শুরুতেই জানা দরকার বাংলা দিনপঞ্জিকা আসলে কি বা এটি তৈরীর ভিত্তিটা কি?
প্রতিটি দিনপঞ্জিকা তৈরী হয় কিছু বিশেষ ভিত্তিতে। ভিত্তিগুলোকে এভাবে ভাগ করা যায়-
১)চান্দ্র
২)চান্দ্র-সৌর
৩)সৌর
যেমন হিজরী ক্যালেন্ডার হল এমন একটি ক্যালেন্ডার যেটি বার চান্দ্র মাসের সমন্বয়ে গঠিত। চাঁদ পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিন করতে ২৯.৫৩ দিন সময় নেয় তাই এক চান্দ্রমাস=২৯.৫৩ দিন তাই এক হিজরী বছর হচ্ছে বার চান্দ্রমাস=৩৫৪.৩৬ দিন। অর্থাত্ এটি একটি চান্দ্র বর্ষপঞ্জিকা। এর সাথে সূর্যের গতি বা অবস্থানের কোন সম্পর্ক নেই। এটি বর্তমানে আরবদেশসমূহে শুধুমাত্র ধর্মীয় কার্যে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু যেহেতু একবছর=৩৬৫ দিন সেহেতু এই ক্যালেন্ডারে প্রায় ১১ দিন তা থেকে কম হয়ে যায়। ফলস্বরুপ যা হয় তা হল হিজরী ক্যালেন্ডার এর সাথে ঋতুসমূহের কোন সম্পর্ক নেই। আর এই ব্যপারটিতেই নিহিত পহেলা বৈশাখ উদযাপনের ইতিহাস।তবে তাতে একটু পড়ে আসছি।
আরো আছে সৌর দিনপঞ্জিকা অর্থাত্ সূর্যের প্রেক্ষিতে পৃথিবীর অবস্থান অনুসারে যে দিনপঞ্জিকা তৈরী করা হয় যেমন গ্রেগরিয়ান বা ইরানিয়ান দিনপঞ্জিকা। এই ধরনটাই বর্তমান যুগে অফিসিয়াল কাজের জন্য সমধিক প্রচলিত কেননা এর কোন বিশেষ দিন ঠিক করার বা ফসল উত্পাদনের বা আবহাওয়া নির্নয়ের তাগিদ নেই। পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিনের জন্য প্রয়োজনীয় ৩৬৫.২৫ দিনকে ৩৬৫ টি ভাগে ভাগ করে এই ক্যালেন্ডারটিকে তৈরী হয়। বাকী ০.২৫ দিনকে ব্যলেন্স করার জন্য প্রতি ৪ বছর পরপর(০.২৫*৪=১) দিন ফেব্রুয়ারী মাসে অতিরিক্ত যোগ করা হয়।
কিন্তু যদি এমন একটি দিনপঞ্জিকা আপনি বানাতে চান যেটা দিয়ে সঠিকভাবে বছর গননার পাশাপাশি আপনি নির্দিষ্ট বা পবিত্র দিনসমূহ আগে থেকেই সনাক্ত করে রাখতে চান এবং সাথে সাথে ঋতুসমূহ ও নির্দিষ্ট ফসলের জন্য উপযুক্ত সময় এবং আবহাওয়া এর অবস্থাও জেনে রাখতে চান? সেক্ষেত্রে আপনাকে পৃথিবীর সাপেক্ষে চন্দ্র-সূর্য এবং নক্ষত্রসমূহের গতিপথ ও অবস্থান বিবেচনা করেই দিনপঞ্জিকা বানাতে হবে । এবং পৃথিবীর সর্বপ্রথম এবং বিশদ চান্দ্র-সৌর বর্ষপঞ্জিকা হল হিন্দু বর্ষপঞ্জিকা যার প্রভাব তখনকার যুগে চীন,গ্রীস এবং ইসলামপূর্ব আরবেও ব্যপ্ত ছিল।
কিভাবে তৈরী করা হয় এই ক্যালেন্ডারটি? আমরা সকলের জানি যে চাঁদ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিন করে আবার পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে এবং সূর্যও তার নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমন করে। এই পরিভ্রমন পথের মধ্যে মোট ২৮টি নক্ষত্র রয়েছে।প্রতিটি নক্ষত্রের ব্যাসার্ধকে চাঁদ তার গতিপথ বরাবর প্রায় একদিনে(একদিনের কিছু কম সময়ে) পরিভ্রমন করে। তাই ২৮টি নক্ষত্রকে পরিভ্রমন করতে চাঁদের ২৭.৩২ দিন সময় লাগে ।এই সময়টিকে বলে এক চান্দ্রমাস। প্রতিটি নক্ষত্রের ব্যাসার্ধকে আবার সমান চারভাগে ভাগ করা হয় যার প্রত্যেকটিকে একটি করে পদ বলা হয়। এই আটাশটি নক্ষত্রের নাম প্রথম পাওয়া যায় পবিত্র অথর্ববেদের নক্ষত্র সুক্তে(১৯.৮)।
