ওঁ বা ওঁ-কার (অপর বানানে ওঙ্কার)[সংস্কৃত, অ + উ +ম্]। বা প্রণব বা ত্র্যক্ষর হিন্দুধর্মের পবিত্রতম
ও সর্বজনীন প্রতীক। এটি হিন্দু দর্শনের সর্বোচ্চ ঈশ্বর ব্রহ্মের বাচক। এই ধর্মের প্রতিটি সম্প্রদায় ও উপসম্প্রদায়ের নিকটেই এটি
পবিত্র বলে গণ্য। ওঁ-কার বৌদ্ধ ও জৈনদেরও একটি পবিত্র প্রতীক।
শিখ সম্প্রদায়ও এটিকে সম্মান করেন। এই প্রতীকের দেবনাগরী রূপ
ॐ, চীনা রূপ
唵, এবং তিব্বতীয় রূপ ༀ। ওঁ- কার বাংলায় এবং ঔঁ-কার সংস্কৃতিতে। শ্রী শ্রী
স্বামী স্বরুপানন্দ পরমহংসদেব বলেছেন- “ওঁ, ওম,
ঔং, অউম, ঔঁ”
এই পাঁচ প্রকার উচ্চারণের মধ্য বস্তুগত বা অর্থগত কোনো পার্থক্য
নেই।
ওঁ শব্দটি সংস্কৃত ‘অব’ ধাতু থেকে উৎপন্ন, যা একাধারে ১৯টি ভিন্ন ভিন্ন অর্থে প্রযোজ্য। এই ব্যুৎপত্তি অনুযায়ী
ওঁ-কার এমন এক শক্তি যা সর্বজ্ঞ, সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের
শাসনকর্তা, অমঙ্গল থেকে রক্ষাকর্তা, ভক্তবাঞ্ছাপূর্ণকারী, অজ্ঞাননাশক ও
জ্ঞানপ্রদাতা। ওঁ-কারকে
ত্র্যক্ষরও বলা হয়, কারণ ওঁ তিনটি মাত্রাযুক্ত – ‘অ-কার’, ‘উ-কার’ ও ‘ম-কার’। ‘অ-কার’ ‘আপ্তি’ বা ‘আদিমত্ত্ব’ অর্থাৎ প্রারম্ভের প্রতীক। ‘উ-কার’ ‘উৎকর্ষ’ বা ‘অভেদত্ব’-এর প্রতীক। ‘ম-কার’ ‘মিতি’ বা ‘অপীতি’ অর্থাৎ লয়ের প্রতীক। অন্য
ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এটি সৃষ্টি, স্থিতি ও
প্রলয় সংঘটনকারী ঈশ্বরের প্রতীক।
‘প্রণব’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ, ‘যা উচ্চারণ করে স্তব
করা হয়’। এর
অপর অর্থ, ‘যা চিরনূতন’।
ওঁ-ই সৃষ্টির আদি শব্দ।মহাবিশ্বের
মহাবিস্ফোরণ এর মাধ্যমে সৃষ্টি ওঁ। নির্গুণ-নিস্ক্রিয় ব্রহ্মের এ সক্রিয় ভাব। (মনে রাখবেন ব্রহ্ম আর
ব্রহ্মা এক নয়।ব্রহ্ম অর্থাৎ ঈশ্বর আর ব্রহ্মা ঈশ্বরের একটি রূপ বা দেবতা) এই
সক্রিয় ভাব হতেই সৃষ্টির বিকাশ। তাই, যেকোনো কাজের
শুরুতেই “ওঁ তৎ সৎ ” উচ্চারণ
করুন এবং পূজার সময় প্রথমে “ওঁ” উচ্চারণ
করে মন্ত্রপাঠ শুরু করুন। ওঁ -প্রণব(ব্রহ্ম), তৎ-জীব, সৎ-জগৎ।
ব্রহ্মের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ বেদ। জীবের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ব্রহ্মজ্ঞ। জগত কর্মময়। কর্মের
শ্রেষ্ঠ প্রকাশ যজ্ঞ। সুতরাং, “ওঁ তৎ সৎ” মন্ত্রে বেদ, ব্রহ্মজ্ঞ ও যজ্ঞকে বোঝায়। তাই,
আমাদের সকল কাজের শুরুতেই “ওঁ তৎ সৎ ”
উচ্চারণ করে শুরু করা উচিৎ।
প্রণব বা ওঁ-কারই বেদের নির্যাস ও ব্রহ্মবস্তু।
