবর্তনশীল জগতের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সড়ক ও মহাসড়কসহ আধুনিকায়নের ছোয়ায় গড়ে উঠেছে ধামরাই এর পুরো অঞ্চল।
স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ০৯ এপ্রিল সকাল ১০টা ইতিহাসের ধারক ও এদেশের ঐতিহ্যময় ঐতিহাসিক হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসবের মূল্যবান কাঠের ‘রথ’ টি বর্বর পাক হানাদার বাহিনী ও দেশীয় দালাল, রাজাকার মিলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। তখন গোটা দেশেই চলছিল হত্যাযঞ্জ, নির্যাতন, লুটপাট, পাশাপাশি চলছিল যুক্তিযুদ্ধ। ৪০ ফুট প্রস্থে ৭৫ ফুট উচ্চতা ৩ তলা বিশিষ্ঠ ও ৯ টি প্রকোষ্ঠ এবং ৯ টি মাথা বিশিষ্ঠ সৌন্দর্য শৈলীর নানা কারু কার্জ্য খঁচিত সেই রথটির ইতিহাস প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো। বাংলাদেশই নয় পৃথিবীতে এত বড় রথ আর কোথাও নেই। এর খ্যাতি বিশ্ব জুড়ে। এদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম এ উৎসব ধর্মীয় স্রোতধারায় প্রতিষ্ঠিত হলেও , বর্তমানে এ উৎসব পুরোপুরি সার্বজনীনতা লাভ করেছে। লাখো মানুষের মিলন মেলায় পরিনত হয়ে উঠে এ উৎসব। প্রতি বছরই সরকারের মন্ত্রী বা উচ্চ পর্যায়ের কোন না কোন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গরা আসেন এই রথ ও তার মাসব্যাপী মেলা উদ্ধোধন করতে।
ভারত সরকার বাংলাদেশের সাথে সেতু বন্ধন অটুট রাখতে ২০১০ সালে ধামরাইয়ে পুরোনো রথটির আদলে নির্মানে ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি নতুন রথ নির্মাণ করে দেয়। বাংলাদেশস্থ ভারতীয় দূতাবাসের তত্বাবধানে ২০০৯ সালে ধমরাই রথের টেন্ডার হয়। টেন্ডার পেয়ে উই.ডি.সি.কেল.বিন টেকনো. টাচ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ২০১০ সালের জানুয়ারী থেকে রথ নিমার্ন কাজ শুরু করে। নির্মান কাজ ৬ মাসের মধ্যেই শেষ করে। ২০১০ সালের রথ উৎসব নতুন রথেই অনূষ্ঠিত হয়।
ধামরাইয়ের ঐতিহ্যবাহী এই রথ ১০৭৯ সালে প্রথম জনৈক রাম জীবন বায় মৌলিকের প্রতিষ্ঠিত ও বাঁশের তৈরীরথে মূর্তি চড়িয়ে রথ যাত্রার শুরু হয়। তবে এর আগে কবে কখন রথ উৎসব শুরু হয়েছে তা অজানা। পরবর্তীতে বাংলা ১২০৪ সালে তৎকালীন ঢাকা জেলার অর্ন্তগত মানিকগঞ্জের বালিয়াটির জমিদারগন ঐতিহাসিক রথের নির্মান ব্যয়ভার বহন করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে এই রথ না থাকায় উৎসব বন্ধ ছিল এক বছর।
১৯৭৩ সালে হিন্দু সমপ্রদায়ের লোক জন ছোট আকারে একটি বাশঁ ও কাঠের রথ নির্মান করে উৎসব পালন করে। ১৯৭৪ সালে বৃহৎ রথের আদলে ছোট পরিসরে কাঠের রথ নির্মান করে শুরু করে পুণরায় রথ উৎসবের নবযাত্রা। এ ব্যাপারে ধামরাই রথ কমিটির অন্যতম সদস্য ও শিল্পী সুকান্ত বনিক বলেন, বিগত ২০০৬ সালে ধামরাইয়ের রথ উৎসবে তৎকালীন মাধব মন্দির কমিটির সাধরন সম্পাদক ধামরাইয়ের বিশিষ্ঠ সমাজ সেবক প্রয়াত ঠাকুর গোপাল বনিকের আমন্ত্রনে রথ উৎসবে বিশেষ অতিথি হয়ে আসেন ঐ সময়ের বাংলাদেশস্থ ভারতীয় দূতাবাসের দূত শ্রীমতি বিনা সিক্রী। ধামরাই বাসীর আন্তরিক দাবীর প্রেক্ষিতে শ্রীমতি বিনা সিক্রী তার ভাষণে পূর্বের আদলে ধামরাইয়ের রথটি নির্মান করে দেবার আশ্বাস দেন। এরপর রথ ও মাধব মন্দির কমিটির দুই জন কর্মকর্তা বর্তমান প্রয়াত ঠাকুর গোপাল বণিক ও ধামরাইয়ের বিশ্ব কর্মা বলে খ্যাত শিল্পী সুকান্ত বণিক নিজে ধামরাই থেকে ভারতের পুরিতে যান। সেখানেই রথ নির্মান খরচ বিষয়ক ও তত্বাবধায়ক বিষয়ে আলোচনা হয়। ভারত সরকার বাংলাদেশের সেতু বন্ধন অটুট রাখতে ধামরাইয়ে বর্তমান এই রথটির নির্মানে প্রায় কোটি টাকা ব্যয়করে নির্মানের প্রদক্ষেপ গ্রহন করেন। ধামরাইয়ের রথ মেলা কমিটির আহবায়ক ও যশোমাধব মন্দিরের যুগ্ম সম্পাদক অসিত গোস্বামী বলেন, মেলার সব আয়োজন প্রায় শেষ হয়েছে প্রশাসনিক পূর্ন সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে। লাখো লাখো ভক্তের সমাগম ঘটবে ঢাকার ধামরাইয়ে।
রংমিস্ত্রিরি মাসুদুর রহমানও জানালেন রং তুলির কাজও প্রায় শেষ। লক্ষী রানী জানালেন, রথযাত্রা আসলে তাদের আনন্দের অন্ত থাকে না। ধামরাইয়ের বাসিন্দা শিশু মোঃ জাহিদ ও বিশ্বনাথ জানালেন, শুনেছি আগে যে রথটি ছিলো সেটি ১৯৭১ এর মুক্তিযদ্ধের সময় পাক বর্বর বাহিনীরা পুড়িয়ে দিয়েছে। এখন ছোট রথেই রথ মেলা দেখবো বলেন। তারা আরো বলেন, এই ধামরাইয়ে রথমেলা হিন্দুদের হলেও সকল ধর্মের মানুষ উপভোগ করে থাকে এখানে কোন ভেদাভেদ নেই।
No comments:
Post a Comment