ভারতীয় উচ্চারনে, সে মুম্বাই হামলাকারীদের নির্দেশ দেয় এবং যখন তারা মারা যাচ্ছিল, তখন সান্ত্বনা দেয়। গত সপ্তাহে নতুন দিল্লীতে গ্রেফতার হওয়ার পর এখন আবু হামজা পুলিশী হেফাজতে রয়েছে।
সৈয়দ জাবিউদ্দিন আনসারী, যে আবু হামজা নামেও পরিচিত এবং আবু জিন্দাল-কে লস্কর-ই- তৈয়বা (এল ই টি)-এর হয়ে কাজ করার “ মূল পরিকল্পনাকারী” হিসাবে মনে করা হয়, যারা এই হামলা পরিচালনা করেছিল। সে তাদেরকে লক্ষ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করেছিল, নির্দেশ প্রদান করেছিল, এবং উৎসাহব্যঞ্জক কথার মাধ্যমে তাদের মনোবল চাঙ্গা করেছিল।
“পরিকল্পনাকারী
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটানোর ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারন তার অভিজ্ঞতা,
শিক্ষা
এবং কাজের প্রতি তার শপথের কারনে। সে
ব্যক্তিগতভাবে সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষন দিয়েছে এবং একজন ভারতীয় হওয়ার কারনে,
মুম্বাইয়ের
বিভিন্ন স্থানের অবস্থানের ব্যাপারে তাদের নির্দেশনা দেয়ার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক
অবস্থানে ছিল”, খবর সাউথ এশিয়াকে বলেন সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষীর প্রধান,
জে.কে.
দত্ত।
এটা
আবু হামজার কণ্ঠস্বর বলে সন্দেহ করা হচ্ছে যা ফোনের জব্দ করা আলাপচারিতা থেকে শোনা
যায় সে ১০ জনের একটি সন্ত্রাসী দলকে নির্দেশনা দিচ্ছে। তার
উচ্চারন ভঙ্গি শুনে অনেকেই চমকে যায়, কারন মনে হচ্ছে যে, কথাগুলো আসছে
কোন ভারতীয় কারো কাছে থেকে।
জব্দ
করা রেকর্ড যখন টেলিভিশনে প্রচার করা হয়, দর্শকশ্রোতা মর্মাহত হয় যখন তারা
ভারতীয় উচ্চারন ভঙ্গির উর্দু ভাষী সন্ত্রাসীদের ভয়ংকর বার্তা দ্বারা উদ্বুদ্ধ
করছেঃ “এটা কেবল একটা সূচনা; আসল সিনেমা শুরু হতে এখনো বাকী
আছে”।
দত্তের
মতে, সে
“সন্ত্রাসের
কণ্ন্ঠধ্বনি", “এই লোকটি সন্ত্রাসীদের অব্যাহতভাবে নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছিল যে
কি করতে হবে [এবং] কাকে হত্যা করতে হবে, এবং তাদের অব্যাহতভাবে উৎসাহ
দিয়ে যাচ্ছিল”।
কোন
এক সময়, তাকে শোনা যায় যে সে একজন সন্ত্রাসীকে, যে তার আহত
হওয়ার কারনে মারা যাচ্ছে, তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, “তুমি তোমার
সফল ভাবে অর্জিত জান্নাত ( স্বর্গ) পাবে”।
যদিও
অন্যান্য পরিকল্পনাকারীদের কণ্ঠস্বর ও জব্দ করা হয় এবং চালানো হয় টেলিভিশনে,
কেবল
একজনই হিন্দী শব্দ যেমন “প্রশাসন”-এর জন্য “কর্তৃপক্ষ”
, “সতর্ক”
হওয়ার”
জন্য
“সাবধান”
এবং
“ধৈর্য”
হওয়ার
জন্য “ধৈর্য্য”
শব্দগুলি
ব্যবহার করে।
ভারতের
ফেডারেল ইন্টেলিজেন্স ব্যূরো এর ভাষা বিশেষজ্ঞ হামিদ খান খবর কে বলেন,“অন্যান্যরা পাঞ্জাবী-উচ্চারনে
যে উর্দু বলে তা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে পাকিস্তানে সাধারনভাবে শোনা যায়”।
২১
শে জুন নতুন দিল্লীর ইন্দিরা গান্ধী বিমান বন্দর হতে গ্রেফতার এবং বর্তমানে অজানা
কোনস্থানে রাখা হয়েছে, হামজাকে, যার বয়স ত্রিশের মত হবে বলে ধারনা করা
হয়। সে মহারাষ্ট্র রাজ্য, যার রাজধানী
