পূর্ব কথা
দেবাশীষ ভট্টাচার্য্য
দ্বিতীয় পর্যায়ঃ
আমাদের সকলের নানা ধরনের পছন্দের ও ভালবাসার বিষয়ে থাকে।কিন্তু ভেবে দেখবেন সেই বিষয়ে গুলিকে ভালবাসার কারণ কিন্তু সেই বিষয়েটি সম্পর্কে আপনার যথেষ্ট জ্ঞান থাকা।অর্থাৎ ধরুন আপনার কম্পিউটারটি আপনার কাছে খুব প্রিয় বস্তু।ভেবে দেখুন কেন তা আপনার প্রিয় বস্তু।কারণ আপনি তার কাজ সম্পর্কে অবগত।তার কি ক্ষমতা বা সে কি কি করতে পারে এবং তা আপনার কি কি কাজে আসতে পারে বা আসে তার সম্পর্কে আপনি যথেষ্ট অবগত।এই কারণেই তা আপনার কাছে প্রিয়। কিন্তু একজন, যে কম্পুটারের ব্যবহার জানেনা তার কাছে এই বস্তুটি ঠিক ততটা গুরুত্ব পাবেনা যতটা আপনার কাছে তার গুরুত্ব বা ভালবাসা আছে। এই উদাহরণটি দিলাম এই কারণেই আমরা আজ হিন্দু ধর্মে জন্মেও অনেকে আমাদের ধর্ম সম্পর্কে অনীহা প্রকাশ করি,তাকে মানতে চাইনা, ধর্মের কথা শুনতে চাইনা কেন এই কারণটি বিশ্লেষণ করার উদ্দেশে। এর কারণটি ঠিক ওই উদাহরনটির মতই। আসলে এর কারণ হল আমাদের নিজেদের ধর্ম সম্পর্কেই আমাদের ধারণা বা জ্ঞান সম্পূর্ণ নয়।তার সম্পর্কে আমাদের ধারণা পরিস্কার নয়।এই কারণেই আমরা মন থেকে তাকে ভালবাসতে পারিনা। যখন এই ধর্ম তার নিজের মধ্যেই সর্বৎকৃষ্ট তখন তা না জানার ফলেই আমাদের আজ এই ধর্ম সম্পর্কে অনীহা। যদি একবার এই ধর্মের শ্রেষ্টত্ব, তার মহত্ব সম্পর্কে জানতে পারি তখন আমরা মন থেকেই একে শ্রেষ্ঠ বলে মেনে নিতে পারব।এখন আমাদের কি অবস্থা সে সম্পর্কে আরেকটি সুন্দর উদাহরণ দি। ধরাযাক আমরা একটি কলেজের ছাত্র। সেই কলেজে এক নতুন প্রফেসর এলেন আমাদেরই বিষয়ের ওপরে। কিছু স্টুডেন্ট তার ক্লাস করলো এবং দেখল যে তিনি অসাধারণ পড়ান। যা বোঝান তা জলের মতন সহজ হয়ে যায় ছাত্রদের কাছে। আমরা সেই ব্যপারটা শুনলাম। অবগত হলাম তার পড়ানো নিয়ে। কিন্তু তখনও তার ক্লাস পাওয়ার সৌভাগ্য আমাদের হয়েনি। কিন্তু বাকিদের মুখে শুনে মনে মনে আমরা তাকে শ্রদ্ধা করতে শুরু করলাম।এরপর একদিন তার ক্লাস পেলাম এবং নিজেরাও দেখলাম যে বাকিরা ভুল বলেনি। সত্যিই তিনি অসাধারণ। এবং আগে তার ক্লাস না পাওয়াকালীন তার প্রতি আমাদের যে শ্রদ্ধা ছিল, এখন নিজে তার ক্লাস করে সেই শ্রদ্ধা আরো বহুগুনে বেড়ে গেল। আমাদের ধর্মও ঠিক এই। এর সম্পর্কে শুনেই আমাদের মনে যে শ্রদ্ধা তা কেবল তার সম্পর্কে শুনে শুনে মনের মধ্যে তৈরী হওয়া "কৃত্তিম" শ্রদ্ধা। কিন্তু সত্যিকারের যেদিন তার ক্লাস পাব অর্থাৎ তাকে নিজের থেকে জানতে পারব সেদিন এই শ্রদ্ধা বহু বহু গুনে বৃদ্ধি পাবে। এই হলো অনুভুতি। অনুভূতিই সব। সেই সবথেকে বড় শিক্ষক। বই পরে জানা যায়। কিন্তু সত্যিকারের সেখা যায় একমাত্র অনুভুতি দিই। আমরাও বই পরে অঙ্ক করি। কিন্তু আইনস্টাইন হতে পারিনা। কারন তিনি অনুভুতি দিয়ে অঙ্ককে বুঝেছিলেন। নিজের করে নিয়েছিলেন। তাই তিনি ওই জায়গায় যেতে পারলেন। ধর্মতত্ত্ব তো আরো উপরে। বই পরে তাকে আর কি অনুভব করবেন। শুধু জানতে পারবেন তার সম্পর্কে।