এখন আসি সূর্যের কাছে। চাঁদের এই পরিভ্রমন পথে যেমন ২৮টি নক্ষত্র দেখা যায় ঠিক তেমনি এই পথে গুরুত্বপূর্ন ৯টি অবস্থান বা বস্তু অবস্থিত। এদেরকে নবগ্রহ বলা হয়। এরা হল- "মঙ্গল,বুধ,বৃহস্পতি,শুক্র,শনি,রবি(সূর্য),সোম(চন্দ্র),রাহু,কেতু।" এখানে উল্লেখ্য যে রাহু এবং কেতু হল সেই দুটি বিন্দু যেখানে চন্দ্রের এবং সূর্যের কক্ষপথ পরস্পরকে ছেদ করে।ওই দুটি বিন্দুকে আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষায় যথাক্রমে এসেন্ডিং এবং ডিসেন্ডিং সোলার নোডিউলস বলে। এই বিন্দুদ্বয়ে চন্দ্র ও সূর্য একত্রে অবস্থান করলে চন্দ্রের কারনে আমরা পৃথিবী থেকে সূর্যের আলো অথবা সূর্যের কারনে চাঁদকে দেখতে পাইনা অর্থাত্ চন্দ্রগ্রহন বা সূর্যগ্রহন হয়। ভারতবর্ষীয় এ দিনপঞ্জিকার অন্যতম বৈশিষ্ঠ্য হল যে এখানে সূর্যোদয়ের সাথে একটি দিন শুরু হয় যেখানে ইংরেজী ক্যলেন্ডারে মধ্যরাত থেকে তা শুরু হয়। এখন তাহলে আমরা এই বর্ষপঞ্জিকায় একই সাথে চন্দ্র,সূর্য,নবগ্রহ ও নক্ষত্রসমূহের সাথে পৃথিবীর তূলনামুলক অবস্থান জানতে পারি। এইজন্য দেখা যায় যে হিন্দুদের পঞ্জিকায় আগে থেকেই গানিতিক এই পদ্ধতিতে বিজয়া দশমী,ঈদ,বুদ্ধপূর্নিমা প্রভৃতির তারিখ অনেক আগে থেকেই বলে দেয়া থাকে,চাঁদ ওঠার অপেক্ষায় বসে থাকতে হয়না।
একটা উদাহরন দেই। বাল্মীকি রামায়নের ১.৮.৮-১০ এ শ্রীরামচন্দ্রের জন্মদিনের বিবরন দেয়া আছে এভাবে-
১.রবি অশ্বিনীতে(Sun in aries) অর্থাত্ সেদিন সূর্য এবং অশ্বিনী বা Aries নামক নক্ষত্রটি একই সরলরেখায় অবস্থিত ছিল।
২.সোম বা চন্দ্র ছিল Pollux বা পূনর্বসু নামক নক্ষত্রের সাথে একই সরলরেখায়।
৩.শনি ছিল বিশাখা বা Librae নামক নক্ষত্রের সরলরেখায়।
৪.বুধগ্রহ ছিল রেবতী বা Pisces নামক নক্ষত্রের সমান্তরালে।
সুতরাং বিজ্ঞানীরা খুব সহজেই এই বর্ননা দেখে বের করেছেন যে তারিখটি ছিল ১০ ই জানুয়ারী। অর্থাত্ চন্দ্র,সূর্য,গ্রহ ও নক্ষত্র প্রত্যেকটির অবস্থানেরই নিখুঁত বর্ননা থাকায় এই চান্দ্র-সৌর বর্ষপঞ্জিকা পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা সহজেই যেকোন দিন আগে থেকেই বের করে ফেলতে পারি। ধরুন আপনি যদি জানতে চান ২০৩০ সালে বিজয়া দশমী কয় তারিখ পড়বে বা ২০৩৫ সালে ঈদ উল আযহা কয় তারিখ তা জানার জন্য আপনাকে চাঁদ দেখার জন্য বসে থাকতে হবেনা। আপনি সহজেই তা জেনে নিতে পারবেন চান্দ্র-সৌর বর্ষপঞ্জিকা পদ্ধতির মাধ্যমে।
এখন পহেলা বৈশাখ কখন? বিজ্ঞানসম্মতভাবে সূর্য যেইদিন Eliptic এ ৩ ডিগ্রী ২০মিনিট অক্ষাংশে বিশাখা বা Librae নামক নক্ষত্রের সাথে এক সরলরেখায় অবস্থান নেবে তখন থেকে পহেলা বৈশাখ শুরু হবে আর এই অবস্থানের সূচনা হবে আগামীকাল সূর্যোদয়ের সময় অর্থাত্ বৈজ্ঞানিকভাবেই বৈশাখ মাসের শুরু তথা পহেলা বৈশাখ কাল (১৫ এপ্রিল) ,আজ (১৪ এপ্রিল) নয়। তাহলে বাংলাদেশে কেন তা আজকে (১৪ এপ্রিল) পালন করা হচ্ছে?
