কুলদা রায়
১৯৫০ সালের কোলকাতায় একটা ছোটোখাটো দাঙ্গা হয়েছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে খবর রটেছিল কোলকাতায় একে ফজলুল হকের এক আত্মীয়কে হিন্দুরা মেরে ফেলেছে। ফলে তীব্রভাবে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় আক্রান্ত হয় হিন্দুরা। এটা ছিল পাকিস্তান সরকারের একটা পরিকল্পনা। সরকার সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেয়।
সে সময় ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় মেরে ফেলা হয় ৯ দিনে দশ হাজার হিন্দুকে। শুরু হয়েছিল ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। বরিশালের মাধবপাশার জমিদার বাড়ির ২০০ জন মানুষকে হত্যা করা হয়। এ এলাকার তীব্র আক্রান্ত গ্রাম হল লাকুটিয়া এবং কাশিপুর।
তবে সে সময়ে মুলাদীর নদী লাল হয়ে গিয়েছিল মানুষের রক্তে। বরিশালে মেরে ফেলা হয়েছিল ২৫০০ হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষকে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বাড়িঘর। লুটপাট করা হয়েছিল সহায়-সম্পদ। ধর্ষণের শিকার হয়েছিল অসংখ্য নারী। দখল করা হয়েছিল অনেকের জমিজমা। এরা সবাই নমশুদ্র।
সে সময়ে এই নিম্নবর্গের নমশুদ্র জনগোষ্ঠীর লোকজন ব্যাপকভাবে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তারা সবকিছু হারিয়ে চলে আসে পশ্চিম বঙ্গে। পশ্চিম বঙ্গে তখন পূর্ববাংলার রিফুইজিদের জায়গা দিতে পারছিল না। ফলে তাদের এক বড় অংশকেই পাঠিয়ে দেওয়া হয় আন্দামানে, দণ্ডকারণ্যে। তারা যেতে চায়নি। তাদেরকে টেনে হিচড়ে জোর করে পাঠানো হয়েছিল এইসব এলাকায়। সেখানে দাসদের মত তাদেরকে বাধ্য করা হয়েছিল বনকেটে বসত বানাতে। অনেকেই সেখানে মারা গিয়েছে না খেয়ে। অনাহারে। অর্ধাহারে। রোগে। শোকে। মারী ও মড়কে।
১৯৭৮-৭৯ সালে দণ্ডকারণ্য থেকে এইসব কিছু নিঃশ্ব মানুষ পালিয়ে আসে পশ্চিম বঙ্গের একটা ছোট দ্বীপ মরিচ ঝাঁপিতে। সেটা সুন্দরবনের কাছে। মরিচখাঁপি থেকে তাদেরকে উৎখাত করতে সে সময়ের পশ্চিম বঙ্গের সিপিএম সরকারের পুলিশ তাদেরকে কাতারে কাতারে গুলি করে হত্যা করে।
এই সব নমশুদ্র মানুষ ১৯৪৭ সালে দেশত্যাগ করেনি। তাদের নেতা যোগেন মণ্ডল বলেছিলেন--নমশুদ্ররা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের চেয়ে বেশি আপন মনে করে মুসলমানদেরকে। মুসলিম লীগের সঙ্গে চুক্তি করে তিনি দেশভাগের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। তাঁর মিত্রদল মুসলিম লীগ তাকে বলে যে, পাকিস্তান নমশুদ্রদের জন্য নিরাপদ দেশ। পাকিস্তান গঠনের মাত্র তিন বছরের মধ্যেই এই নমশুদ্রদের সরকারি পরিকল্পনায় এই নমশুদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষজন দেখতে পান যোগেন মণ্ডল নিজের প্রাণ বাঁচাতে পশ্চিম বঙ্গে পালিয়ে গেছেন। তাদেরকে বাঁচানোর মত কেউ নেই। পাকিস্তান তাদের জন্য নিরাপদ নয়। তারা বুঝতে পারে তারা মাটিশুন্য।
এরা দেশত্যাগ করতে শুরু করে সেই ১৯৫০ সাল থেকে। এখনো চলছে তাদের দেশত্যাগ। এরাই মরেছে দণ্ডকারণ্যে। এরাই মরেছে মরিচঝাঁপিতে।
এদের মধ্যে আমার এক পিসির পরিবার ছিল। তারা পৃথিবী থেকে নাই হয়ে গেছে।