কিন্তু কখনো চেষ্টা করে দেখুন তাকে মন থেকে, হৃদয় থেকে অনুভব করবার। দেখবেন যা আপনি পেলেন তা এই পৃথিবীর সবথেকে দামী বস্তু। এই উদাহরনগুলির সুত্র ধরে এবার আমি এই গন্থের পরবর্তী দিকে প্রবেশ করতে চলেছি যেখানে আপনারা আমাদের হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে অত্যন্ত প্রাথমিক পর্যায়েতে যে জ্ঞানসকল প্রয়োজন তা জানতে পারবেন। এখানে আমি এবার বলব হিন্দু ধর্মের শাস্ত্রের কথা। লজ্জার বিষয় হল আমরা অনেকেই হিন্দু হয়েও, অনেক পুজো আদি করলেও কিন্তু হিন্দু শাস্ত্র যে কিকি তাই ভালকরে জানিনা। শুরুতে অন্তত সেটুকুও জানা উচিত বলে আমার মনে হয় তাই এই অধ্যায়ে আমি সেই আলোচনাতেই আসছি।
হিন্দু শাস্ত্র সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে শুরুতেই একটি বিষয় বলে নেওয়া আবশ্যক যে অনেকের এধরনের ধারণা আছে যে হিন্দু শাস্ত্রের মধ্যে অনেক বিভেদ আছে, স্ববিরধিতা রয়েছে। কিন্তু তা যে কতখানি ভুল তা আমার পরবর্তী আলোচনা থেকেই সহজে বুঝতে পারবেন। হিন্দু শাস্ত্রের প্রতিটি গ্রন্থকে সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করলে জানতে পারবেন যে পরব্রহ্মের উপাসনাই হিন্দু ধর্মের মূল সারমর্ম। সকল শাস্ত্র সমন্বয় এই কথায় বলে যে পরব্রহ্মের উপাসনা ছাড়া মুক্তিলাভ সম্ভব নয়। ব্রহ্মই হিন্দু ধর্মের মধ্যমনি। এখন শাস্ত্র কিকি তা সবিস্তারে আলোচনা করছি। বেদ হলো হিন্দু ধর্মের সর্বপ্রধান শাস্ত্র। যার ওপর নাম শ্রুতি। শ্রুতির অর্থ শোনা। পূর্বে গুরুর মুখ থেকে শিষ্য শুনে শুনে মনে রাখত। তখন লেখার প্রচলন ছিলনা। তাই এভাবেই এক পরম্পরা থেকে ওপর পরম্পরায় মুখ থেকে শুনে শুনে তা অধ্যায়ন করা হত বলে বেদের ওপর নাম শ্রুতি। আবার শ্রুতি কে মনে রেখে তা পরে বলা হত। একে বলা হত স্মৃতি। শ্রুতি অর্থাৎ বেদ দুটি অংশে বিভক্ত। মন্ত্র ও ব্রাহ্মন। মন্ত্রের ওপর নাম সংহিতা। সংহিতাতে ইন্দ্রাদী দেবতাদের স্তব আছে। ব্রাহ্মন হল সেই ভাগ যেখানে এই সংহিতার অর্থ ব্যাখ্যা করা আছে।এ বার বিষয়টিকে আরো পরিষ্কার করে বলি। পূর্বেই বলেছিলাম যে তখনকার দিনে মূল বিশয়গুলিকেই রূপকের দ্বারা বলা হত। সেই সমস্ত রূপকের অর্থ উদ্ধার করতে পারলেই আসল অর্থ সামনে এসে পরে। যেমন এই গ্রন্থের আগের অংশে দেব দেবীর রূপকার্থ কিছু বিশ্লেষণ করেছিলাম। যেখানে এই ধরনের রূপকের ব্যবহার করে লেখা হত সেই ভাগটিকেই বলা হত সংহিতা। আবার এই রূপকের বিশ্লেষণ অর্থাৎ আসল মানেগুলি যে অংশে থাকত তাকেই বলা হত ব্রাহ্মন। এই ব্রাহ্মনেরই শেষ ভাগকে উপনিষদ বলা হয় থাকে। যেখানে একমাত্র অদ্বিতীয় ঈশ্বরের কথাই বলা আছে। বেদের অন্ত ভাগ বলে একে বেদান্তও বলা হয়। অনেকে ব্যাস প্রনীত বেদান্তসূত্রকে বেদান্ত বলেন। কিন্তু উপনিষদই হল আসলে বেদান্ত। বেদ চারটি, ঋক,সম,যজু: ও অথর্ব। ঋকবেদে