একাত্তরের মে মাসের এক ভোরে আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার ৩০-৩২ জন পাকিস্তানি সেনা সঙ্গে নিয়ে নৌকাযোগে ফরিদপুরের বোয়ালমারী থানার হাসামদিয়া গ্রামের হিন্দুপাড়ায় যান। সেখানে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে বেশ কয়েকজনকে হত্যার পর তাঁরা ময়েনদিয়া বাজারের দোকানপাট লুট করে জ্বালিয়ে দেন। পরে বাচ্চু রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা নৌকাভর্তি লুটের মাল নিয়ে চলে যান।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গণহত্যার এই একটিসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ১০টি ঘটনার তথ্য-প্রমাণসহ তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সদস্য (রুকন) আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে; মুক্তিযুদ্ধকালীন নৃশংসতার জন্য যিনি ফরিদপুরে ‘খাড়দিয়ার বাচ্চু রাজাকার’ নামে বেশি পরিচিত। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলির (চিফ প্রসিকিউটর) কার্যালয়ে আজ রোববার তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা। তবে ট্রাইব্যুনালের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে বাচ্চু রাজাকার বর্তমানে পলাতক।
মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়েছে। রোববার এটি ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনে এটি জমা দেওয়া হবে। ২০১১ সালের ১০ এপ্রিল তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছিল।’
প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে তদন্ত সংস্থার সূত্র জানায়, একাত্তরের ২১ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেজর আকরাম কোরাইশীর নেতৃত্বে ৩০০ থেকে ৪০০ পাকিস্তানি সেনা ফরিদপুর যাওয়ার পথে গোয়ালচামট এলাকায় স্থানীয় জামায়াত, মুসলিম লীগ, কনভেনশন মুসলিম লীগের নেতারা তাঁদের অভ্যর্থনা জানান। এ সময় তাঁদের সঙ্গে ছিলেন আবুল কালাম আযাদ। তিনি ওই সময় জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ফরিদপুর শহরে ঢোকার পথে পাকিস্তানি সেনারা প্রভু জগদ্বন্ধু আশ্রমে ঢুকে আটজন হিন্দু পূজারিকে প্রার্থনারত অবস্থায় হত্যা করেন। এরপর শহরে ঢুকে চকবাজারের কয়েকটি দোকান জ্বালিয়ে দেন তাঁরা।
তদন্ত সংস্থার সূত্র জানায়, পাকিস্তানি সেনারা ফরিদপুর স্টেডিয়াম ও পুরাতন সার্কিট হাউস দখল করে ক্যাম্প বসান। এপ্রিল মাসের শেষদিকে ফরিদপুরে শান্তি কমিটি গঠনের পর মে মাসের প্রথম দিকে আবুল কালাম আযাদের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। পাকিস্তানি সেনারা পরে তাঁকে জেলার আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেন।
গত ২ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল-২-এ আবুল কালাম আযাদকে গ্রেপ্তারের আবেদন উপস্থাপনের সময় রাষ্ট্রপক্ষ বলে, বাচ্চু রাজাকার তাঁর সঙ্গী রাজাকারদের নিয়ে ফরিদপুর পুলিশ লাইনে, অম্বিকা মেমোরিয়াল হল মাঠে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নেন। পাকিস্তানি সেনাদের কাছ থেকে অস্ত্র পেয়ে তিনি ফরিদপুরের জসীমউদ্দীন রোডে হীরালাল মুক্তারের দোতলা বাড়ি দখল করে রাজাকারদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র এবং চকবাজারে বদ্রি নারায়ণের দোতলা বাড়ি দখল করে নির্যাতনকক্ষ ও রাজাকারদের কার্যালয় স্থাপন করেন।
তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিচারাধীন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন বাচ্চু রাজাকার। ফরিদপুর স্টেডিয়াম ও সার্কিট হাউসে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে গিয়ে তাঁরা নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতেন। বাচ্চু রাজাকারের নেতৃত্বে রাজাকারেরা অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোককে ধরে এনে স্টেডিয়াম ও সার্কিট হাউসে আটকে রাখতেন। পরে তাঁদের নির্যাতন ও হত্যা করে গোয়ালচামটের ভাগাড় নামক স্থানে ও নদীতে ফেলে দিতেন। ওই সময় স্টেডিয়ামে অসংখ্য লাশ মাটিচাপা দেওয়া হয়, মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্থানীয় লোকজন সেখানে অসংখ্য লাশ দেখতে পায়।
হত্যা, অপহরণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ: আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ হওয়া উপলক্ষে ২৬ জুলাই তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, মুক্তিযুদ্ধকালে ফরিদপুরের অসংখ্য মানুষ বাচ্চু রাজাকারের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে নিহত ১৪ জনের পরিচয় মিলেছে, যাঁদের অনেককে তিনি নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করেছেন। তদন্তে উঠে এসেছে তাঁর হাতে অপহূত নয়জন ও আটক হওয়া ১০ জনের নাম-পরিচয়সহ সাক্ষ্য-প্রমাণ। তাঁর লুট করা ১৫টি বাড়িসহ জ্বালিয়ে দেওয়া পাঁচটি বাড়ি চিহ্নিত করা গেছে।
তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, একাত্তরের মে মাসে বাচ্চু রাজাকার ১০-১২ জন রাজাকারসহ সশস্ত্র অবস্থায় বোয়ালমারী থানার কলারণ গ্রামের সুধাংশু মোহন রায়ের বাড়ি যায়। রাজাকারেরা সুধাংশু ও তাঁর ছেলেকে বাড়ির পূর্ব পাশের রাস্তায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। সুধাংশুর হাতের আঙিট খুলে নিয়ে তাঁরা বাবা-ছেলেকে বাড়ি ফিরে যেতে বলে। সুধাংশু ছেলেকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলে পেছন থেকে বাচ্চু রাজাকার তাঁর হাতের রাইফেল দিয়ে গুলি করেন। সুধাংশু মারা যান, তাঁর ছেলের ডান পায়ের হাঁটুর নিচে গুলি লাগে।
তদন্ত সংস্থার সূত্র জানায়, সুধাংশুকে হত্যার দু-একদিন পর বাচ্চু রাজাকার তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে সালথা থানার (সাবেক নগরকান্দা) পুরুরা নমপাড়া গ্রামের মাধবচন্দ্র বিশ্বাসের বাড়িতে যান। মাধব মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করতেন। মাধবের ঘরে থাকা টাকা-পয়সা, স্বর্ণালংকার লুটের পর বাচ্চু রাজাকার তাঁকে বাড়ির পশ্চিমে পুকুরপাড়ে নিয়ে গুলি চালিয়ে হত্যা করেন। ওই দিন একই জায়গায় জ্ঞানেন্দ্র মণ্ডল নামে আরেকজনকে গুলি করে হত্যা করেন বাচ্চু রাজাকার। তাঁর ভয়ে ওই গ্রামের ৫০০ থেকে ৬০০ হিন্দু ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়। মে মাসের মাঝামাঝি বাচ্চু রাজাকারদের নেতৃত্বে একটি দল সালথা সাহাপাড়ার দুই হিন্দু বাড়িতে হামলা চালিয়ে মূল্যবান তামা-কাঁসা ও সোনা-রূপা লুট করে ঘরবাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। প্রায় একই সময় তাঁরা হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম জয়কালীতে ঘরবাড়ি লুট করেন।
তদন্ত সংস্থার সূত্র জানায়, জুনের প্রথম দিকে এক দিন বাচ্চু রাজাকার ও ২০-২৫ জন সশস্ত্র রাজাকার দুটি বড় নৌকাযোগে সালথা থানার ফুলবাড়িয়া গ্রামে যান। গ্রামটির হিন্দুপাড়ায় লুটপাট চালানোর পর বাচ্চু রাজাকার নিজ হাতে চিত্তরঞ্জন দাস ও বাদল দেবনাথকে হত্যা করেন। চিত্ত ও বাদলের মরদেহের পায়ে দড়ি বেঁধে কুমার নদে ফেলে দেওয়া হয়। অনেক খুঁজেও তাঁদের মরদেহ আর পাওয়া যায়নি।