নিউব্যারাকপুর বলে একটা জায়গা আছে, উত্তর চব্বিশ পরগণায়। ব্যারাকপুরের সঙ্গে কোনও যোগ নেই। যশোর জেলায় বারাকপুর বলে একটা গ্রাম ছিল। ১৯৫০ সালের এক রাত। বারাকপুরের হরিপদ বিশ্বাস, তার সঙ্গে আরও অনেক গ্রামবাসী গ্রাম ছাড়লেন। পূর্ব পাকিস্তানে নারকীয় হত্যালীলা শুরু হয়েছে। পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী যোগেন মণ্ডল এই সময়েই কলকাতায় পালিয়ে এসেছিলেন। বলা হয় এক বরিশাল শহরেই এক রাতে দশ হাজার হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছিল।
ReplyDeleteহরিপদ বিশ্বাস ও তার সঙ্গীরা এসে আহারামপুর বলে একটি মুসলমান প্রধান গ্রামে বসতি করলেন। নতুন নাম দিলেন নিউব্যারাকপুর। ধীরে ধীরে এই শহরটি এক বর্ধিষ্ণু সম্ভাবনাময় শহর হয়ে ওঠে, অনেকেই বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে বসতি শুরু করেন। আমার ঠাকুরদা দক্ষিণ কলকাতার ভাড়া বাড়ি ছেড়ে এখানে জমি কিনে বাড়ি করলেন। তাঁর দাদা আগেই এখানে জমি কিনে একটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। নিউব্যারাকপুরের সবথেকে বড় শিবমন্দির সেটি, শিবরাত্রির সময় তার সামনে বড় মেলা বসত। আমার ছোটবেলায় আমি এই নিউব্যারাকপুরে বড় হয়েছি।
আমাদের বাড়ির উল্টোদিকে এক ভদ্রলোক থাকতেন, হরিপদ বিশ্বাসের সহযোগীদের অন্যতম। তিনি ১৯৫০ সালে স্বহস্তে ১০-১২ জন মুসলমানকে হত্যা করেছিলেন। আমি যখন শুনেছিলাম, শিউরে উঠেছিলাম। ওঁর কাছে কখনও যেতাম না, ভয় পেতাম। সদাহাস্যময় মানুষ, বৃদ্ধ বয়েসে গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে গেছিলেন। আমি আজও ভাবলে এক অদ্ভূত বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন হই। সুস্থ সাধারণ মানুষ, কি অমানুষিক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গেছেন, আর কি ভয়ানক দাম দিতে হয়েছিল এঁদের। নিউব্যারাকপুরে কিন্তু খুব মাইক্রোস্কোপিক লেভেলে পাঞ্জাব মডেল অনুসৃত হয়েছিল। নেতা হরিপদ বিশ্বাস, যিনি বিধান রায়ের খুব কাছের লোক ছিলেন। এরা কেউ দানব ছিলেন না। এরা কেউ মানুষহত্যায় অভ্যস্ত ছিলেন না। এরা আমাদের মতই সাধারণ মানুষ ছিলেন। এরা শুধু ইসলামের নারকীয় আক্রমণের যোগ্য জবাব দিয়েছিলেন। এখনও নিউব্যারাকপুরে কয়েকটা পোড়ো মসজিদ দেখা যায়। বাদুড় চামচিকের আড্ডা। অতীতের স্মৃতি ধরে রেখেছে।
এই ইতিহাস কে দাবিয়ে রাখার বেশ কিছু চেষ্টা হয়েছে। কারনটা বোধগম্য। হরিপদ বিশ্বাস কংগ্রেস ভাঙার পরে ইন্দিরা কংগ্রেসে যোগ দেননি। উনি সিন্ডিকেট কংগ্রেসে (ইন্দিরার বিরুদ্ধে নিজলিঙ্গাপ্পা, মোরারজি প্রমুখ যে কংগ্রেস বানালেন; একে আদি কংগ্রেসও বলা হত) যোগ দেন। সত্তরের দশকের শুরুর দিকেই মারা যান হরিপদ বিশ্বাস। এরপরে নিউব্যারাকপুর ভাগাভাগি করে নেয় কমিউনিস্ট ও কংগ্রেস (ইন্দিরা)। এরা কেউই হরিপদ বিশ্বাসের legacy নিয়ে ভাবিত ছিল না।
ReplyDeleteতাছাড়া এই ইতিহাসে জাতীয়তাবাদ রয়েছে। এই ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে সেকুলারদের জারিজুরি ফাঁস হয়ে যায়। এই ইতিহাস ইসলামের নির্মম আক্রমণের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রত্যাঘাতের অস্বস্তিকর দিনলিপিও বটে। এই ইতিহাসকে নষ্ট করার চেষ্টা না হওয়াটাই অস্বাভাবিক।
এখানে আমি পোস্টটি দেই নি। আমার অনুমতি ছাড়া আমার পোস্টটি প্রকাশ করার প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আশা করছি--অনতিবিলম্বে এই পোস্টটি তুলে নেওয়া হবে।
ReplyDelete