দেবতাদিগের স্তব আছে। যজু: বেদে আছে যজ্ঞের বিধি। এবং সমবেদে আছে ধর্ম সঙ্গীত। অথর্ববেদে এসবই আছে। তার সাথে আছে বেশ কিছু শক্তিশালী মন্ত্র। যাদের মাধ্যমে অনেক অদ্ভুত কাজ করা সম্ভব। এইখানে একটি বিশেষ কথা স্মরণে রাখতে হবে যে সকল বেদ একই সময় একই ঋষির দ্বাড়ায় সম্পূর্ণ লেখা হয়েনি। এক এক সময় এক এক ঋষি উত্থিত হয়েছেন এবং মুখপরম্পরাগত শ্রুতিকে সংগ্রহ করে বেদ রচনা করেছেন। এই সকল শ্রুতি সংগ্রহকারিদিগের নাম ব্যাস। এই ব্যাস একজন ছিলেন না। অনেকের এটাই ধারণা যে ব্যাসদেব একজনই ছিলেন। কিন্তু সেই ধারণা ঠিক নয়। অনেকে আবার এও বলেন যে ব্যাসদেব নিজেরই লেখায় নানা জায়গায় নানা কথা লিখেছিলেন যাদের মধ্যে সাদৃশ্য ছিলনা। এবার আশা করি বোঝা যাবে যে তা একার দ্বাড়ায় লেখা ছিলনা। এভাবে অনেক ব্যাসের পর যিনি শেষে এসেছিলেন তাঁর নাম কৃষ্ণদ্বৈপায়ন। এতো গেল বেদের কথা। এবারে আসি পুরানের কথায়। মোট মহাপুরানের সংখ্যা ১৮। তাদের নাম: গরুর,কুর্ম,বরাহ,মার্কন্ডেয়,লিঙ্গ,স্কন্ধ,বিষ্ণু,শিব,মত্স,পদ্ম,ব্রহ্ম,ভাগবত,নারদ,অগ্নি,ভবিষ্য,বামন,ব্রহ্মান্ড,ব্রহ্মবৈবর্ত। এছাড়াও অনেক উপপুরাণ আছে। এসমস্ত পুরানের কাহিনী ইত্যাদি আলোচনা করলে ও বোঝার চেষ্টা করলে সহজেই বোঝা যাবে যে সবেতেই সেই সর্বশক্তিমান পরমাত্মার উপাসনারই কথা বলা হয়েছে। যেখানে বেদের উপনিষদ অংশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরাসরি পরমব্রহ্মের কথা আছে সেখানে পুরাণে সরাসরি সেভাবে না থাকলেও পুরোটাই প্রায় রূপকার্থে বর্ণনা করা হয়েছে।কিন্তু ভাব বা উদ্দেশ্য সেই এক। তন্ত্র হল সর্বাপেক্ষা আধুনিক শাস্ত্র।
হিন্দুধর্মের শাস্ত্র সম্পর্কে বলতে গেলে যাকে নিয়ে একটু বেশী আলোচনা করা উচিত তা হল ঋকবেদ। পৃথিবীর মধ্যে ঋকবেদ সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ। ঋকবেদের মধ্যে যদিও প্রকৃতির একাধিক বিষয়ে সমূহের মধ্যে ইশ্বর কল্পনা করে পূজার বিধি দেখা যায় তথাপি সে যুগের মানুষ যে একমাত্র একজন ইশ্বরের কথা জানতেন না তা ভুল। ঋগ্বেদের একটি লাইনে আছে : "সত্যং জ্ঞানং অনন্তং ব্রহ্ম"। এর থেকেই বোঝা যায় যে ঋগ্বেদ থেকেই একজন সত্য ব্রহ্মকেই উপাসনার কথা হয়ে এসেছে। সেই আদিম আর্যগণ সেই সময় থেকেই বুঝেছিলেন যে ঈশ্বর মানুষের পিতা মাতা। তিনিই সৃষ্টি কর্তা। তাই তাঁরা লিখেছিলেন "ত্বং হি ন: পিতা বসো ত্বং হিনো মাতা"। অর্থাৎ তুমিই আমাদিগের পিতা, তুমিই আমাদিগের মাতা। তাঁরা ঈশ্বরকে সখা হিসাবে বন্ধু হিসাবেও দেখেছিলেন। তাই লিখেছিলেন "সখা পিতা পিতৃতম: পিতৃনাম"। তাঁরা জেনেছিলেন ঈশ্বরের সখ্যতা সুস্বাদু। তাই বলেছেন "স্বাদু সখ্যং স্বাদ্বীপ্রনীতি:"। আবার সকলেই যে এক, অর্থাৎ যাকে বলা হয় অদ্বিতীয় বেদান্ত দর্শন তা ঋক্বেদের এই লাইনটি পড়লেই বোঝা যায়: "ত্বমস্মাকং তবাস্মি", অর্থাৎ তুমি আমাদের ও আমরা তোমার।
No comments:
Post a Comment