আনুষ্ঠানিকভাবে গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক প্রথম বাংলা বর্ষপঞ্জিকাকে লিপিবদ্ধ করান। মোঘল শাসন শুরু হলে মোঘলরা তাদের ধর্মীয় দৃষ্টিকোন বিবেচনায় হিজরী ক্যালেন্ডার অনুসারে দেশ চালাতে লাগলেন ।কিন্তু ওই যে আগেই বললাম,তারা এতে মারাত্মক অসুবিধার সম্মুখীন হলেন। কেননা হিজরী ক্যালেন্ডারের সাথে ঋতু, ফসল ফলন কিছুই মেলেনা যার কারনে কর সংগ্রহ প্রায় অসম্ভব হয়ে পরে।এমতাবস্থায় মোঘল সম্রাট আকবর পুনরায় বাংলা বর্ষপঞ্জিকা চালু করেন যাকে ফসল উত্পাদনের সময় নির্দেশ করতে পারার গুনের কারনে "ফসলি সন" বলা হত পরবর্তীতে যা বঙ্গাব্দ বলে পরিচিত হয়।এজন্য অনেকে বলে থাকেন আকবর নাকি বাংলা বর্ষ পঞ্জির উদ্ভাবক যা একে বারে ভুল। আসলে নানা সমস্যার কারনে অবৈজ্ঞানিক হিজরি পঞ্জিকে স্থগিত করে পুনরায় বাংলা বর্ষ পঞ্জিকে রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহার শুরু করেন,যে বর্ষ পঞ্জির মাধ্যমে সময় গণনা আকবরের জন্মেরও অনেক আগে থেকে এ অঞ্চলে প্রচলিত ছিল।তবে অনেক রাজা তাঁদের নাম, কিংবা রাজত্ব গ্রহনের বছর কে স্মরণীয় রাখার জন্য আবার এক থেকে বছর গণনার আদেশ জারি করেছিলেন বিভিন্ন সময়।
পাকিস্তান ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশে এই ক্যালেন্ডারটিতে ভারতবিরোধী স্রোতের কারনে কিছু পরিবর্তন আনার চিন্তা করা হয়।১৯৬৬ সালের ১৭ ই ফেব্রুয়ারী মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি একে সম্পূর্ন ইংরেজী ক্যালেন্ডারের অনুকরনে সাজানোর প্রস্তাব দেন এবং ফলস্বরুপ এর স্বকীয়তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তাদের প্রস্তাবনাগুলো ছিল এরুপ-
১.বৈশাখ থেকে ভাদ্র পর্যন্ত প্রথম পাঁচ মাস ৩১ দিনে হবে।
২.চৈত্র থেকে আশ্বিন পরবর্তী সাতমাস ৩০ দিনে হবে।
৩.প্রতি লিপ ইয়ারে ফাল্গুন মাসের সাথে এক দিন যুক্ত হবে।
পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে রাষ্ট্রপতি এরশাদ পহেলা বৈশাখ যাতে 'হিন্দু ক্যালেন্ডার' এর সাথে না মেলে সেজন্য পহেলা বৈশাখকে রাষ্ট্রীয়ভাবেই একদিন আগে ১৪ই এপ্রিল নির্দিষ্ট করে দেন। সেজন্যই বাংলাদেশের হিন্দুদের দুবার এই পহেলা বৈশাখ পালন করতে হয়। একবার বাংলাদেশী হিসেবে ১৪ তারিখ যা প্রকৃতপক্ষে অন্যায়ভাবেই প্রযোজ্য করা হয়েছে আর একবার ১৫ ই এপ্রিল যা বৈজ্ঞানিকভাবেই ধ্রুব সত্য। অবশ্য কয়টা জাতি ই বা নববর্ষ দুদিন পালনের দূর্লভ সুযোগ পায়!
ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি!!!
লেখাটি প্রকাশ করা হয়েছে VEDA, The infallible word of GOD এর সৌজন্যে।
No comments:
Post a Comment