ওঁ বা প্রণব হচ্ছে মন্ত্রের প্রাণ। পূজা বা ধ্যানের সময় মন্ত্র উচ্চারণে “প্রণব” না থাকলে মন্ত্রের ক্রিয়া হয় না, প্রাণশক্তি
নেই বলে। অথচ, পূজার সময় অনেক পুরোহিতরা মন্ত্রের শুরুতে “ওঁ” উচ্চারন না করে; “নমো” বলে মন্ত্র শুরু করান। যা কোনভাবেই
গ্রহণযোগ্য নয়, একটি ভুল পদ্ধতি।
ওঁ-কার ঈশ্বরের সকল নামের প্রতিনিধিস্বরূপ ও
তাঁর শ্রেষ্ঠ নাম। বেদ, উপনিষদ, গীতা ও
অন্যান্য হিন্দুশাস্ত্রে সর্বত্রই ওঁ-কারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
অথর্ববেদের গোপথব্রাহ্মণের একটি কাহিনি অনুসারে দেবরাজ ইন্দ্র ওঁ-কারের সহায়তায় দৈত্যদের পরাস্ত করেন। এই
কাহিনির অন্তর্নিহিত অর্থ,
ওঁ-কারের বারংবার উচ্চারণে মানুষ তার পাশব
প্রবৃত্তি জয় করতে সমর্থ হয়। কঠোপনিষদ মতে,
ওঁ-কার পরব্রহ্ম। মুণ্ডক উপনিষদে ওঁ-কার অবলম্বনে ঈশ্বরোপাসনার কথা বলা
হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন,
তিনি সকল অক্ষরের মধ্যে ওঁ-কার।এই
সম্পর্কে গীতায় (৭ অধ্যায় /৮ নং শ্লোক) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,
“আমি জলের রস, চন্দ্র-সূর্যের কিরণ, বেদের ওঁ(প্রণব), আকাশে শব্দ ও মানুষের মধ্য
পুরুষত্ব রূপে বিরাজ করি।”
মৃত্যুকালে ওঁ-কারের উচ্চারণে পরম সত্য লাভ হয়। পতঞ্জলির যোগসূত্র-এ ওঁ-কারকে
ঈশ্বরের প্রতীক বলে বর্ণিত হয়েছে এবং বলা হয়েছে,
ওঁ-কারের স্মরণ ও উচ্চারণে সমাধি লাভ করা
যায়।যোগদর্শনের শ্রেষ্ঠ আচার্য পতঞ্জলি
যোগসূত্রে সমাধিপাদে(১ম,
২৭-২৮) বলেছেন,
“তস্য বাচকঃ প্রণবঃ। তজ্জপস্তুদর্থভাবনম্।”- প্রণব
ঈশ্বরের নাম। তাঁর জপ ও চিন্তা করনীয়।
স্বামী বিবেকানন্দেরমতে, ওঁ-কার “সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক,
ঈশ্বরেরও প্রতীক।রামকৃষ্ণ পরমহংসের মতে,
“...ওঁ হইতে ‘ওঁ শিব’, ‘ওঁ কালী’,
‘ওঁ কৃষ্ণ
হয়েছেন।”
এ
প্রসঙ্গে রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের খুব সুন্দর একটি লেখা আছে। তার থেকে কিছু অংশ তুলে
দিলাম।“ সাধনা-দ্বারা
আমরা ব্রহ্মকে যত দূর জানিয়াছি যেমন করিয়াই পাইয়াছি, এই ওঁ শব্দে তাহা সমস্তই ব্যক্ত করে, এবং ব্যক্ত করিয়াও সেইখানেই রেখা টানিয়া দেয় না। সঙ্গীতের স্বর যেমন গানের
কথার মধ্যে একটি অনির্ব্বচনীয়তার সঞ্চার করে তেমনি ওঁ শব্দের পরিপূর্ণ ধ্বনি
আমাদের ব্রহ্মধ্যানের মধ্যে একটি অব্যক্ত অনির্ব্বচনীয়তা অবতারণা করিয়া থাকে।
বাহ্য প্রতিমাদ্বারা আমাদের মানস ভাবকে খর্ব্ব ও আবদ্ধ করে, কিন্তু এই ওঁ ধ্বনির দ্বারা আমাদের মনের ভাবকে
