শুভ জন্মাষ্টমী
তা রা প দ আ চা র্য্য
দ্বাপর যুগের শেষের দিকে পৃথিবীজুড়ে একটা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল। কতিপয় রাজা রাজধর্ম, কুলাচার, সদাচার ভুলে গিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা, অন্যায়-অবিচারে মত্ত হয়ে উঠেছিলেন। মথুরার রাজা কংস পিতা উগ্রসেনকে উত্খাত করে নিজে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। একই রকম ত্রাসের শাসন চালিয়েছিলেন জরাসন্ধ, চেদিরাজ শিশুপালসহ অনেক রাজা। মহাভারতে বর্ণিত দুঃশাসন কর্তৃক সভাসমক্ষে কুলবধূ দ্রৌপদীর অবমাননা এক লজ্জাকর অধ্যায়। জনসমক্ষে নারীর এমন অবমাননার প্রতিবাদ করার সাহস ছিল না তখন সত্-ধার্মিক ব্যক্তিদের। এভাবেই তখন পাপের রাজ্যে বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদত।
এই অরাজকতার অবসান ঘটাতে অবতীর্ণ হন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। ভাদ্র মাসের অষ্টমী তিথি। মধ্যরাতের নিবিড় অন্ধকারে ভুবন আবৃত। সবাই গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। এরকম সময়ে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মধারী, চতুর্ভুজ মূর্তিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কংসের কারাগারে আবির্ভূত হন। বসুদেব দেবকী বিস্ময় বস্ফািরিত লোচনে প্রত্যক্ষ করলেন শ্রীভগবানের সেই জ্যোর্তিময় আবির্ভাব। আলোর বন্যায় ভেসে গেল বিশ্বচরাচর। দেবকী-বসুদেব নয়নভরে দেখলেন অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত মনোহর শিশুটিকে—চতুর্ভুজ, বর্ণমালা পিতবসন পরিহিত অবস্থায়। শ্রীভগবানের আবির্ভাবের ক্ষণটিও সর্বসুলক্ষণযুক্ত, ঐশ্বর্যমণ্ডিত তাত্পর্যে উদ্ভাসিত। শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব লীলা সত্যিই অপূর্ব সুশোভামণ্ডিত, তাত্পর্যপূর্ণ। কৃষ্ণের নির্দেশ মতো তাকে কোলে করে সেই ঘোর আঁধার রাতে বেরোলেন বসুদেব। কারাগারে লোহার শিকল, বন্ধ দরজা আপনা-আপনি উন্মুক্ত হলো। অঝোর বারিধারার সিঞ্চন থেকে শ্রীকৃষ্ণকে বাঁচাতে অনন্তদেব এসে ফণা বিস্তার করে চক্রধারণ করলেন। ভরা ভাদ্রের প্রমত্তা যমুনাও কৃষ্ণ গমনের পথ সুগম করে দিলেন নিজেই। এ সবই শ্রীকৃষ্ণের অলৌকিক ঐশ্বর্যের প্রকাশ। যুক্তিবাদীরা এসবকে অবিশ্বাস্য কল্পনাবিলাস বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেও ভক্তের হৃদয় যতই চিন্ময়ের দিকে অগ্রসর হয় ততই এসব মধুর শাশ্বত লীলা ভক্তের হৃদয়ে সত্যরূপে উদ্ভাসিত হতে থাকে। শ্রীমদ্ভগবদ গীতায় উল্লেখ আছে, যিনি যেভাবে তাঁকে ভজন করেন, ভগবান সেভাবেই তাকে অনুগ্রহ করেন। তাই