শরবিদ্ধ ভীষ্ম |
কুরু বংশের রাজা শান্তনু এবং গঙ্গা দেবীর অষ্টম পুত্র ভীষ্ম (দেবব্রত অথবা পিতামহ ভীষ্ম) । ইনি মহাভারতের একজন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। পান্ডব এবং কৌরব, উভয় বংশের পিতামহ বলে ইনি পিতামহ ভীষ্ম নামেও পরিচিত।
হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনু একদিন ছদ্মবেশী গঙ্গাদেবীর প্রেমে পড়ে তাঁকে বিবাহের প্রস্তাব দিলে গঙ্গাদেবী এই শর্ত দেন যে তাঁর কোনো কাজে রাজার নিষেধ থাকবে না। সেই শর্তে রাজি হয়ে বিবাহের পর রাজা দেখেন যে এক একটি পুত্র জন্ম নিলে তাঁর স্ত্রী তাদের গঙ্গা নদীতে ভাসিয়ে আসেন। পর পর সাত বার এই কষ্ট সহ্য করার পর অষ্টম বার আর থাকতে না পেরে প্রতিবাদ করলেন রাজা। তখন গঙ্গাদেবী নিজের পরিচয় দিয়ে শর্তানুযায়ী বিলীন হয়ে যান। পুত্র বড় হলে ফেরত দেবেন বলে প্রতিজ্ঞা করে সাথে পুত্রকেও নিয়ে যান।
এর পিছনের ঘটনাক্রম অনুযায়ী একদিন অষ্টবসুরা আট জন মিলে বশিষ্ঠ মুনির আশ্রমে সস্ত্রীক আতিথেয়তা গ্রহণ করতে গেছিলেন। এঁদের স্ত্রীদের একজন মুনির গাভী নন্দিনী-র লোভে পড়লে তিনি তার স্বামী প্রভাসকে গাভীটি চুরি করার অনুরোধ করেন। প্রভাস বাকিদের সাহায্য নিয়ে গাভীটি চুরি করে স্ত্রীকে উপহার দিলেন, ক্রমে বশিষ্ঠ মুনি ঘটনাটা জানতে পেরে সবাইকে মর্ত্যে জন্মগ্রহনের অভিশাপ দিলেন। কিন্তু অস্টবসুদের মিনতিতে প্রভাস ছাড়া সকলকেই কয়েক মুহুর্তের জন্য মানব জন্ম গ্রহণ করতে হবে এবং প্রভাস মর্ত্যে বিখ্যাত হবে বলে কিছুটা শাস্তি লাঘব হবে। সেই অনুযায়ী দেবব্রত একমাত্র বসু যিনি মর্ত্যে মানব জীবন যাপন করেছিলেন।
মায়ের সাথে থাকাকালীন ভীষ্ম দেবগুরু বৃহস্পতির কাছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, বশিষ্ঠ মুনির কাছে বেদ ও বেদাঙ্গ এবং পরশুরাম মুনির কাছে ধনুর্বিদ্যা শিখে একজন আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক হয়ে ওঠেন। এমনকি তিনি গুরু পরশুরামের বিরুদ্ধেও বিজেতা হন। সে যুদ্ধ ২৩ দিন ব্যাপী চলেছিল।
ভীষণ প্রতিজ্ঞা গ্রহণ এবং তা সর্বাত্মকভাবে পালন করার জন্য রাজকুমার দেবব্রত ভীষ্ম নামে ভূষিত হন। রাজা শান্তনু ধীবর(জেলে) রাজকন্যা সত্যবতীর প্রেমে পড়ে তাঁকে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। ধীবর রাজ বলেন যে যেহেতু দেবব্রত শান্তনুর প্রথম পুত্র তাই সত্যবতীর ছেলের কোনদিন রাজা হওয়ার সুযোগ আসবে না। সুতরাং তিনি রাজা শান্তনুর এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। তখন রাজকুমার দেবব্রত প্রতিজ্ঞা করলেন যে তিনি কোনদিন রাজা হবেন না। দূরদর্শী ধীবর রাজ তার পর বলেন, যদি দেবব্রতর উত্তরসুরীরা রাজসিংহাসন দাবি করে তাহলেও এ বিয়ে সম্ভব নয়। তখন দেবব্রত আরো প্রতিজ্ঞা করলেন যে তিনি কোনদিন বিয়েই করবেন না। এই ভীষণ প্রতিজ্ঞার জন্য তাঁর নাম হলো ভীষ্ম। ধীবর রাজ এই দুই শর্তে রাজি হয়ে রাজা শান্তনুর হাতে কন্যাদান করেন। রাজা শান্তনু খুশি হয়ে ভীষ্মকে স্বেচ্ছামৃত্যুর বর দিলেন। এই সময় ভীষ্মর এই প্রতিজ্ঞার আসল রহস্য নিয়ে স্বর্গ এবং মর্ত্যলোকে নানা রটনা রটতে লাগলো। অনেকে বলতে শুরু করলেন যে রাজসিংহাসনের আসল উত্তরাধিকারকে সরানোর ক্ষমতা রাজার থাকেনা বলে রাজা শান্তনু দেবব্রত