ধর্ষণ: একাত্তরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে বাচ্চু রাজাকার তাঁর রাজাকার সঙ্গীদের নিয়ে বোয়ালমারী থানার একটি গ্রামে যান। রাজাকারেরা সেখানে একটি হিন্দু বাড়িতে হামলা চালালে ওই বাড়ির নারী-পুরুষেরা পালানোর চেষ্টা করে। বেশির ভাগ পালাতে পারলেও দুজন নারী রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। বাচ্চু রাজাকার ও তাঁর সঙ্গীরা ওই দুই নারীকে গণধর্ষণ করেন এবং স্বর্ণালংকার লুট করেন। ওই ঘটনার পর তাঁরা শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে গেলেও স্বাধীনতার পর আবার ফিরে আসেন। কিন্তু দেশে ফিরে তাঁরা দেখেন, বসতভিটা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ওই দুই নারী আবার ভারতে চলে যান, আর তাঁরা ফেরেননি।
এই দুই নারী ছাড়াও বাচ্চু রাজাকারের ধর্ষণের শিকার আরেক নারীর পরিচয় ও ঘটনার তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত সংস্থা। সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ সদস্য সানাউল হক বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, একাত্তরে বাচ্চু রাজাকার শুধু একজন নৃশংস হত্যাকারী ছিলেন না, তিনি ছিলেন অন্যতম ধর্ষণকারী। মুক্তিযুদ্ধকালে অসংখ্য নারী তাঁর কাছে সম্ভ্রম হারিয়েছেন। তদন্তে এর মধ্যে তিনজনের নাম-পরিচয়সহ তথ্য-উপাত্ত ও সাক্ষ্য পাওয়া গেছে।
ধর্মান্তরিত করা: তদন্ত সংস্থার সূত্র জানায়, একাত্তরের মে মাসে রাজাকারেরা সালথা থানার সাহাপাড়ায় এক বাড়ির কাচারিঘরে ১৫-২০ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোককে জড়ো করে। বাচ্চু রাজাকার তাঁদের ভয় দেখিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করেন। তদন্ত প্রতিবেদনে জোর করে ধর্মান্তরিত হওয়া নয়জনের নাম ও পরিচয় দেওয়া হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গণহত্যার এই একটিসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ১০টি ঘটনার তথ্য-প্রমাণসহ তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সদস্য (রুকন) আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে; মুক্তিযুদ্ধকালীন নৃশংসতার জন্য যিনি ফরিদপুরে ‘খাড়দিয়ার বাচ্চু রাজাকার’ নামে বেশি পরিচিত। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলির (চিফ প্রসিকিউটর) কার্যালয়ে আজ রোববার তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা। তবে ট্রাইব্যুনালের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে বাচ্চু রাজাকার বর্তমানে পলাতক।
মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়েছে। রোববার এটি ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনে এটি জমা দেওয়া হবে। ২০১১ সালের ১০ এপ্রিল তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছিল।’
প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে তদন্ত সংস্থার সূত্র জানায়, একাত্তরের ২১ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেজর আকরাম কোরাইশীর নেতৃত্বে ৩০০ থেকে ৪০০ পাকিস্তানি সেনা ফরিদপুর যাওয়ার পথে গোয়ালচামট এলাকায় স্থানীয় জামায়াত, মুসলিম লীগ, কনভেনশন মুসলিম লীগের নেতারা তাঁদের অভ্যর্থনা জানান। এ সময় তাঁদের সঙ্গে ছিলেন আবুল কালাম আযাদ। তিনি ওই সময় জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ফরিদপুর শহরে ঢোকার পথে পাকিস্তানি সেনারা প্রভু জগদ্বন্ধু আশ্রমে ঢুকে আটজন হিন্দু পূজারিকে প্রার্থনারত অবস্থায় হত্যা করেন। এরপর শহরে ঢুকে চকবাজারের কয়েকটি দোকান জ্বালিয়ে দেন তাঁরা।