কংসের কারাগারে দেবকী-বসুদেবের সম্মুখে শ্রীকৃষ্ণ চতুর্ভুজ শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মধারী, আর নন্দালয়ে তিনি পূর্ণ অবতারস্বরূপ দ্বিভুজ মূর্তিতে উপস্থিত হলেন। ঐশ্বর্যলেশহীন বাত্সল্য প্রেমে নন্দালয়ে শ্রীকৃষ্ণের অভিষেক হলো সাধারণ মানবিক পরিবেশে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন—হে ভারত, যখনই পৃথিবীতে অধর্ম বেড়ে যায় তখন আমি অবতীর্ণ হই, অবতীর্ণ হয়ে সাধুদের রক্ষা, দুষ্টদের বিনাশ ও ধর্ম সংস্থাপন করি। আর এ কারণগুলোর জন্যই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পৃথিবীতে অবতরণ অর্থাত্ অবতার রূপে জন্ম নিয়েছিলেন।
এছাড়া তিনি তার জন্ম নিয়ে নিজেই বলেছেন, তার জন্ম সাধারণ মানুষদের মতো নয় এবং তার মৃত্যুও সাধারণ মানুষের মতো নয়। মানুষ জন্মগ্রহণ করে এবং মারা যায়; কিন্তু আমি জন্মরহিত হয়েও আবির্ভূত হই এবং অবিনশ্বর হয়েও অন্তর্ধান করে থাকি।
পৃথিবী ভগবান থেকেই সৃষ্টি এবং তাতেই বিলীন হয়, অতএব ভগবান হচ্ছেন এই পৃথিবীর মহাকারণ—এটি মেনে নেয়াকে বলা হয় ‘জ্ঞান’। ভগবান ছাড়া আর কিছুই নেই, সবই তিনি, ভগবান স্বয়ং সবকিছু হয়ে আছেন—এটা অনুভব করাকে বলা হয় ‘বিজ্ঞান’।
‘বিজ্ঞানসহ জ্ঞান’কে জানার পর আর কিছু বাকি থাকে না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, মূল কথা হলো, আমি ছাড়া জগতের মূল আর কেউই নেই, কেবল আমিই আছি। কারণ এটা ছাড়া আর কিছু জানার যোগ্য নেই। যদি সেই পরমাত্মাকে না জেনে পৃথিবীর অন্যান্য বিদ্যাকে জানা হয়, তবে প্রকৃতপক্ষে কিছুই জানা হয় না, শুধু পণ্ডশ্রমই করা হয়।
‘জানার কিছু বাকি থাকে না’—এর অর্থ হলো ইন্দ্রিয় দ্বারা, মন দ্বারা, বুদ্ধির দ্বারা, যে পরমাত্মাকে জানা, তা প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ জানা নয়। কারণ এই ইন্দ্রিয়াদি, মন, বুদ্ধি সবই প্রাকৃত, তাই এগুলো প্রকৃতির অতীত তত্ত্ব জানতে পারে না। স্বয়ং যখন পরমাত্মার শরণাগত হয়, তখন স্বয়ং-ই পরমাত্মাকে জানে। কেননা পরমাত্মাকে স্বয়ং-এর দ্বারাই জানা সম্ভব, মন-বুদ্ধি ইত্যাদির সাহায্যে জানা সম্ভব নয়।
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে ‘বিজ্ঞানসহ জ্ঞান’ বলায় ‘জ্ঞান’-এর প্রাধান্য এবং ‘বিজ্ঞান’-এর গৌণত্ব দেখা যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়। কেবল ‘জ্ঞান’-এর সাহায্যে মুক্তিলাভ হতে পারে। কিন্তু প্রেমের অনন্ত আনন্দ তখনই পাওয়া যায় যখন ‘জ্ঞান’-এর সঙ্গে ‘বিজ্ঞান’-এর যোগ হয়। ‘জ্ঞান’ হচ্ছে অর্থের মতো আর ‘বিজ্ঞান’ হলো আকর্ষণ। যেমন অর্থের আকর্ষণে সুখ থাকে তা অর্থে নেই; তেমনি ‘বিজ্ঞান’-এ যে আনন্দ আছে তা ‘জ্ঞান’-এ নেই। ‘জ্ঞান’-এ আছে অখণ্ড রস, কিন্তু ‘বিজ্ঞান’-এ রস প্রতি মুহূর্তে বর্ধমান। তাই ‘বিজ্ঞানসহ জ্ঞান’ বলায় ভগবানের লক্ষ্য প্রধানত ‘বিজ্ঞান’-এর দিকে এবং সেটাকেই ভগবান শ্রেষ্ঠ বলে জানাতে চান, কারণ ‘বিজ্ঞান’ সমগ্রতারই বাচক।