মুম্বাই, তার বিদ জেলার জিওরাইয়ের বাসিন্দা।
নিম্ন
মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া, সে একসময় একজন ইলেক্ট্রিশিয়ান হতে
চেয়েছিল কিন্তু সন্দেহ করা হয় যে ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার কারনে প্রলুব্ধ হয়ে
সন্ত্রাসী তৎপরতার সাথে যুক্ত হয়, যে ঘটনায় ৭৯০ জন মুসলমান এবং ২৫৪ জন
হিন্দু মৃত্যুবরণ করে। সে প্রথমে
স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অব ইন্ডিয়াতে নাম লেখায়, যে দলটি ২০০১
সালের ১১ই সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক এবং ওয়াশিংটনে সংঘঠিত সন্ত্রাসী হামলার এক সপ্তাহের
মধ্যেই নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। তার পর,
কর্তৃপক্ষ
বলে, সে
ইন্ডিয়ান মুজাহেদীন-এ যোগ দেয় এবং শেষ পর্যন্ত, এলইটি-তে।
তাকে
মনে করা হয় যে, মুম্বাইয়ের পূর্বে সে কমপক্ষে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ত্রাসী
কর্মকাণ্ড ঘটানোতে ভূমিকা পালন করেছে, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল,
ব্যঙ্গালোরের
চিন্বাস্বামী স্টেডিয়ামে সংঘঠিত বিস্ফোরন।
মটরচালিত
নৌকায় করে ভারতের অর্থনীতির রাজধানী শহরে অবতরন করা ১০ জন এল ই টি-র সক্রিয় সদস্য
দ্বারা মুম্বাইয়ের হামলা তিনরাত ও দুই দিনেরও বেশী সময় ধরে চলে। তারা ১১টি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে হামলা
চালায়, যার মধ্যে রয়েছে, সৌন্দর্য মন্ডিত তাজ মহল হোটেল,
আর
এ হামলায় মারা যায় ১৬৬ জন আর আহত হয় আরো ৩০৮ জন।
পাকিস্তানী
আমেরিকান, ডেভিড কোলম্যান হেডলি যে এল ই টি-এর সাথে যোগসাজশে মুম্বাই
হামলার পরিকল্পনা করে, তার সাথে ছিল ১০ ব্যক্তি বিশিষ্ট সন্ত্রাসী দলের একমাত্র জীবিত
সদস্য, আজমাল কাসাব, তারা উভয়েই হামজার ভূমিকার ব্যাপারে
তথ্য দিয়েছে বলে ভারতের নিরাপত্তা সূত্রগুলো জানায়।
ইন্ডিয়ান
মুজাহেদীনের সক্রিয় সদস্য, এহতেশাম, যে দিল্লীতে
বর্তমানে পুলিশী হেফাজতে আছে, সেও হামজার জড়িত থাকার ব্যাপারে
বিস্তারিত তথ্য দিয়েছে।
এদিকে ২৬/১১ কাণ্ডে ধৃত 'প্রাইজ ক্যাচ' আবু জিন্দাল মুখ খুলতে না খুলতেই পিঠ বাঁচাতে আসরে নামলেন পাক প্রশাসনের কর্তারা। বুধবার বিকেলে পাক অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী রেহমান মালিক সাড়ে তিন বছর আগে যা বলেছিলেন সেই একই সুর বজায় রেখে একইভাবে বললেন, ভারতের হাতে ধৃত জঙ্গি কোনওভাবেই পাকিস্তানি নাগরিক নয়। ওই জঙ্গি যা বলছে তা ভিত্তিহীন ও বানানো। ২৬/১১ কাণ্ডের সঙ্গে পাক সরকার বা পাক প্রশাসনের কোনও অংশের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগ ছিল না। থাকার প্রশ্নও ওঠে না। এমনকী আইএসআই-এর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে তাও সর্বৈব মিথ্যা। মালিক জানান, আইএসআই পাকিস্তানের রক্ষাকর্তা। পাক প্রতিরক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু কোনও দেশে নাশকতা চালাতে আইএসআই কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে উৎসাহ দেয় না।
ঠাকুর ঘরে কে? আমি তো...