তদন্ত সংস্থার সূত্র জানায়, পাকিস্তানি সেনারা ফরিদপুর স্টেডিয়াম ও পুরাতন সার্কিট হাউস দখল করে ক্যাম্প বসান। এপ্রিল মাসের শেষদিকে ফরিদপুরে শান্তি কমিটি গঠনের পর মে মাসের প্রথম দিকে আবুল কালাম আযাদের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। পাকিস্তানি সেনারা পরে তাঁকে জেলার আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেন।
গত ২ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল-২-এ আবুল কালাম আযাদকে গ্রেপ্তারের আবেদন উপস্থাপনের সময় রাষ্ট্রপক্ষ বলে, বাচ্চু রাজাকার তাঁর সঙ্গী রাজাকারদের নিয়ে ফরিদপুর পুলিশ লাইনে, অম্বিকা মেমোরিয়াল হল মাঠে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নেন। পাকিস্তানি সেনাদের কাছ থেকে অস্ত্র পেয়ে তিনি ফরিদপুরের জসীমউদ্দীন রোডে হীরালাল মুক্তারের দোতলা বাড়ি দখল করে রাজাকারদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র এবং চকবাজারে বদ্রি নারায়ণের দোতলা বাড়ি দখল করে নির্যাতনকক্ষ ও রাজাকারদের কার্যালয় স্থাপন করেন।
তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিচারাধীন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন বাচ্চু রাজাকার। ফরিদপুর স্টেডিয়াম ও সার্কিট হাউসে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে গিয়ে তাঁরা নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতেন। বাচ্চু রাজাকারের নেতৃত্বে রাজাকারেরা অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোককে ধরে এনে স্টেডিয়াম ও সার্কিট হাউসে আটকে রাখতেন। পরে তাঁদের নির্যাতন ও হত্যা করে গোয়ালচামটের ভাগাড় নামক স্থানে ও নদীতে ফেলে দিতেন। ওই সময় স্টেডিয়ামে অসংখ্য লাশ মাটিচাপা দেওয়া হয়, মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্থানীয় লোকজন সেখানে অসংখ্য লাশ দেখতে পায়।
হত্যা, অপহরণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ: আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ হওয়া উপলক্ষে ২৬ জুলাই তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, মুক্তিযুদ্ধকালে ফরিদপুরের অসংখ্য মানুষ বাচ্চু রাজাকারের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে নিহত ১৪ জনের পরিচয় মিলেছে, যাঁদের অনেককে তিনি নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করেছেন। তদন্তে উঠে এসেছে তাঁর হাতে অপহূত নয়জন ও আটক হওয়া ১০ জনের নাম-পরিচয়সহ সাক্ষ্য-প্রমাণ। তাঁর লুট করা ১৫টি বাড়িসহ জ্বালিয়ে দেওয়া পাঁচটি বাড়ি চিহ্নিত করা গেছে।
তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, একাত্তরের মে মাসে বাচ্চু রাজাকার ১০-১২ জন রাজাকারসহ সশস্ত্র অবস্থায় বোয়ালমারী থানার কলারণ গ্রামের সুধাংশু মোহন রায়ের বাড়ি যায়। রাজাকারেরা সুধাংশু ও তাঁর ছেলেকে বাড়ির পূর্ব পাশের রাস্তায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। সুধাংশুর হাতের আঙিট খুলে নিয়ে তাঁরা বাবা-ছেলেকে বাড়ি ফিরে যেতে বলে। সুধাংশু ছেলেকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলে পেছন থেকে বাচ্চু রাজাকার তাঁর হাতের রাইফেল দিয়ে গুলি করেন। সুধাংশু মারা যান, তাঁর ছেলের ডান পায়ের হাঁটুর নিচে গুলি লাগে।