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ
এই অরাজকতার অবসান ঘটাতে অবতীর্ণ হন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। ভাদ্র মাসের অষ্টমী তিথি। মধ্যরাতের নিবিড় অন্ধকারে ভুবন আবৃত। সবাই গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। এরকম সময়ে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মধারী, চতুর্ভুজ মূর্তিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কংসের কারাগারে আবির্ভূত হন। বসুদেব দেবকী বিস্ময় বস্ফািরিত লোচনে প্রত্যক্ষ করলেন শ্রীভগবানের সেই জ্যোর্তিময় আবির্ভাব। আলোর বন্যায় ভেসে গেল বিশ্বচরাচর। দেবকী-বসুদেব নয়নভরে দেখলেন অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত মনোহর শিশুটিকে—চতুর্ভুজ, বর্ণমালা পিতবসন পরিহিত অবস্থায়। শ্রীভগবানের আবির্ভাবের ক্ষণটিও সর্বসুলক্ষণযুক্ত, ঐশ্বর্যমণ্ডিত তাত্পর্যে উদ্ভাসিত। শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব লীলা সত্যিই অপূর্ব সুশোভামণ্ডিত, তাত্পর্যপূর্ণ। কৃষ্ণের নির্দেশ মতো তাকে কোলে করে সেই ঘোর আঁধার রাতে বেরোলেন বসুদেব। কারাগারে লোহার শিকল, বন্ধ দরজা আপনা-আপনি উন্মুক্ত হলো। অঝোর বারিধারার সিঞ্চন থেকে শ্রীকৃষ্ণকে বাঁচাতে অনন্তদেব এসে ফণা বিস্তার করে চক্রধারণ করলেন। ভরা ভাদ্রের প্রমত্তা যমুনাও কৃষ্ণ গমনের পথ সুগম করে দিলেন নিজেই। এ সবই শ্রীকৃষ্ণের অলৌকিক ঐশ্বর্যের প্রকাশ। যুক্তিবাদীরা এসবকে অবিশ্বাস্য কল্পনাবিলাস বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেও ভক্তের হৃদয় যতই চিন্ময়ের দিকে অগ্রসর হয় ততই এসব মধুর শাশ্বত লীলা ভক্তের হৃদয়ে সত্যরূপে উদ্ভাসিত হতে থাকে। শ্রীমদ্ভগবদ গীতায় উল্লেখ আছে, যিনি যেভাবে তাঁকে ভজন করেন, ভগবান সেভাবেই তাকে অনুগ্রহ করেন। তাই কংসের কারাগারে দেবকী-বসুদেবের সম্মুখে শ্রীকৃষ্ণ চতুর্ভুজ শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মধারী, আর নন্দালয়ে তিনি পূর্ণ অবতারস্বরূপ দ্বিভুজ মূর্তিতে উপস্থিত হলেন। ঐশ্বর্যলেশহীন বাত্সল্য প্রেমে নন্দালয়ে শ্রীকৃষ্ণের অভিষেক হলো সাধারণ মানবিক পরিবেশে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন—হে ভারত, যখনই পৃথিবীতে অধর্ম বেড়ে যায় তখন আমি অবতীর্ণ হই, অবতীর্ণ হয়ে সাধুদের রক্ষা, দুষ্টদের বিনাশ ও ধর্ম সংস্থাপন করি। আর এ কারণগুলোর জন্যই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পৃথিবীতে অবতরণ অর্থাত্ অবতার রূপে জন্ম নিয়েছিলেন।