উন্মুক্ত ও পরিব্যাপ্ত করিয়া দেয়।সেই জন্য
উপনিষদ্ বলিয়াছেন— ওমিতি ব্রহ্ম। ওম্ বলিতে ব্রহ্ম বুঝায়। ওমিতীদং সর্ব্বং, এই যাহা
কিছু সমস্তই ওঁ। ওঁ শব্দ সমস্তকেই সমাচ্ছন্ন করিয়া দেয়। অর্থবন্ধনহীন কেবল একটি
সুগম্ভীর ধ্বনিরূপে ওঁ শব্দ ব্রহ্মকে নির্দ্দেশ করিতেছে। আবার ওঁ শব্দের একটি
অর্থও আছে— সে অর্থ এত উদার যে তাহা মনকে আশ্রয় দানন করে, অথচ কোন
সীমায় বদ্ধ করে না।
আধুনিক সমস্ত ভারতবর্ষীয় আর্য্য ভাষায় যেখানে আমরা হাঁ বলিয়া থাকি
প্রাচীন সংস্কৃতভাষায় সেইখানে ওঁ শব্দের প্রয়োগ। হাঁ শব্দ ওঁ শব্দেরই রূপান্তর
বলিয়া সহজেই অনুমিত হয়। উপনিষদ্ও বলিতেছেন ওমিত্যেতদ্ অনুকৃতির্হ স্ম— ওঁ শব্দ
অনুকৃতিবাচক, অর্থাৎ ‘ইহা করো’ বলিলে, ওঁ অর্থাৎ হাঁ বলিয়া সেই আদেশের অনুকরণ করা হইয়া থাকে। ওঁ
স্বীকারোক্তি।
এই স্বীকারোক্তি ওঁ, ব্রহ্ম-নির্দ্দেশক শব্দরূপে
গণ্য হইয়াছে। ব্রহ্মধ্যানের কেবল এইটুকুমাত্র অবলম্বন— ওঁ, তিনি হাঁ।
ইংরাজ মনীষী কার্লাইলও তাঁহাকে Everlasting Yea অর্থাৎ শাশ্বত ওঁ বলিয়াছেন।
এমন প্রবল পরিপূর্ণ কথা আর কিছুই নাই, তিনি হাঁ, ব্রহ্ম ওঁ।...
উপনিষদের ঋষিগণ বলিলেন জগতে ও জগতের বাহিরে
ব্রহ্মই একমাত্র ওঁ, তিনি চিরন্তন হাঁ,তিনিই Everlasting
Yea। আমাদের
আত্মার মধ্যে তিনি ওঁ, তিনিই হাঁ,বিশ্বব্রহ্মান্ডের মধ্যে তিনি ওঁ, তিনিই হাঁ; এবং বিশ্বব্রহ্মান্ড দেশকালকে অতিক্রম করিয়া তিনি ওঁ, তিনি হাঁ।এই মহান্ নিত্য এবং সর্ব্বব্যাপী যে হাঁ, ওঁ ধ্বনি ইঁহাকেই নির্দ্দেশ করিতেছে, প্রাচীন ভারতে ব্রহ্মের কোন প্রতিমা ছিল না, কোন চিহ্ন ছিল না— কেবল এই একটিমাত্র ক্ষুদ্র অথচ সুবৃহৎ ধ্বনি ছিল ওঁ। এই ধ্বনির সহায়ে ঋষিগণ
উপাসনানিশিত আত্মাকে একাগ্রগামী শরের ন্যায় ব্রহ্মের মধ্যে নিমগ্ন করিয়া দিতেন। এই
ধ্বনির সহায়ে ব্রহ্মবাদী সংসারীগণ বিশ্বজগতের যাহা কিছু সমস্তকেই ব্রহ্মের দ্বারা
সমাবৃত করিয়া দেখিতেন।ওমিতি সামানি গায়ন্তি। ওঁ বলিয়া সাম সকল গীত হইতে
থাকে। ওঁ আনন্দধ্বনি। ওঁ সঙ্গীত। তদ্বারা প্রেম উদ্বেলিত ও ব্যাপ্ত হইতে থাকে। ওঁ
আনন্দ।
ওমিতি ব্রহ্মা প্রসৌতি। ওঁ আদেশবাচক। ওঁ বলিয়া ঋত্বিক্ আজ্ঞা প্রদান
করেন। সমস্ত সংসারের উপর, আমাদের সমস্ত কর্ম্মের উপর, মহৎ আদেশ-রূপে নিত্যকাল ওঁ
ধ্বনিত হইতেছে। জগতের অভ্যন্তরে এবং জগতকে অতিক্রম করিয়া যিনি সকল সত্যের পরম সত্য, আমাদের
হৃদয়ের মধ্যে তিনি সকল আনন্দের পরমানন্দ,এবং আমাদের কর্ম্মসংসারে
তিনি সকল আদেশের পরমাদেশ। তিনি ওঁ।
ওঁ
ReplyDelete