তদন্ত সংস্থার সূত্র জানায়, সুধাংশুকে হত্যার দু-একদিন পর বাচ্চু রাজাকার তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে সালথা থানার (সাবেক নগরকান্দা) পুরুরা নমপাড়া গ্রামের মাধবচন্দ্র বিশ্বাসের বাড়িতে যান। মাধব মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করতেন। মাধবের ঘরে থাকা টাকা-পয়সা, স্বর্ণালংকার লুটের পর বাচ্চু রাজাকার তাঁকে বাড়ির পশ্চিমে পুকুরপাড়ে নিয়ে গুলি চালিয়ে হত্যা করেন। ওই দিন একই জায়গায় জ্ঞানেন্দ্র মণ্ডল নামে আরেকজনকে গুলি করে হত্যা করেন বাচ্চু রাজাকার। তাঁর ভয়ে ওই গ্রামের ৫০০ থেকে ৬০০ হিন্দু ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়। মে মাসের মাঝামাঝি বাচ্চু রাজাকারদের নেতৃত্বে একটি দল সালথা সাহাপাড়ার দুই হিন্দু বাড়িতে হামলা চালিয়ে মূল্যবান তামা-কাঁসা ও সোনা-রূপা লুট করে ঘরবাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। প্রায় একই সময় তাঁরা হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম জয়কালীতে ঘরবাড়ি লুট করেন।
তদন্ত সংস্থার সূত্র জানায়, জুনের প্রথম দিকে এক দিন বাচ্চু রাজাকার ও ২০-২৫ জন সশস্ত্র রাজাকার দুটি বড় নৌকাযোগে সালথা থানার ফুলবাড়িয়া গ্রামে যান। গ্রামটির হিন্দুপাড়ায় লুটপাট চালানোর পর বাচ্চু রাজাকার নিজ হাতে চিত্তরঞ্জন দাস ও বাদল দেবনাথকে হত্যা করেন। চিত্ত ও বাদলের মরদেহের পায়ে দড়ি বেঁধে কুমার নদে ফেলে দেওয়া হয়। অনেক খুঁজেও তাঁদের মরদেহ আর পাওয়া যায়নি।
ধর্ষণ: একাত্তরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে বাচ্চু রাজাকার তাঁর রাজাকার সঙ্গীদের নিয়ে বোয়ালমারী থানার একটি গ্রামে যান। রাজাকারেরা সেখানে একটি হিন্দু বাড়িতে হামলা চালালে ওই বাড়ির নারী-পুরুষেরা পালানোর চেষ্টা করে। বেশির ভাগ পালাতে পারলেও দুজন নারী রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। বাচ্চু রাজাকার ও তাঁর সঙ্গীরা ওই দুই নারীকে গণধর্ষণ করেন এবং স্বর্ণালংকার লুট করেন। ওই ঘটনার পর তাঁরা শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে গেলেও স্বাধীনতার পর আবার ফিরে আসেন। কিন্তু দেশে ফিরে তাঁরা দেখেন, বসতভিটা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ওই দুই নারী আবার ভারতে চলে যান, আর তাঁরা ফেরেননি।
এই দুই নারী ছাড়াও বাচ্চু রাজাকারের ধর্ষণের শিকার আরেক নারীর পরিচয় ও ঘটনার তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত সংস্থা। সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ সদস্য সানাউল হক বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, একাত্তরে বাচ্চু রাজাকার শুধু একজন নৃশংস হত্যাকারী ছিলেন না, তিনি ছিলেন অন্যতম ধর্ষণকারী। মুক্তিযুদ্ধকালে অসংখ্য নারী তাঁর কাছে সম্ভ্রম হারিয়েছেন। তদন্তে এর মধ্যে তিনজনের নাম-পরিচয়সহ তথ্য-উপাত্ত ও সাক্ষ্য পাওয়া গেছে।
ধর্মান্তরিত করা: তদন্ত সংস্থার সূত্র জানায়, একাত্তরের মে মাসে রাজাকারেরা সালথা থানার সাহাপাড়ায় এক বাড়ির কাচারিঘরে ১৫-২০ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোককে জড়ো করে। বাচ্চু রাজাকার তাঁদের ভয় দেখিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করেন। তদন্ত প্রতিবেদনে জোর করে ধর্মান্তরিত হওয়া নয়জনের নাম ও পরিচয় দেওয়া হয়েছে।
No comments:
Post a Comment