এদিন মালিক ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি
চিদম্বরমকে একহাত নিয়ে বলেন, উনি একতরফাভাবে আইএসআইকে টার্গেট করে পর পর মিথ্যে অভিযোগ করে যাচ্ছেন। অথচ আইএসআই বা
জামাত উদ দাওয়ার প্রধানের বিরুদ্ধে কোনও অকাট্য প্রমাণ এখনও ভারত তুলে দিতে পারেনি। তাছাড়া মুম্বই
হামলার সঙ্গে কোনও পাকিস্তানি নাগরিক ও পাক সংস্থা কোনওভাবেই জড়িত নয়।
এদিন রেহমান মালিক যা বলেছেন তা ভারতকে ক্রুদ্ধ
করার পক্ষে বা চটিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। যা দ্বিপাক্ষিক
সম্পর্ক নষ্ট করতে বা সংঘাত বাড়াতেই মদত দেবে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। রেহমান মালিক আজ
ইসলামাবাদে জানিয়েছেন, ভারত ২৬/১১ নিয়ে যে তথ্য প্রমাণ দিয়েছে তা যথেষ্ট নয়। এমনকী
বিশ্বাসযোগ্যও নয়। তাই তার ভিত্তিতে পাকিস্তান কোনও তদন্ত করবে না। শুধু আইএসআই কেন? যে কাউকে দোষী বলে
দেওয়া খুব সহজ। কিন্তু তা প্রমাণ করা খুবই কঠিন। ভারত যা বলছে তা
প্রমাণ করতে পারছে কই?
এদিন,
চিম্বরম দিল্লিতে জানান, সৌদি থেকে ধৃত আবু
হামজা ওরফে আবু জিন্দাল ওরফে সৈয়দ জাবিউদ্দিন আনসারি এনআইএ-র জেরার মুখে জানিয়েছে, ২৬/১১-এর ঘটনায়
জড়িত ১০ লস্কর জঙ্গিকে ২০০৮-এর ২৬ থেকে ২৯ নভেম্বর যে ৬ জন প্রশিক্ষণ দেয় তাদের
মধ্যে সে ছিল একজন। আসলে ১০ জন উর্দুভাষী জঙ্গিকে আবু হামজাই হিন্দিতে
কথা বলতে শেখায়। তাকে জেরা করে আরও জানা গেছে যে কন্ট্রোল রুমে আইএসআই আধিকারিকরাও ছিলেন। এই পরিস্থিতিতে
কাসব ও হামজাকে মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করলে হামলা সম্পর্কে আরও কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য
পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করছে মুম্বই পুলিশ। শুধু তাই নয়, আইএসআই-এর সক্রিয়
মদতে ও সুচারু পরিকল্পনার ফসল হল ২৬/১১।
প্রসঙ্গত, গত এক বছর ধরে আবু জিন্দালকে ধরার চেষ্টা
করে অবশেষে সাফল্য এসেছে। জিন্দাল পাক সম্পর্কের কথা ফাঁস করে দেওযায় আপাতত
যথেষ্ট চাপে পাক সরকার। গতকালই পাক অভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রী রেহমান মালিক
ভারতের কাছে আবু জিন্দাল সম্পর্কে তথ্য জানতে চেয়েছেন। চিদম্বরমের মতে, ভারতের চাহিদা মতই
জঙ্গিদের ভয়েস স্যাম্পেল পাঠিয়ে পাকিস্তান প্রতিশ্রতি রক্ষা করলে তবেই এ বিষয়ে
চিন্তাভাবনা করা হবে। এদিকে, ঔরঙ্গাবাদে সেনা অস্ত্রাগারে হামলা এবং ২০১০
সালের ফেব্রুয়ারিতে জার্মান বেকারিতে বিস্ফোরণের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে
জিন্দালকে জেরা করতে অনুমতি পাওয়ার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছে মুম্বই পুলিশের
সন্ত্রাস দমন স্কোয়াড।
অন্যদিকে, ওড়িশা সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে
নাশকতার ছক কষছে ২৬/১১ ঘটানো লস্কর-এ-তৈবা। অসমের গোয়েন্দা
পুলিশ এ ব্যাপারে বিস্তারিত রিপোর্ট দিয়েছে রাজ্য সরকারকে। রাজ্য সরকারের
নির্দেশে জেলা প্রশাসনগুলি অসমের উপদ্রুত অঞ্চলে নিরাপত্তা জোরদার করার নির্দেশ
দিয়েছে। সম্ভাব্য হামলা সংক্রান্ত তথ্য পৌঁছে দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয়
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কাছেও। ওড়িশা সরকার ও অসম সরকারকে এ বিষয়ে চুড়ান্ত
সতর্কতার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অসমের সীমান্তবর্তী ও ওড়িশার উপকূলবর্তী
অঞ্চলগুলিতে বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা। সজাগ করা হয়েছে
পুলিশকে। এনআইএ'র ধারণা, আইএসআই-এর মদতে লস্কর জঙ্গিরা পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে বা মুম্বই সন্নিহিত
পশ্চিম উপকূল দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করবে না। কারণ এখন পশ্চিম
উপকূল ও সীমান্ত বরাবর নিরাপত্তার কড়াকড়ি রয়েছে। বরং মায়ানমার বা
বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে ঢুকে স্থানীয় জঙ্গি সংগঠনগুলির সাহায্যে
বড় হামলা বা বিস্ফোরণের ছক কষছে।
No comments:
Post a Comment