এছাড়া তিনি তার জন্ম নিয়ে নিজেই বলেছেন, তার জন্ম সাধারণ মানুষদের মতো নয় এবং তার মৃত্যুও সাধারণ মানুষের মতো নয়। মানুষ জন্মগ্রহণ করে এবং মারা যায়; কিন্তু আমি জন্মরহিত হয়েও আবির্ভূত হই এবং অবিনশ্বর হয়েও অন্তর্ধান করে থাকি।
পৃথিবী ভগবান থেকেই সৃষ্টি এবং তাতেই বিলীন হয়, অতএব ভগবান হচ্ছেন এই পৃথিবীর মহাকারণ—এটি মেনে নেয়াকে বলা হয় ‘জ্ঞান’। ভগবান ছাড়া আর কিছুই নেই, সবই তিনি, ভগবান স্বয়ং সবকিছু হয়ে আছেন—এটা অনুভব করাকে বলা হয় ‘বিজ্ঞান’।
‘বিজ্ঞানসহ জ্ঞান’কে জানার পর আর কিছু বাকি থাকে না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, মূল কথা হলো, আমি ছাড়া জগতের মূল আর কেউই নেই, কেবল আমিই আছি। কারণ এটা ছাড়া আর কিছু জানার যোগ্য নেই। যদি সেই পরমাত্মাকে না জেনে পৃথিবীর অন্যান্য বিদ্যাকে জানা হয়, তবে প্রকৃতপক্ষে কিছুই জানা হয় না, শুধু পণ্ডশ্রমই করা হয়।
‘জানার কিছু বাকি থাকে না’—এর অর্থ হলো ইন্দ্রিয় দ্বারা, মন দ্বারা, বুদ্ধির দ্বারা, যে পরমাত্মাকে জানা, তা প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ জানা নয়। কারণ এই ইন্দ্রিয়াদি, মন, বুদ্ধি সবই প্রাকৃত, তাই এগুলো প্রকৃতির অতীত তত্ত্ব জানতে পারে না। স্বয়ং যখন পরমাত্মার শরণাগত হয়, তখন স্বয়ং-ই পরমাত্মাকে জানে। কেননা পরমাত্মাকে স্বয়ং-এর দ্বারাই জানা সম্ভব, মন-বুদ্ধি ইত্যাদির সাহায্যে জানা সম্ভব নয়।
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে ‘বিজ্ঞানসহ জ্ঞান’ বলায় ‘জ্ঞান’-এর প্রাধান্য এবং ‘বিজ্ঞান’-এর গৌণত্ব দেখা যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়। কেবল ‘জ্ঞান’-এর সাহায্যে মুক্তিলাভ হতে পারে। কিন্তু প্রেমের অনন্ত আনন্দ তখনই পাওয়া যায় যখন ‘জ্ঞান’-এর সঙ্গে ‘বিজ্ঞান’-এর যোগ হয়। ‘জ্ঞান’ হচ্ছে অর্থের মতো আর ‘বিজ্ঞান’ হলো আকর্ষণ। যেমন অর্থের আকর্ষণে সুখ থাকে তা অর্থে নেই; তেমনি ‘বিজ্ঞান’-এ যে আনন্দ আছে তা ‘জ্ঞান’-এ নেই। ‘জ্ঞান’-এ আছে অখণ্ড রস, কিন্তু ‘বিজ্ঞান’-এ রস প্রতি মুহূর্তে বর্ধমান। তাই ‘বিজ্ঞানসহ জ্ঞান’ বলায় ভগবানের লক্ষ্য প্রধানত ‘বিজ্ঞান’-এর দিকে এবং সেটাকেই ভগবান শ্রেষ্ঠ বলে জানাতে চান, কারণ ‘বিজ্ঞান’ সমগ্রতারই বাচক।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ
No comments:
Post a Comment