কে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছেন। তখন ভীষ্ম নিজে সমস্ত ব্যাপার খুলে বলেন এবং একান্ত নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী প্রতিজ্ঞা করেছেন বলে জানালেন। কিন্তু আগামী রাজকুমার সিংহাসনের অযোগ্য হলে কি হবে বলে প্রশ্ন তোলেন কুলগুরু। তখন ভীষ্ম আবার প্রতিজ্ঞা করলেন যে, যেই রাজা হোক না কেন, তিনি সবসময় রাজার প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করবেন এবং রাজা শান্তনুর বংশের কোনো অপমান হতে দেবেন না।
বৈমাত্রেয় ভাই বিচিত্রবীর্য-র বিয়ে দেওয়ার জন্য ভীষ্ম কাশী রাজার
আয়োজিত স্বয়ম্ভর সভা থেকে তিন রাজকন্যা অম্বা, অম্বিকা এবং অম্বালিকা-কে জয় করে আনেন। এঁদের মধ্যে বড় মেয়ে অম্বা সৌবলের রাজা
শল্ব-র প্রনয়ী ছিলেন। হস্তিনাপুরে পৌছে অম্বা ভীষ্মকে সে কথা জানালে ভীষ্ম অম্বাকে শল্বর
কাছে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু শল্ব তখন বলেন যে, যেহেতু অম্বা অন্য একজন পুরুষের সাথে অনেকটা সময় কাটিয়েছেন, সুতরাং অম্বাকে বিয়ে করা তার পক্ষে
অপমানজনক। আসলে শল্ব-ও
স্বয়ম্ভর সভায় এসেছিলেন এবং ভীষ্মের কাছে খুব খারাপভাবে পরাজিত হয়ে খুব অপমানিত
বোধ করেছিলেন।
এমতাবস্থায় অম্বা ভীষ্মকে বলেন যে, যেহেতু তিনি অম্বাকে স্বয়ম্ভর সভা থেকে
জয় করে এনেছেন, সেহেতু ভীষ্মের
উচিত অম্বাকে পত্নীরূপে গ্রহণ করা। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ভীষ্ম তাঁর প্রতিজ্ঞার কথা মনে করিয়ে
অম্বার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। নিদারুণ অপমানিত হয়ে নিরুপায়ী অম্বা তখন ভীষ্মের
বিনাশের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে পাগলপ্রায় হয়ে যান। অনেক চেষ্টার পর অবশেষে অম্বা শিবের থেকে
বর পান যে পরজন্মে তিনি ভীষ্মের মৃত্যুর কারণ হবেন। এই অম্বাই পরজন্মে শিখন্ডি হয়ে
জন্মেছিলেন, যাকে দেখে ভীষ্ম
কুরুক্ষেত্রে অস্ত্রত্যাগ করেছিলেন। কারণ, তিনি শিখন্ডিকে দেখে চিনতে পেরেছিলেন এবং কোনো মহিলার বিরুদ্ধে
অস্ত্রধারণ তাঁর নীতিবিরুদ্ধ ছিল।
অম্বা যখন ভীষ্মের বিনাশের জন্য পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছিলেন, সেই সময় অম্বা ভীষ্মের গুরুদেব পরশুরাম
মুনির কাছেও গিয়েছেলেন। পরশুরাম মুনি তাঁর শিষ্য ভীষ্মকে অম্বাকে বিবাহের আদেশ দিলেন। ভীষ্ম প্রতিজ্ঞার প্রসঙ্গ তুলে গুরুদেবের
আদেশ মানতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, প্রয়োজন হলে
তিনি গুরুদেবের জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত আছেন, তবু প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে পারবেননা। যথারীতি গুরুদেব শিষ্যর বিরুদ্ধে যুদ্ধ
ঘোষণা করলেন।
শিখণ্ডী পূর্বজন্মে নারী ছিলেন বলে ভীষ্ম তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবেন
না, তাই শিখণ্ডীকে সামনে রেখে অর্জুন ভীষ্মকে শরে শরে বিদ্ধ করে
শরশয্যায়ে শায়িত করেন। ভীষ্মের ইচ্ছা-মৃত্যু বর ছিল, অর্থাৎ নিজে মৃত্যু
কামনা না করলে, কারোর পক্ষে ওঁকে হত্যা করা সম্ভব ছিল না। আটান্নদিন শর-শয্যায় থেকে বহু তত্ব ও উপদেশ দিয়ে
এই মহাবীর স্বেচ্ছায় প্রাণত্যাগ করেন।
ভীষ্ম আমাদের সবার আদর্শ।
ভীষ্ম আমাদের সবার আদর্শ।
No comments:
Post a Comment