১৯৪৭ সালে তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে হিন্দুর সংখ্যা ছিল অন্যূন ২৯%; ১৯৭১ সালে ১৯.৬%। অর্থাৎ পাকিস্তান আমলের পঁচিশ বছরে কমেছে প্রায় ১০%। বাংলাদেশ আমলে এখন বলা হচ্ছে হিন্দুর সংখ্যা ৯%। তাহলে চার দশকে কমেছে ১০%। এভাবে অঙ্ক কষলে দেখা যাবে ২০৫০-এর দিকে বাংলাদেশ হিন্দু শূন্য হয়ে যাবে। পাকিস্তান একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র, তদুপরি পাক-ভারত জনসংখ্যা বিনিময়, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ইত্যাদি কারণে হিন্দু কমে যাওয়াটা তেমন বেমানান ছিল না। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে হিন্দু কমার গ্রহণযোগ্য কোনো কারণ নেই, অন্তত থাকার কথা নয়, তবু অনবরত কমছে তো কমছেই। এর কোনো ন্যায়সঙ্গত যৌক্তিক ব্যাখ্যা কারো কাছে নেই, যদিও অনেকে অনেক আবোল-তাবোল তথ্য দিতে পারেন।
ঢালাওভাবে অনেকে বলে থাকেন যে, কোনো মুসলমান দেশে অমুসলমানরা থাকতে পারে না। মুসলিম বিশ্বের দিকে তাকালে কথাটা তেমন অযৌক্তিক মনে হবে না। কিন্তু বাংলাদেশের জন্যও কি তা প্রযোজ্য হবে? নিউইয়র্কে জন্মভূমির সম্পাদক রতন তালুকদার প্রায়শ বলে থাকেন, ‘বাংলাদেশে যখন হিন্দু থাকবে না, তখন মুসলমানরা পাকিস্তানের মতো নিজেদের মধ্যে মারামারি করবে।’ ইরাক-সিরিয়া বা আফ্রিকার দিকে তাকালে তা সত্যই মনে হয়। এমনিতে বিশ্বব্যাপী শিয়া-সুন্নি বিরোধ আগামী দিনগুলোতে জ্যামিতিক হারে বাড়বে। আহমদিয়ারাও বাদ যাবে না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হিন্দুরা হলো ‘ডিটারেন্ট ফ্যাক্টর’ এবং হিন্দু না থাকলে নিজেদের মধ্যে ফাইট অনিবার্য। কারণ মৌলবাদের ধর্মই হচ্ছে, বিভেদ সৃষ্টি করে অন্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, ধর্ম এ ক্ষেত্রে একটি চমৎকার উপাদান। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র এ জন্যই বিপজ্জনক।
আমাদের দেশের বর্তমান সরকার ধর্মনিরপেক্ষতার চ্যাম্পিয়ন বলে দাবিদার, তারা বলছেন, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করবেন। জঙ্গি সংগঠন জেএমবি বলছে, ২০২০ সালের মধ্যে তারা বাংলাদেশকে ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করবে। কোনটি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি অথবা দুটোই একসঙ্গে হতে পারে কিনা বা দুটোই শুধুমাত্র স্লোগান কিনা তা ভেবে দেখা দরকার। বাংলাদেশের হিন্দুরা ভাবে তারা শেষ পর্যন্ত নিজ দেশে থাকতে পারবেন না। ‘জননী-জন্মভূমি স্বর্গাদপী গরিয়সী’- অর্থাৎ মা ও মাতৃভূমি হিন্দুদের কাছে স্বর্গ-সমান হলেও চৌদ্দপুরুষের ভিটেমাটি থেকে হিন্দু প্রতিনিয়ত বিতাড়িত। পাশের দেশ ভারত। তারাও জানে, হিন্দুরা থাকতে পারবে না, চলে আসবে। এ ক্ষেত্রে বিজেপি ও কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি একই। বর্তমান বিজেপি সরকারের তো হিন্দুদের গ্রহণ করার জন্য অবারিত দ্বার এবং এ জন্য তারা কিছু আইনও প্রণয়ন করছে।
অর্থাৎ বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠরা চান হিন্দুরা ভারত চলে যাক, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠরাও চায় বাংলাদেশের হিন্দুরা ভারতে চলে আসুক। দুদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে কী চমৎকার মিল! যদিও দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। একপক্ষ অসহায়দের আশ্রয়হীন করতে চাচ্ছে, অন্যপক্ষ আশ্রয়হীনকে আশ্রয় দিতে চাচ্ছে। একজনের অনুদার ও অন্যজনের উদার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের হিন্দু। অনেকেই মনে করেন, ভারত চাইলেই বাংলাদেশের হিন্দুরা নিজ দেশে শান্তিতে বসবাস করতে পারে। কথাটার বাস্তবতা কতটা তা বলা মুশকিল, কিন্তু ভারত তা করবে না, যেমন করেনি অতীতে। এবার মোদির আগমনে অনেকেই চেয়েছেন হিন্দু নির্যাতনের ব্যাপারে তিনি কিছু বলুন, তিনি বলেননি, বলার কথাও না। কারণ হিন্দুরা দয়ার পাত্র। ভিক্ষুকের জন্য কেউ বন্ধুত্ব নষ্ট করে?
বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান দিনে দিনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যদিও ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান’ একটি দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত- বর্তমান উন্নত বিশ্ব এর প্রমাণ। হিন্দুরা না থাকলে সহাবস্থান যেমন থাকবে না, শান্তিও থাকার কথা নয়। পাকিস্তানকে দেখেও আমাদের তা শেখার কথা ছিল, আমরা শিখছি কোথায়! অবশ্য কিছু মানুষ আছেন, যারা অশান্তিতে থাকতেও রাজি, কিন্তু হিন্দুর সাথে থাকতে রাজি নন। তাদের কথা ভিন্ন, রাষ্ট্রযন্ত্রটি কী চায় তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। রাষ্ট্র না চাইলে হবে না। রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর প্রয়োজন। রাষ্ট্র হবে ধর্ম নির্বিশেষে সবার। সমস্যা হলো, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি বেশির ভাগ সময় পরিচালিত হয়েছে পাকিস্তানি ধ্যান-ধারণায়। তাই এটি সব মানুষের ছিল না, ছিল একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর। হিন্দুরা সেখানে অবহেলিত থেকেছেন। এবং এখনো তারা উপেক্ষিত।
তাহলে কি এ সমস্যার সমাধান নেই? আপাতদৃষ্টিতে নেই। ভারতই হিন্দুর চূড়ান্ত গন্তব্য। তা কবি শামসুর রাহমান যতই ‘সুধাংশু যাবে না’ কবিতা লিখুন না কেন! সুধাংশুদের যাওয়া ছাড়া রাস্তা নেই, সুধাংশু তোমায় যেতেই হবে, আজ না হয় কাল। যদি না আমীর হোসেনের মতো উদারমনা মানুষ সাম্প্রদায়িকতা রুখতে নিজের জীবন বিসর্জন দেন। কিন্তু আমীর হোসেনরা তো হারিয়ে গেছেন! এই সেই দেশ যেখানে ৬৪-৬৫র দাঙ্গার সময় আমীর হোসেন হিন্দুদের রক্ষায় র্যাংকিন স্ট্রিটে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন। এই সেই বাংলা যেখানে একদা কবি গাইতেন, ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’। সেই দেশ, সেই দিন আর আসলেই নেই। কারণ রাষ্ট্র আমাদের মানুষ বানায়নি, বানিয়েছে হিন্দু বা মুসলমান। শুধুই কি নিরাশার কথা শুনালাম? না, আরো একটি সমাধান অবশ্য আছে! সেটা হলো, হিন্দুদের ঘুম থেকে গা-ঝাড়া দিয়ে জেগে ওঠা। কারো দয়ার পাত্র না হওয়া।
নিউইয়র্ক, ১৩ জুন ২০১৫।
শিতাংশু গুহ : কলাম লেখক।
দৈনিক ভোরের কাগজের সৌজন্যে
No comments:
Post a Comment